রেফারিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন ক্রীড়ামন্ত্রী

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

আইএফ-র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস রেফারিদের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। ইতিপূর্বে বয়সভিত্তিক লিগের চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে রেফারি ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। যাকে বলা হয়, ‘রেফারি ম্যানেজ’ ছিল। রেফারিং নিয়ে বিতর্ক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রথাগত কলঙ্কে পরিণত হয়েছে । এই কলঙ্ক মুছে ফেলার ক্ষেত্রে ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা, সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন এবং আই এফ এ- র ব্যর্থতা স্বাভাবিকভাবেই চিহ্নিত হয়।

ক্লাবকর্তাদের ক্রমবর্ধমান দাপট এবং প্রভাব, নিয়ামক সংস্থাগুলির কাঠামোগত দুর্বলতা এবং এই দুই শক্তির মোকাবিলায় রেফারিদের ব্যক্তিগত দৃঢ়তার প্রকৃত চ্যালেঞ্জ। রেফারিদের ওপর চাপ এখন কেবল স্থানীয় প্রভাবশালীদের থেকে আসে না, বরং এটি ক্রমবর্ধমান বিশ্বব্যাপী ম্যাচ ফিক্সিং সিন্ডিকেটের অর্থনৈতিক চাপের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে ।

কলকাতা ফুটবলে দুর্নীতির প্রকৃতি স্থানীয় ক্ষমতাকেন্দ্রিক কাঠামো থেকে বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়ে বিদেশি বিনিয়োগ-যুক্ত সংগঠিত অপরাধে রূপান্তরিত হয়েছে। যদিও প্রাঞ্জল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো রেফারিরা আন্তর্জাতিক স্তরে দক্ষতা অর্জন করছেন, স্থানীয় মঞ্চে কার্যকর নজরদারি, প্রযুক্তির অভাব এবং রেফারিদের দুর্বল সুরক্ষা ব্যবস্থা এই কলঙ্ককে জিইয়ে রেখেছে। ফেডারেশনের সর্বস্তরের বর্তমান কাঠামো, এই আধুনিক এবং সংগঠিত দুর্নীতির মোকাবিলায় সম্পূর্ণ অপ্রতুল।


কলকাতা ডার্বি, যেখানে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল মুখোমুখি হয়,সেখানে বাঙালি সমাজের বিদ্যমান ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক বিভাজনের একটি তীব্র ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ঘটি এবং বাঙাল গোষ্ঠীর মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজনের উপর ভিত্তি করে তৈরি এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা রেফারিদের ওপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করে । এই সাংস্কৃতিক বিভাজন এতই তীব্র আবেগ চাপ সৃষ্টি করে যে, খেলার নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ময়দানে ঐতিহাসিকভাবে কঠিন হয়ে ওঠে। ক্লাবকর্তাদের দাপট এবং সমর্থকদের আবেগ ও চাহিদা মেটানো–এমন এক সংস্কৃতিকে স্বাভাবিক করেছে। যেখানে রেফারির পক্ষপাতিত্ব বা বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে ডার্বি রাজনীতির অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই সংস্কৃতিই পরবর্তীতে সংগঠিত দুর্নীতির ভিত্তি তৈরি করেছে।

অতীতে, ‘রেফারি ম্যানেজ’ করার প্রক্রিয়াটি ছিল প্রধানত স্থানীয় প্রভাবশালী ক্লাবকর্তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতেই ।কিছু পুরনো ঘটনায় রেফারিদের নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ধারণায় নিয়ে সন্দেহের পরিবেশকে শক্তিশালী করে। তীব্র স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা রেফারিদের ওপর মানসিক চাপের জন্ম দেয়, যা অবশেষে পক্ষপাতিত্বের সংস্কৃতিকে স্থায়ী করে। প্রশাসনিক সংস্থাগুলির দীর্ঘদিনের দুর্বলতা এবং নীরবতা এই রেফারি ম্যানেজ করার সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সাহায্য করেছে।

প্রাঞ্জল বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার একজন অত্যন্ত উচ্চমানের রেফারি, যিনি বহু ডার্বি পরিচালনার পাশাপাশি ফিফার তালিকায় স্থান পেয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে (যেমন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ পরিচালনা) সাফল্য অর্জন করেছেন।
তাঁর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সত্ত্বেও, কলকাতা ফুটবলের তথাকথিত বদনাম নিতে হয়। স্থানীয় প্রভাব থেকে বিশ্বব্যাপী সিন্ডিকেট সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কলকাতা ফুটবলে দুর্নীতির মাত্রা ও প্রকৃতিতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। ‘ম্যানেজ রেফারি’র ধারণা এখন কেবল স্থানীয় ক্লাবকর্তাদের প্রভাব খাটিয়ে একটি বিতর্কিত পেনাল্টি আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি কোটি কোটি টাকার আন্তর্জাতিক বেটিং চক্রের একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ হয়ে উঠেছে। প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ ফিক্সিং ঘটনায় রেফারিং সমাজের জড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। তাদের সংগঠিত আর্থিক কারচুপির একটি হাতিয়ার করার চেষ্টা হতেই পারে।

রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এই বিতর্কের মধ্যেই কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “যে রেফারি ম্যানেজ করবে, যে দল জড়িত থাকবে, সবার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে”।

হোসে মোরিনহো তুরস্কের ক্লাব ফেনেরবাচের কোচ থাকাকালীন বারবার রেফারিদের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এবং দেশের ফুটবলের “বিষাক্ত পরিবেশ” নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,”এই লিগে “সিস্টেমের” বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, শুধুমাত্র প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নয়। ২৫ বছরের কোচিং জীবনে তিনি এমন কিছু দেখেননি।

মোরিনহোর এই অভিযোগগুলোর সত্যতা পরে তুরস্কের ফুটবল সংস্থা কর্তৃক একটি তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসে। তদন্তে জানা যায় যে তুরস্কের ৩৭১ জন রেফারি জুয়ার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। এর মধ্যে ১৫২ জন রেফারি সরাসরি এবং নিয়মিতভাবে বাজি ধরতেন।