আইএফএ শিল্ড সেই ঐতিহ্যের পতাকা এখন বহন করে না

প্রতীকী চিত্র

রণজিৎ দাস

১৮৯৩ সালে যার পথচলা শুরু আইএফএ শিল্ডের। ১৯১১ সালে ব্রিটিশদের হারিয়ে মোহনবাগান সেই শিরোপা জয় যা পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটিয়েছিল। সেই আইএফএ শিল্ড আজ এক করুণ বাস্তবতার শিকার। বিশ্বের চতুর্থ প্রাচীনতম এই ফুটবল প্রতিযোগিতা এখন তার অতীতের গৌরব ও মর্যাদার ছায়ামাত্র। ঘনঘন থমকে যাওয়া। প্রধান দলগুলির অনীহা। এবং এর পরিবর্তে জুনিয়র বা রিজার্ভ দল খেলানোর প্রবণতা। এই ঐতিহ্যশালী টুর্নামেন্টকে নামমাত্র ‘পাড়ার টুর্নামেন্ট’-এর সঙ্গে তুলনা করলে কোনও ভুল হবে না।

আইএফএ শিল্ড শুধু একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট নয়। এটি বাংলার, তথা ভারতের ফুটবল ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। শতবর্ষের বেশি পুরোনো এই প্রতিযোগিতাকে যখন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরের কোনও ক্লাবই আর গুরুত্ব দিতে চাইছে না, তখন এই টুর্নামেন্টের আয়োজক আইএফএ এবং অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলির দায়বদ্ধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।


বর্তমানে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) এবং আই-লিগ-এর মতো টুর্নামেন্টগুলির ব্যস্ত সূচির কারণে অধিকাংশ বড় ক্লাবই আইএফএ শিল্ডে তাদের মূল সিনিয়র দলকে খেলাতে এতদিন আগ্রহী ছিল না।
তারা হয় অনূর্ধ্ব-১৯ বা রিজার্ভ দল নামায়, যা টুর্নামেন্টের মান ও আকর্ষণকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়। এর ফলে, একসময় যেখানে বিশ্বের সেরা বিদেশি ক্লাবগুলিও খেলতে আসত, সেখানে এখন এই প্রতিযোগিতা কার্যত ডেভেলপমেন্টাল টুর্নামেন্ট-এর চেহারা নিয়েছে।

টুর্নামেন্টের ইতিহাসে বারবার বিরতি এসেছে। কখনও সূচির জটিলতা, আবার কখনও ক্লাবগুলির অংশগ্রহণের অনিশ্চয়তার কারণে আইএফএ শিল্ড বন্ধ থাকছে। যেমন, মাঝে ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এটি অনুষ্ঠিত হয়নি, আবার সম্প্রতি ফিরে আসার উদ্যোগেও বড় দলগুলোর অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। একটি ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টের এমন ধারাবাহিক অনিশ্চয়তা তার মর্যাদাকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে।
ভারতের ফুটবল ক্যালেন্ডারে আইএফএ শিল্ড তার সঠিক স্থানটি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি এখন কার্যত একটি, যখন সময় পাওয়া যায়, তখন আয়োজিত হওয়া টুর্নামেন্ট হতে চলেছে। যা এটিকে ডুরান্ড কাপ বা ফেডারেশন কাপ-এর মতো মর্যাদার জায়গা থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

২৫ অক্টোবর থেকে সুপার কাপ শুরু হবে।সুপার কাপের আগে আইএফএ শিল্ডের প্রতি সকলের নজর আছে। কিন্তু কলকাতার দলগুলো থেকেই স্বদিচ্ছার অভাব দেখা দিল।ফলে ৬দলের টুর্নামেন্ট করতে গিয়েও আইএফএ’র নাভিশ্বাস উঠেছে।

আইএফএ-কে ফুটবলের বাণিজ্যিকীকরণের স্রোতে গা ভাসিয়ে ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেওয়া উচিত নয়। আইএফএ শিল্ডকে নামমাত্র ‘পাড়ার টুর্নামেন্ট’ পর্যায়ে নামিয়ে আনা, শতবর্ষের এই ফুটবল-গৌরবকে অসম্মান করার শামিল।

একাধিক মূল দলের অনুপস্থিতি মানেই মাঠে দর্শকের কম ভিড়। যখন সমর্থকরা তাদের প্রিয় তারকাদের দেখতে পায় না, তখন খেলার প্রতি তাদের আবেগ ও আগ্রহ কমে যায়।

এর ফলস্বরূপ, স্পনসর বা প্রচারের অভাব দেখা দেয়। যা আর্থিক দিক থেকেও টুর্নামেন্টকে দুর্বল করে তুলবে। অথচ ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কলকাতা লিগ জয় করেছে। তাদের সদস্যদের মধ্যে টিমকে নিয়ে ভালো ফলের আশা জেগেছে।

মোহনবাগান ক্লাব এএফপি চ্যাম্পিয়ান লিগ-২ না খেলায়,ঘরে ও বাইরে চাপের মধ্যে আছে। তাদের দলের প্রতি সদস্যদের অনীহা একসময় বিপরীত প্রতিক্রিয়া দিতে পারে। আইএফএ শিল্ডের মতো ঐতিহাসিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিং-এর মতো ক্লাবগুলির উত্থানের গল্প। এই টুর্নামেন্টকে তার গুরুত্ব থেকে সরিয়ে দিলে, নতুন প্রজন্মের কাছে এই গৌরবময় ইতিহাস পৌঁছানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়।

সমালোচকদের মতে, আইএফএ-র পক্ষ থেকে এই প্রতিযোগিতার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য দীর্ঘমেয়াদী এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। ক্লাবগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে এটিকে আইএসএল বা আই-লিগের আগে বা পরে এমনভাবে সাজানো যেত। যাতে মূল দলগুলি অংশ নিতে পারে।

শিল্ডের ঐতিহ্যকে বাঁচানোর জন্য আইএফএ-কে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। হয় এটিকে ফুটবলের মূল সূচিতে ফিরিয়ে আনা হোক, যাতে আইএসএল দলগুলি খেলার জন্য বাধ্য হয় অথবা এটিকে সিনিয়র ক্লাব টুর্নামেন্ট হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করা হোক। অন্যথায়, যে শিল্ড একদিন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক ছিল, সেই শিল্ডই ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের করুণ সমাপ্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
এই ঐতিহ্য রক্ষা কি কেবলই আইএফএ-র দায়িত্ব, নাকি বড় ক্লাবগুলিরও উচিত তাদের ব্যস্ত সূচির মাঝেও এই ইতিহাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা?

ব্যর্থতার দায় কাদের বইতে হয়,আগামীদিনে এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে।