প্রশ্ন: আইএসএল ও আইলিগের উন্নতি ও ঘাটতি কতটা হলো?
রক্তিম: আইএসএল ও আই লিগের গঠন ও পরিচালন পদ্ধতির ফাঁরাক আছে। দুটো টুর্নামেন্ট, এই মুহূর্তে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সংকটময় বাণিজ্যিক মোড়ের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। গত এক দশকে (২০১৪-২০২৫) আইএসএল-এর বাণিজ্যিক উন্নতি যেমন হয়েছে, তেমনই এর মূলে বড়সড় ঘাটতিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আইএসএলের বাণিজ্যিক উন্নতি বলতে, তার ব্র্যান্ড এবং দৃশ্যমানতায় আবদ্ধ আছে। আইএসএল ভারতীয় ফুটবলকে একটি চকচকে, পেশাদার রূপ দিয়েছে। পেশাদার খেলোয়াড়দের আগমনে এটি ঘরোয়া ফুটবলের দৃশ্যমানতা প্রাথমিকভাবে বহুগুণ বাড়িয়ে নিতে সফল হয়েছে।
লিগ একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় রাজস্ব পুল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। পাশাপাশি স্পনসরশিপ ও বিনিয়োগে আইএসএল ভারতের প্রথম সারির করপোরেট সংস্থাগুলিকে, যেমন জেএসডব্লু, রিলায়েন্স, ইমামি,আরপিজি ইত্যাদি— ফুটবলে বিনিয়োগ করতে তাদের আকৃষ্ট করেছে। দলগুলির মোট বাজার মূল্য বর্তমানে প্রায় ৩৭৯ কোটি টাকা।
ক্লাবগুলি কেন্দ্রীয় রাজস্ব পুল থেকে একটি অংশ পেত। গত মরসুমে এই আয়ের পরিমাণ প্রায় ১৬ কোটি টাকা ছিল, যা ক্লাবগুলির পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
প্রশ্ন: তথাপি আইএসএলের বাণিজ্যিক ঘাটতি ও বর্তমান সংকট, তার ব্যবসায়িক মডেলই সম্প্রতি জনসমক্ষে প্রশ্ন তুলে দিল না?
রক্তিম: আইএসএল টুর্নামেন্টের সামগ্রিক উন্নতির বিচার এবং তার বাণিজ্যকরণের সফলতার তুল্যমুল্য আলোচনায় সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই তোলা যায়। সবচেয়ে বড় সংকট, এফএসডিএল-এর সঙ্গে ১৫ বছরের চুক্তি এই বছরের ডিসেম্বরে শেষ হচ্ছে। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন লিগ চালানোর জন্য নতুন বাণিজ্যিক অংশীদার খুঁজতে যে টেন্ডার ডেকেছিল, তাতে একটিও সংস্থা বিড জমা দেয়নি। কেন এই ব্যর্থতা? কারণ, অবাস্তব আর্থিক দাবি। এআইএফএফ টেন্ডারে বার্ষিক ন্যূনতম ৩৭.৫ কোটি টাকা গ্যারান্টি দাবি করেছিল। নতুন কোনও সংস্থার পক্ষে এই লিগ চালাতে গেলে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোকসান হতো। এআইএফএফ সমস্ত আর্থিক ঝুঁকি অংশীদারের ওপর চাপিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে চেয়েছিল, যা বাণিজ্যিকভাবে সম্পূর্ণ অচল বলে বিবেচিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: আইএসএলের প্রায় কোনও ক্লাবই লাভজনক নয়। বেশিরভাগ ক্লাবই মালিকদের ভর্তুকির উপর নির্ভর করে চলে। খেলোয়াড়দের চড়া বেতন, পরিকাঠামো খরচ এবং বার্ষিক ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি হিসেবে ১২-১৬ কোটি টাকা দেওয়ার পর ক্লাবগুলির পক্ষে লাভ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তৃতীয়ত: আইএসএল “চকচকে” হলেও এর ভিত্তি “শক্তিশালী” ছিল না। এটি একটি “ক্লোজড সার্কিট” লিগ হয়ে থেকেছে, যা প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে কিন্তু ক্লাবগুলির জন্য স্ব-নির্ভর আয়ের পথ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সহজ কথায়, আইএসএল একটি ভালো ‘পণ্য’ তৈরি করতে সফল হলেও, একটি লাভজনক ‘ব্যবসা’ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। গত দশ বছরে যে উন্নতি দেখা গেছে, তা মূলত বাণিজ্যিক অংশীদার এফএসডিএল এবং ক্লাব মালিকদের বিপুল পরিমাণ লোকসানের বিনিময়ে এসেছে।অনুমান করা হয়, গত দশকে মোট লোকসান ৫,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বর্তমানে, নতুন বাণিজ্যিক অংশীদার না পাওয়ায় লিগের ২০২৫-২৬ মরসুম শুরু হওয়াই বড়সড় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এটিই আইএসএলের বাণিজ্যিক মডেলের সবচেয়ে বড় ঘাটতি।
প্রশ্ন: ক্লাবের আর্থিক অবস্থা ও সম্প্রচার স্বত্বের আয় ভারসাম্য থাকছে না,তবে বিকল্প কি হতে পারে?
রক্তিম: ক্লাবগুলির বেশিরভাগই এখনও পর্যন্ত লাভজনক নয়।তারা মালিকের ভর্তুকি-নির্ভর।ফুটবল বা লিগ থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে তাদের বিপুল খরচ মেটানো সম্ভব হয় না।
যেমন, বার্ষিক ফ্র্যাঞ্চাইজি বাবদ দেও টাকা, খেলোয়াড়দের উচ্চ বেতন, স্টেডিয়াম, ভ্রমণ, প্রশিক্ষণ পরিকাঠামো বাবদ বিপুল খরচ হয়।
কিন্তু কেন্দ্রীয় রাজস্ব পুল থেকে যে আয় আসে, তাতে এই বিপুল খরচের সঙ মিল থাকছেনা।এখন এই বিষয়গুলোই নতুনভাবে ভাবতে হবে।
অতীতে জামশেদপুর এফসির মতো কিছু ক্লাব ব্যতিক্রমীভাবে সামান্য লাভ দেখিয়েছে, কিন্তু সেটা খুবই বিরল। বেশিরভাগ বড় ক্লাব, যেমন মোহনবাগান, বিপুল রাজস্ব আয় করা সত্ত্বেও লোকসানের মুখ দেখেছে। লিগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হতেই তাই ক্লাবগুলি তাদের বাজেট কমাতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক ক্লাব খেলোয়াড়দের বেতন কমানো বা দলবদলের বাজারে খরচ কমানোর মতো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে।
আইএসএলের সম্প্রচার স্বত্ব থেকে প্রচুর আয় হলেও, পুরো লিগটি চালানোর খরচ এত বেশি ছিল যে তা কোনোভাবেই লাভজনক মডেলে দাঁড়াতে পারেনি। এফএসডিএল গত দশ বছর ধরে এই লোকসান বহন করে আসছিল। এখন নতুন কোনো সংস্থা সেই লোকসানের দায়িত্ব নিতে রাজি নয়, আর এটাই আইএসএলের বাণিজ্যিক ঘাটতির মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন: ব্যবসায় যেখানে ঘাটতি, লিগের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ল না?
রক্তিম: না, ঠিক তাই নয়। একটা পথ চলা হলো এবং তার ফলাফল জানা গেল। এখন নতুন চিন্তাভাবনা আনতে হবে।গ্রাসরুট ফুটবলে উন্নতি, ছোট ছোট পুলে খেলোয়াড়দের দলবদলের সুযোগ দেওয়া,আরো ভালো বিদেশি আনা, নিরপেক্ষ রেফারিং ব্যবস্থা, রেফারির সিদ্ধান্ত গ্রহনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, ফ্যান বেসদের ক্লাব ও লিগের সঙ্গে যুক্ত করা ইত্যাদি। বিশেষতঃ ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ও মহামেডানের মত সমর্থক ভিত্তিক ক্লাব এখন আইএসএলে আছে।
এছাড়া কেরল ও কর্ণাটক, নর্থইস্টে আইএসএলের প্রচুর সমর্থক আছে। খেলার মজা বাড়িয়ে ডিজিটাল মিডিয়ার আকর্ষন বাড়ানোর ভাবনা চাই। ম্যাচ ডে’র হাইপ বাড়তে, ক্লাবগুলোর দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করতে হবে।রাজ্য ভিত্তিক সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনাকে এর সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হবে। লোকাল ফুটবল নিয়ামক সংস্হাকে আরো সক্রিয় অংশগ্রহনের সুযোগ দিতে হবে। মোদ্দাকথা যৌথ উদ্দ্যেগ চাই। পারস্পরিক উৎসাহ বাড়ানোর পথ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশে প্রচুর ট্যালেন্ট যেমন আছে,তেমন প্রচুর শক্তিশালী কর্পোরেট সংস্হা আছে। সরকারের আর্থিক ও প্রশাসনিক সমর্থন দরকার। কিন্তু অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যেন না থাকে। এবং অবশ্যই আন্তজার্তিক ফুটবলে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করতেই হবে। এএফসির মতো টুর্ণামেন্টকে হেলাফেলা ভাবে অংশগ্রহন নয়। শক্তিশালী দলগঠন করে সেই টুর্নামেন্ট অংশগ্রহন নিশ্চিত করতেই হবে। ভারতীয় ফুটবলকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এএফসি’র টুর্নামেন্টকে হাতিয়ার করতে হবে। চারিদিকে আমাদের সম্ভাবনা আছে। এই সম্ভবনাময় দিকগুলো যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে ব্যবহার করাটাই আশু কাজ। ভারতীয় ফুটবলে হতাশার জায়গা নেই। ঘুম ভাঙাতে হবে।