বেটন কাপের সেই জলুস হারিয়ে গেছে

প্রতীকী চিত্র

প্রবীর মজুমদার

কলকাতার হকির একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ভারতের প্রাচীনতম কলকাতার হকি লিগ ও বেটন কাপ-এর মতো ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্ট। ১৯০৮ সালে গঠিত ভারতের প্রথম হকি অ্যাসোসিয়েশন ছিল বেঙ্গল হকি অ্যাসোসিয়েশন। ১৯৪০ এবং ১৯৫০-এর দশকে কলকাতায় কলকাতা কাস্টমস এবং পোর্ট কমিশনার এবং খড়গপুরে বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে শক্তিশালী দল ছিল। ১৯৫২ সালে এই শহরে অনুষ্ঠিত জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলা সেরা হয়।

সম্প্রতি, কলকাতায় একটি নতুন আন্তর্জাতিক মানের হকি স্টেডিয়াম উদ্বোধন করা হয়েছে এবং ‘বেঙ্গল টাইগার্স’-এর মতো পেশাদার দল হকি ইন্ডিয়া লিগে অংশ নেয় এবং তারা বর্তমান চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু আক্ষেপ ছিল যে এই শহরে অর্থাৎ কলকাতায় আন্তর্জাতিক মানের কোনও হকি স্টেডিয়াম ছিল না। দীর্ঘ অপেক্ষার পর কলকাতা পেল আন্তর্জাতিক মানের অতি আধুনিক হকি স্টেডিয়াম। বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে বিবেকানন্দ যুবভারতী হকি স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ধনধান্য স্টেডিয়ামে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনের মাঝেই উদ্বোধন হল এই স্টেডিয়ামের। ২২ হাজার দর্শক একসঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারবেন এই স্টেডিয়ামে। বানাতে খরচ হয়েছে ২০ কোটি টাকা। নবনির্মিত স্টেডিয়ামে রয়েছে সিন্থেটিক টার্ফ, ওয়ার্মআপ জোন, অস্ট্রেলিয়ার মতো আর্দার্ন গ্যালারি, একটি ভিভিআইপি বক্স, দুটি সুসজ্জিত ড্রেসিং রুম, ভিআইপি বক্স, ভিআইপি লাউঞ্জ ও আম্পায়ার রুম। এর আগে এই বছরের গোড়াতেই হাওড়ার ডুমুরজলার খেল নগরীতে চালু হয়েছিল রাজ্যের নিজস্ব প্রথম সিন্থেটিক টার্ফের মাঠ। এই দুই মাঠেই অনুষ্ঠিত হলো ১২৬তম বেটন কাপ প্রতিযোগিতা।


একটা সময় কলকাতার হকি মাঠ প্রচুর দর্শককে টানত. মোহনবাগান, ইস্ট বেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিং , কাস্টমস, সিইএসসি , ইস্টার্ন রেল ও বিএনআর -এর মতন দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জমে উঠতো লিগ। বেটন কাপে খেলতে আসত সারা ভারতের সেরা দলগুলি। স্থানীয় দলগুলির সঙ্গে তাদের লড়াই দারুন জমে উঠত।এই কলকাতা থেকে উঠে এসেছেন অনেক তারকা হকি খেলোয়াড়। কিংবদন্তি লেসলি ক্লডিয়াস, কেশব দত্ত গুরবক্স সিং, ভেস পেস, রবার্ট ক্লডিয়াস এবং বলজিৎ সাইনি ভারতের হয়ে খেলেছেন এবং দেশের হয়ে এশিয়ান কাপ থেকে অলিম্পিক গেমসে অনেক খেতাব জিতেছেন।

নব্বইয়ের দশক থেকে কলকাতার বড় ক্লাবগুলি তাদের হকি দল তুলে দিল। অন্ধকার নেমে এলো কলকাতার হকিতে। কলকাতার হকিকে বাঁচাতে তখন প্রয়োজন ছিল আধুনিক সুবিধাযুক্ত হকি মাঠ। কিন্তু দীর্ঘ বাম শাসনে সেই আশা পূরণ হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে হল বাংলার হকির স্বপ্ন পূরণ। এদিকে অ্যাস্ট্রোটার্ফ তৈরির সুনিশ্চিত আশ্বাস মিলতেই হকি দল গড়ে দুই দশক পরে কলকাতা লিগে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় মোহনবাগান, ইস্ট বেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিং ।

১৯৬০-৭০এর দশকে হকির বড় ম্যাচে ৩০ হাজার লোকও দেখা গিয়েছে। গত বছরের বেটন কাপ ফাইনালে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৫০। এই বছরের বেটন কাপ ফাইনাল সেই তুলনায় আশার আলো দেখিয়েছে। দর্শক আসন ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।

কলকাতার দুই প্রধান খেলোয়াড় না পাবার কারণ দেখিয়ে অংশ নেয়নি। স্থানীয় দলগুলির মধ্যে দুই রেল দল, কলকাতা লিগের বিভিন্ন দলের খেলোয়াড় নিয়ে গড়া সম্মিলিত বাংলা একাদশ প্রাথমিক পর্যায়ে খেললেও মূল পর্যায়ে উঠতে পারেনি।

আরও হতাশাজনক ভূমিকা ছিল মুদ্রণ এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমের। বিশ্বের প্রাচীনতম হকি প্রতিযোগিতা তার উপযুক্ত গুরুত্ব পায়নি বেশিরভাগ সংবাদপত্রেই। এমনও দেখা গেলো ফাইনালের খবর তিন-চার লাইনে শেষ করেছে কোনও কোনও সংবাদপত্র। কয়েক বছর আগেও ফাইনাল ম্যাচ সরাসরি দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হতো। এবার হকি প্রেমিকরা এর সম্প্রচার দেখেছে একটি অ্যাপ ভিত্তিক চ্যানেলে।

বাংলার হকির প্রচারে হকির রাজ্য সংস্থা -হকি বেঙ্গল, কলকাতা হকি লিগ এবং বেটন কাপের মতো ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, বেঙ্গল টাইগার্স-এর মতো পেশাদার দলগুলো হকি ইন্ডিয়া লিগে খেলে রাজ্যকে প্রতিনিধিত্ব করছে। হকির প্রচারের জন্য টুর্নামেন্ট আয়োজন, প্রতিভার বিকাশ এবং খেলোয়াড়দের জন্য প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা এই সংস্থাগুলোর প্রধান কাজ। বাংলার হকির পুনর্জাগরণের জন্য সব পক্ষ এগিয়ে আসুক, এই আশাই করবো। বেটন কাপ হকির যে ঐতিহ্য তা দেখতে পাওয়া গেল না।

বেঙ্গল হকি সংস্থার কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে কোনও হস্তক্ষেপ করবেন কীনা জানা নেই। এক কথায় বলা যায় বেটন কাপের জলুস হারিয়ে গেছে।