প্রবীর মজুমদার
হকিতে ভারতের একছত্র দাপটের দিন অতীত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশ উন্নতি করছে। অনেক নতুন দেশ খেলছে। হকিতে বিভিন্ন দেশের (বিশেষত ইউরোপের) উন্নতি ভারতের সোনালি যুগের অবসান ঘটিয়েছে আগেই। ১৯৮০ সালের পর কখনও অলিম্পিক্সের সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি ভারতীয় দল। অথচ ১৯২৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত টানা ছ’বার সোনা জিতেছিল ভারত। ১৯৭২ পর্যন্ত সব অলিম্পিক্সে পদক জিতেছে।
অলিম্পিক্সে পদক আসেনি মানে ভারতে বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরি হয়নি, তা নয়। জাফর ইকবাল, পারগত সিংহ, ধনরাজ পিল্লাই, ভরত ছেত্রী, দিলীপ তিরকে, যুগরাজ সিংহ— একের পর এক বিশ্বমানের খেলোয়াড় উঠে এসেছেন। তবু পরবর্তী সময় বিশ্বমানের দল হয়ে উঠতে পারেনি ভারত। ঘাসের মাঠ থেকে টার্ফে হকি খেলা শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমশ পিছিয়ে গিয়েছে ভারতীয় হকি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ভারতীয় হকির আত্মবিশ্বাস তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল একটা সময়। সেই ভারতই গত ছ-সাত বছর ধরে উন্নতি করতে করতে বিশ্বের প্রথম সারিতে উঠে এসেছে।
২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক্সে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি ভারত। চার বছর পর লন্ডন অলিম্পিক্সে পেয়েছিল সবার শেষ দ্বাদশ স্থান। এর পরই টনক নড়ে ভারতের হকি কর্তাদের। কঠিন সময় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক। লন্ডনের ব্যর্থতার পর ঢেলে সাজানো হয় ভারতীয় হকির পরিকাঠামো। নতুন খেলোয়াড় তুলে আনার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই প্রচেষ্টাতেই চার দশকের পদক খরা কাটিয়ে পরপর দুটি অলিম্পিকে পুরুষ হকিতে ব্রোঞ্জ পদক পায় ভারত।
বিশ্ব হকির ক্রমতালিকা শুরু হওয়ার পর থেকে একটা সময় পর্যন্ত প্রথম ১০ দলের মধ্যে জায়গা হত না ভারতের। কখনও কখনও প্রথম ১৫ দলের মধ্যেও জায়গা হত না। আর গত পাঁচ বছরে ভারতীয় দল কখনও ক্রমতালিকায় প্রথম ১০-এর বাইরে যায়নি। আজ ভারতের পুরুষ হকি দল বিশ্ব ক্রম তালিকায় ৭ নম্বরে আছে।
টোটাল ফুটবলের মতো ভারতীয় দলে অধিনায়ক হরমনপ্রীত টোটাল হকি নিয়ে এসেছেন। তাতেই বদলেছে, ক্রমাগত বদলাচ্ছে ভারতীয় হকির চেহারা। বদলের অন্যতম রূপকার হিসাবে অধিনায়ক হরমনপ্রীতকে মনে রাখবেন হকিপ্রেমীরা।
সম্প্রতি বিহারের রাজগীরে অনুষ্ঠিত হলো পুরুষদের এশিয়া কাপ হকি প্রতিযোগিতা। এবারের বিজয়ী দল সরাসরি সুযোগ পাবে বিশ্বকাপ হকিতে খেলবার। লক্ষ্যটা ছিল এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়নের ট্রফির সঙ্গে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করার। সেই লক্ষ্যে সফল তারা। ভারতীয় হকির হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনছে সাম্প্রতিক সময়ের ভারতীয় হকি দল। পর পর দুই বছর অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতে সেই দিকে বড় ইঙ্গিত আগেই দিয়ে রেখেছে ভারত। সঙ্গে এবার যোগ হল এশিয়া কাপও। অতীতে তিনবার এই এশিয়া কাপ জিতলেও দীর্ঘদিন এই ট্রফির স্বাদ পায়নি ভারত। শেষ পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়াকে ফাইনালে হারিয়ে সেই লক্ষ্যে পৌঁছে গেল ভারতীয় হকি।
হকি এশিয়া কাপে পুরুষরা জিতলেও হতাশ করল মেয়েরা। চিনের বিরুদ্ধে ফাইনালে খেলতে নেমে ৪-১ গোলের বড় ব্যবধানে হারল ভারত। বিশ্ব ক্রম তালিকায় চিন ৪ নম্বরে এবং ভারত ১০ নম্বরে। চিনের গঙ্গশু ক্যানাল স্পোর্টস পার্ক স্টেডিয়ামে খেলতে নেমে রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হলো টিম ইন্ডিয়াকে। এই হারের ফলে ভারত আগামী বছর হকি বিশ্বকাপে সরাসরি প্রবেশ করতে পারল না।
চিনের গোংশু ক্যানাল স্পোর্টস পার্ক স্টেডিয়ামের ফাইনালে প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিল ভারত। প্রথম মিনিটে পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করেন নভনীত। ধারাবাহিকভাবে পেনাল্টি কর্নার পেয়ে গোলের সুযোগ এসেছিল। কিন্তু সেটা কাজে লাগাতে পারেনি ভারত। বরং ২০ মিনিটের মাথায় সেই পেনাল্টি কর্নার থেকেই সমতা ফেরান চিনের ওউ জিক্সিয়া। প্রথমার্ধে খেলার ফলাফল ছিল ১-১।
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে কার্যত আত্মসমর্পণ করে ভারত। লি হং দূরপাল্লার শটে এগিয়ে দেওয়ার পর কার্যত গোলের দরজা খুলে যায়। তৃতীয় কোয়ার্টারে চিনের হয়ে তৃতীয় গোল করেন জৌ মেইরং। আর শেষ কোয়ার্টারে গোল করেন ঝং জিয়াকি। ভারতের গোলকিপার বিচু একাধিক সেভ করেও দলের পতন রোধ করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ৪-১ গোলে জেতে চিন। এটা তাদের তৃতীয় এশিয়া কাপ জয়। অন্যদিকে ফাইনালে হেরে যাওয়ায় সরাসরি হকি বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করা হল না ভারতের মেয়েদের। গত বছর এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে চিনকেই ১-০ হারিয়ে জিতেছিল ভারতীয় মহিলা হকি দল। পেনাল্টি কর্নার থেকে ম্যাচের একমাত্র গোলটি ছিল দীপিকার।
২০২১ এর টোকিও অলিম্পিক ছিল মহিলা হকি দলের কাছে এক স্বপ্নের উড়ান। সেবার অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে অলিম্পিকের ইতিহাসে দল প্রথম সেমি ফাইনালে ওঠে। প্রথমদিকে পরপর হারের পরও এইভাবে সেমিফাইনালে পৌঁছে যাওয়া কোনও রূপকথার চেয়ে কম নয়।
তাই শুধু হতাশা নয় . ভারতের মহিলা হকি দলের সামনে পড়ে আছে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি।