রণজিৎ দাস
আইএফএ শিল্ড চলাকালীন মোহনবাগান সুপার জায়ান্টস সমর্থকদের ‘শিরদাঁড়া বিক্রি নেই’ স্লোগান, এবারের আইএফএ শিল্ডকে ভিন্নমাত্রা দিল। ঘটনাক্রমে আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান পরস্পরের মুখোমুখি হতে চলেছে। বাংলার ফুটবলকে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান কেবল সমৃদ্ধ করেনি,তারাই ভারতীয় ফুটবলের চালিকাশক্তি হিসেবে একসময় গন্য হয়ে এসেছে। ভারতীয় ফুটবলে জাতীয় লিগ,পরবর্তী সময়ে যা আইলিগের পরিচিতি পেয়েছে— সেখানে এই দুই বড়দল নিজেদের আধিপত্য একসময়ে খুইয়ে ফেলেছিল। দেশের সর্বোচ্চ লিগ হিসেবে আইএসএল স্বীকৃতি পেতেই— এই দুই প্রধান আইএসএলে খেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্ত এর প্রেক্ষাপটেও ক্লাবকর্তাদের প্রতি সমর্থকদের আন্দোলনের চাপ ছিল।কারন, আইএসএল ও এটিকে’র কর্পোরেট চাকচিক্যে দুই বড় ক্লাবই তাদের অস্তিত্ব নিয়ে টানাপোড়েনে পড়ে যান। সমর্থকরা তাদের ক্লাবের ঐতিহ্যের ও গরিমায় কোথাও অংশগ্রহণে তারা পিছিয়ে পড়ছেন বলে মনে করতে শুরু করেন। দীর্ঘদিন ধরে ক্লাব প্রশাসনে থেকে যাওয়া অফিসিয়ালদের উদাসীন আচরন, একনায়কতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ বলে সমর্থকরা মনে করতেন। শুরু হলো আন্দোলন।মাঠেই টিফোর মাধ্যমে বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু হয়। দেশের সর্বোচ্চ লিগে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান অংশগ্রহণ করে।
কর্পোরেট সত্তা ক্লাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশীদারিত্ব গ্রহন করে নেয়। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের নামের আগে বা পরে বিনিয়োগকারীর নাম যুক্ত হয়ে গেছে। কর্পোরেট সংস্হা ক্লাবের ‘ফুটবল দল’-কে নিয়েই কেবল পরিকল্পনা করে থাকেন। কিন্তু সমর্থকদের কাছে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান কেবল ‘ফুটবল দল’ নয়। দুটি ক্লাবের সাথেই শতবর্ষের আবেগ, ঐতিহ্য এবং সামাজিক পরিচয় জড়িয়ে আছে। ক্লাবের জার্সির রং থেকে ক্লাবের লোগো— সবই সমর্থকরা তাদের একান্ত নিজেদের বলে মনে করেন।বলা যায়,যা তাদের নিজস্ব কন্ঠস্বর।
স্বাভাবিকভাবেই, একদিকে স্বকীয়তা ও ঐতিহাসিক অধিকার এবং অপরদিকে পেশাদারিত্ব ও কঠোরতা— এর অভ্যন্তরেই দ্ধন্ধ লুকিয়ে আছে। ১৯১১সালের আইএফএ শিল্ড জয়ে জাতীয়তাবাদী বিজয়ের প্রতীক সবুজ-মেরুনের সমর্থক কিংবা দেশভাগ ও উদ্বাস্তুদের অব্যক্ত যন্ত্রনার মাঝে ১৯৭৫-এর আইএফএ শিল্ড জয়ের প্রতীক লাল-হলুদের সমর্থকদের মধ্যে পরিচিতি রক্ষার লড়াইয়ে প্রভেদ নেই। ঐতিহ্যের প্রতি রক্ষনশীল হলেও আধুনিক ফুটবলের কর্পোরেট কাঠামোর সঙ্গে নিজেদের ক্লাবকে টিকিয়ে রাখতে আপষ নিশ্চয়ই করতে হয়েছে।কিন্তু পারস্পরিক সংঘাত কি তাতে মিটেছে?
মোহনবাগান ক্লাবের সমর্থকদের আন্দোলন উড়িয়ে দেওয়ার নয়। জাতীয়তাবাদী বিজয়ের প্রতীক যারা বহন করে, তারা প্রতিকূলতার মধ্যে এএফসি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিংবা পেশাদারিত্বের প্রয়োজনেই, কলকাতা লিগে মোহনবাগান সুপার জায়েন্ট তার রির্জাভ টিমকে ‘ম্যাচ টাইম’ দিতে খেলিয়েছে। কিন্তু চির প্রতিদ্ধন্ধী ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কাছে কলকাতা লিগে হারাটা সমর্থকরা পেশাদারিত্বের আড়ালে কিভাবে চেপে রাখবেন?
এমন আবহেই, ১৯৭৫সালের আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে ঐতিহাসিক ৫-০ ফলাফলের ৫০বছর পূর্তি হতে চলেছে। ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান ক্লাবের ঐতিহাসিক সেই ম্যাচের সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ন বদলে গেছে। কিন্তু ক্লাবের ঐতিহ্য ধরে রাখার আবেগের বদল হয়নি। ৭০দশকের ‘বিশুদ্ধ’ ফুটবল প্রেম ও বর্তমান ‘সোশ্যাল মিডিয়ার বানিজ্যকরণের প্রভাবে’র ফুটবল প্রেমের মধ্যে আমূল বদল ঘটে গেছে। আইএফএ ও রাজ্য প্রশাসনও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। মোহনবাগান সমর্থকদের উপর পুলিশের লাঠির আঘাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
এদিকে সবুজ মেরুন সমর্থকদের উদ্দেশ্যে কোচ হোসে মোলিনা বলেছেন, আমাদের পাশে থাকুন এবং ভালো খেলা উপহার দেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করুন।