না খেলার প্রবণতায় মোহনবাগানের গরিমা হ্রাস

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ফের এএফসি প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ায় বিতর্কের ঝড় উঠেছে। গতবছর ইরানের ট্র্যাক্টর এফসির পর এবার ইরানের সেপাহান এসসি’র বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে গেল না। পরপর দু’বছর মোহনবাগানের ইরান সফরে গেল না। তার ফলস্বরূপ এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২ থেকে বাদ পড়া, ক্লাবের ভাবমূর্তি এবং ভারতীয় ফুটবলের আন্তর্জাতিক মঞ্চে অংশগ্রহণের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এর থেকেও বড় প্রশ্ন, ক্লাবের এই সিদ্ধান্ত কি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া ‘এশিয়া সেরা দল’ হওয়ার বার্তার প্রতি সরাসরি অসম্মান?

গত বছর আইএসএল জয়ের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোহনবাগান দলকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং আশা প্রকাশ করেছিলেন যে ক্লাবটি এশিয়ার সেরা দলগুলোকে হারিয়ে এশিয়া সেরা দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করবে। মুখ্যমন্ত্রীর সেই বার্তা ছিল রাজ্যের ফুটবলের প্রতি তাঁর আশার প্রতিফলন।

অথচ, ক্লাবের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ মুখ্যমন্ত্রীর সেই স্বপ্নের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরছে। পরপর দু’বার—২০২৪ এবং ২০২৫ সালে নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে মোহনবাগান ইরানের মাটিতে খেলতে যেতে অস্বীকার করেছে। এই সিদ্ধান্তকে এএফসি প্রতিযোগিতা থেকে নাম প্রত্যাহার বলে গণ্য করেছে এবং মোহনবাগানকে চলতি মরশুমের এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।


মোহনবাগান কর্তৃপক্ষ তাদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে খেলোয়াড় ও কর্মীদের নিরাপত্তা ও সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার যুক্তি দিয়েছে। বিশেষত, ছয়জন বিদেশি খেলোয়াড় তাদের নিজ নিজ দেশের ভ্রমণ নির্দেশিকার কারণে ইরানে যেতে রাজি না হওয়ায় ক্লাব এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। মোহনবাগান নিরপেক্ষ মাঠে ম্যাচটি খেলার জন্য এএফসি-কে অনুরোধ করেছিল, যা নাকচ হয়। এই বিষয়ে সমাধানের জন্য মোহনবাগান কোর্ট অফ আরবিট্রেশন ফর স্পোর্টস-এর দ্বারস্থ হয়।

নিরাপত্তার ঝুঁকি কি সত্যিই এত গুরুতর? অন্যান্য পশ্চিম এশীয় ক্লাব যেমন—ইউএই বা বাহরিনের দলগুলো ইরানে এএফসি ম্যাচ খেলেছে, এমনকি মুম্বই সিটি এফসি-ও এর আগে ইরানে খেলতে গিয়েছিল।

পরপর দু’বছর নাম প্রত্যাহার ও এটি কি শুধুমাত্র নিরাপত্তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতার অভাব?
মোহনবাগানের এই সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে ভারতীয় কোনও ক্লাবের এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২-এ সরাসরি গ্রুপ স্টেজে খেলার সুযোগ হারানো সহ আরও কঠোর শাস্তির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া মহাদেশীয় ক্লাব টুর্নামেন্টের পরিপ্রেক্ষিতে এএফসির ভারতীয় ফুটবলের মানকে যে পয়েন্ট দেয়, তা আর দেবে না।

এর ফলে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন সহ দেশের বিভিন্ন ক্লাবের ক্ষতিই হবে। এই প্রেক্ষাপটে, মুখ্যমন্ত্রীর এশিয়া সেরা দল হওয়ার বার্তাটিকে ক্লাবের পক্ষ থেকে হালকাভাবে নেওয়া হয়েছে বলেই রাজনৈতিক এবং ক্রীড়ামহলে গুঞ্জন চলছে। এটিকে অনেকে শুধুমাত্র খেলার মঞ্চে ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে, মুখ্যমন্ত্রীর প্রকাশ করা আশার প্রতি প্রকাশ্য অসম্মান হিসেবে দেখছেন। বারবার একই কারণে পিছু হটা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, যা পশ্চিমবঙ্গের ফুটবলপ্রেমীদের কাছেও হতাশার বার্তা দিয়েছে।

ক্লাবের এই ‘পিছু হটা’ শুধুমাত্র ক্রীড়াসূচির ব্যর্থতা নয়, বরং রাজ্যের ফুটবলের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি একটি বড় আঘাত। যা মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া উৎসাহকে কার্যত ম্লান করে দিয়েছে। এই বিষয়ে ক্লাবের ভবিষ্যৎ অবস্থান ও এএফসি-র চূড়ান্ত শাস্তির দিকেই এখন সকলের নজর।
এই নাম প্রত্যাহারের বিষয়টি সদস্য সমর্থকদের মধ্যেও বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। প্রথমত এবারের মরশুমের শুরুতেই প্রতিপক্ষ ইস্টবেঙ্গলের কাছে দু-দু’বার হারতে হয়েছে।কলকাতা লিগ ও ডুরান্ড ডার্বিতে কেবল হার নয়। এই দুটো টুর্নামেন্টের একটিও মোহনবাগান ক্লাব জিততে পারেনি। এদিকে এএফসির চ্যাম্পিয়ান লিগ-২ এর প্রথম ম্যাচে তুর্কমিনিস্তানের এক সাধারণ দলের বিরুদ্ধেও ঘরের মাঠে দল জয় তুলে নিতে পারেনি।

ফলে সামগ্রিকভাবে ক্লাবের বর্তমান পারফরম্যান্সের প্রতি সদস্য-সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। গত মরশুমে ঘরোয়া আইএসএল ট্রফি ও কাপ জয়ের পর,সদস্য ও সমর্থকদের মধ্যে এশিয়া স্তরে ক্লাবের ভালো পারফরম্যান্সের আশা ছিল। মহাদেশীয় ক্লাব টুর্নামেন্ট থেকে মোহনবাগান ক্লাবের নাম প্রত্যাহার, বাংলার ফুটবল মহল ভালো দৃষ্টিভঙ্গিতে নিচ্ছে না। কলকাতা লিগের খেলাতেও তারা সহজে বিপক্ষকে ওয়াকওভার দিয়ে দেয়। ম্যাচ থেকে সরে যাওয়ার রোগ যেন চেপে বসেছে। এমন সন্ধিক্ষণে যদি কোর্ট অফ আরবিট্রেশনে মোহনবাগানের নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ম্যাচ খেলার যুক্তি মান্যতা না পায়, ক্লাবের অভ্যন্তরের রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে।

এশিয়ার ক্লাব ফুটবলে মোহানবাগান ক্লাবের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর আশার বার্তা নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি শুরু হতেই পারে‌। এরসঙ্গে সদস্য সমর্থকদের ক্ষোভ যুক্ত হলে তার মাত্রা নিয়ে উদ্বেগ আছে। এদিকে মোহনবাগান এএফসির প্রতিযোগিতায় খেললো না। সঞ্জীব গোয়েঙ্কা ও মোহনবাগান নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে।