ভারতীয় ফুটবলে ভিশন-২০৪৭ আজ ভীষণ কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

রণজিৎ দাস

ফিফা র‍্যাঙ্কিং-এর ধারাবাহিক উন্নতি নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত সংস্কার, কৌশলগত ম্যাচ পরিকল্পনা এবং তৃণমূল পর্যায়ে বিনিয়োগ প্রয়োজন।

২০২৫ সালের নভেম্বরের সর্বশেষ ফিফা র‍্যাঙ্কিং অনুসারে ভারতীয় দল ছয় ধাপ নিচে নেমে ১৪২তম স্থানে অবস্থান করছে। এই অবস্হান সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতের অন্যতম বড় পতন। এই পতনটি শুধুমাত্র মাঠের পারফরম্যান্সের নিম্নমুখী প্রবণতার ইঙ্গিত দেয় না, বরং এটি ভারতীয় ফুটবলের সামগ্রিক কাঠামোগত দুর্বলতার পরিচয়।


বিশেষত বাংলাদেশের কাছে পরাজয়ের মতো হতাশাজনক ফলাফলের পর ভারত মূল্যবান র‍্যাঙ্কিং পয়েন্ট হারিয়েছে।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ভারতের সর্বোচ্চ র‍্যাঙ্কিং ছিল ৯৪তম, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ এবং সর্বনিম্ন ছিল ১৭৩তম, মার্চ ২০১৫। একটি জাতীয় দল যখন তার সর্বোচ্চ ঐতিহাসিক অবস্থান থেকে এতো নিচে নেমে যায় এবং এমনকি আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে হেরে যায়, তখন এটি স্পষ্টতই একটি ‘ওয়েক আপ কল’ হিসেবে কাজ করে । নীতিনির্ধারক এবং ফেডারেশনের কাছে এই পতনটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। বিদ্যমান কাঠামোগত দুর্বলতাগুলি দ্রুত সমাধান না করলে ভবিষ্যতে র‍্যাঙ্কিং য়ের আরও অবনতি হতে পারে। বিশ্ব ফুটবলে প্রতিযোগিতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে পারফরম্যান্সে সামান্যতম পতনও র‍্যাঙ্কিংয়ে বড় পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

কৌশলগত স্তম্ভসমূহ
ফিফা র‍্যাঙ্কিং-এ ধারাবাহিক এবং স্থায়ী উন্নতি নিশ্চিত করার জন্য চারটি প্রধান কৌশলগত স্তম্ভের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।

প্রথমত, মেকানিজমের কৌশলগত ব্যবহার। ফিফা বিশ্ব র্যা ঙ্কিং পদ্ধতির বিশ্লেষণ করে সর্বোচ্চ পয়েন্ট অর্জন নিশ্চিত করা।

দ্বিতীয়ত, ইন্ডিয়ান সুপার লিগ-কে আন্তর্জাতিক মানের করে তোলা এবং একটি স্থিতিশীল ওঠা নামা চালু করা।
তারপরে খেলোয়াড় এবং কোচের মানোন্নয়নের জন্য উচ্চ-পারফরম্যান্স প্রোটোকল বাধ্যতামূলক করা।
পরিশেষে সমন্বিত তৃণমূল ও যুব উন্নয়ন সাপ্লাইলাইন প্রতিষ্ঠা করা। ডেনমার্ক ও ভিয়েতনামের মতো সফল মডেল অনুসরণ করে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিভা বিকাশে বিনিয়োগ করা।

ফিফা বিশ্ব র‍্যাঙ্কিং এখন ইলো রেটিং সিস্টেম ভিত্তিক সাম মডেল ব্যবহার করে, যা ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট থেকে চালু হয়েছে। এই পদ্ধতিটি সময়কালের ভিত্তিতে পয়েন্টের গড় করার পরিবর্তে প্রতিটি ম্যাচের পর সরাসরি পয়েন্ট যোগ বা বিয়োগ করে। এই পদ্ধতির প্রযুক্তিগত দিকটি ভালোভাবে বুঝে সেই অনুযায়ী জাতীয় দলের ম্যাচ শিডিউল তৈরি করা অপরিহার্য।

ভারতীয় ফুটবলকে ২০৪৭ সালের মধ্যে এশিয়ান পাওয়ার হাউসে পরিণত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যে একটি ত্রি-স্তরীয় লিগ পিরামিড তৈরি করা,প্রতিটি টপ-ডিভিশন ক্লাবে যুব দল রাখা এবং মহিলাদের ফুটবলের জন্য একটি সুসংগঠিত লিগ ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদে, ২০৪৭ সালের মধ্যে ৩০টি ফিফা স্ট্যান্ডার্ড স্টেডিয়াম এবং ২০টি ক্লাবের একটি শীর্ষ-বিভাগ লিগ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।
এই কাঠামোগত পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা হলো জাতীয় দলের পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার অভাব এবং কোচিং স্তরে অস্থিরতা। গত দুই বছরে জাতীয় দলে তিনবার কোচ পরিবর্তন হয়েছে। ইগর স্টিম্যাকের পর ম্যানোলো মার্কেজ এবং বর্তমানে ভারতীয় কোচ খালিদ জামিল। ঘন ঘন কোচ পরিবর্তন একটি সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদী ফুটবল দর্শনের ব্যাঘাত ঘটায়।

পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে, ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট-এর অধীনে স্টেডিয়াম এবং ক্রীড়া কমপ্লেক্সের জন্য সরকারি অর্থায়ন এবং ২১% বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ার দরকার।

ভারতীয় ফুটবলের ফিফা র‍্যাঙ্কিং-য়ে স্থায়ী এবং ধারাবাহিক উন্নতির জন্য একটি অগ্রাধিকার ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা জরুরী হয়ে পড়েছে। যা কৌশলগত দিক এবং কাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দেয় ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ ক্যালেন্ডার উইন্ডোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে দুর্বল কিন্তু এশিয়ার বাইরের দলগুলির সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করা, যাতে পয়েন্ট প্রাপ্তি অপটিমাইজ করা যায়। বিশ্বকাপ বা এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ারের মতো উচ্চ গুরুত্বের ম্যাচগুলিতে জয় নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ সম্পদ এবং প্রস্তুতি ব্যয় করা।

পিআইও/ওসিআই ব্যবহারে ভারতীয় বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের,যাদের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ রয়েছে–তাদের দ্রুত নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত করে তাৎক্ষণিক মানের উন্নতি ঘটানো।
২০২৫-২৬ সিজন থেকে প্রমোশন/রেলিগেশন চালু করার সময় ক্লাবগুলির আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি শক্তিশালী ‘সলিডারিটি পেমেন্ট’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যাতে রেলিগেটেড ক্লাবগুলি দেউলিয়া না হয়।
ক্লাব লাইসেন্সিং-এর একটি বাধ্যতামূলক অংশ হিসেবে খেলোয়াড়দের শারীরিক ফিটনেসের লক্ষ্যে স্পোর্টস সাইন্স ব্যবহারের জন্য কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করা।

আইএসএল স্টার্টিং একাদশে বিদেশী খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমিয়ে আনা, যাতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে স্বদেশে খেলার সুযোগ পেয়ে আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।

উন্নত দেশের মতো মডেল অনুসরণ করে যুব একাডেমির মানোন্নয়নে স্টার-বেসড রেটিং এবং এআইএফএফ অ্যাকাডেমি অ্যাক্রেডিটেশন নিয়মের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা, যাতে তৃণমূল স্তরে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায় এবং খেলার সংখ্যা বাড়ে।

জাতীয় ফুটবল দর্শনেই ভিশন ২০৪৭-এর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সাফল্য আসবে।