ফুটবল মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

রণজিৎ দাস

গুরপ্রীত সিং, রাহুল ভিকে, আনোয়ার আলি, সন্দেশ ঝিংগান, এঁরা সকলেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গতকাল মাঠে ছিল। ভারতীয় দল বাংলাদেশের কাছে হেরেছে। আইএসএলের অনিশ্চয়তায় এরা সকলেই কিন্তু যৌথ বিবৃতি দিয়ে তাদের ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। যে ফুটবলাররা বাংলাদেশের মত টিমের বিরুদ্ধে দেশের জয় এনে দিতে পারে না— তাদের ভারতীয় ফুটবলের অনিশ্চয়তা নিয়ে আর্তনাদের মানে থাকে?

এশিয়ান কাপের মূলপর্বে থেকে গত ম্যাচেই ভারত ছাঁটাই হয়ে গেছে। এখন নিয়মরক্ষার ম্যাচেও রাহুল ভিকে ও সন্দেশ ঝিংগানরা জয় তুলে আনতে পারছেন না।প্রচন্ড ডামাডোল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ফুটবলাররা আনোয়ারদের কানমলা দিয়ে দিল।


এশিয়ান কাপের মূলপর্বে যাওয়ার জন্য এটা ভারতীয় দলের দ্ধিতীয় পর্যায়ের সুযোগ পাওয়ার খেলা চলছে।পরের বছর মার্চ মাসে ভারতীয় দল ঘরের মাঠে হংকংয়ের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচ খেলবে।

অবাক হতে হয় অবিবেচকের সিদ্ধান্ত নিয়ে। ২০২৬ বিশ্বকাপ ও ২০২৭ এশিয়ান কাপের যোগ্যতা পর্বের খেলা একই গ্রুপ বিন্যাসে শুরু হয়েছিল।ভারতীয় দল দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে খেলা শুরু করে। পরের রাউন্ডে যাওয়ার জন্য ভারতীয় দলের যুবভারতী স্টেডিয়ামে কুয়েতের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ খেলা ছিল। ম্যাচটায় ভারতীয় দলকে জিততেই হতো। নচেৎ গ্রুপ পর্যায়ের দ্ধিতীয় রাউন্ড থেকে ছিটকে যাওয়ার সমূহ সম্ভবনা তৈরি হবে। ম্যাচটা ভারতীয় দল সুনীল ছেত্রীর অবসরের ম্যাচ হিসেবে ফোকাস করলো। ইগর স্টিম্যাকের মত বিদেশি কোচ গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটার ফোকাস নাড়িয়ে দিতে সহযোগিতা করলেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জয়ের বদলে আমরা ব্যক্তিগত ভাবনায় মেতে রইলাম। ম্যাচটা ড্র করে ভারতীয় দল বিশ্বকাপের যোগ্যতাপর্ব ও এশিয়ান কাপের মূলপর্ব থেকে ছিটকে যায়। এরপর আমরা এশিয়ান কাপের মূলপর্বে যাওয়ার দ্ধিতীয় সুযোগ পাই। এখন সেই পর্যায়ের খেলা চলছে। আমরা কোন প্রকারের আহাম্মকের দলে পড়ি।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ জয়ের বদলে, আমরা সুনীল ছেত্রীর অবসরের ম্যাচকে রঙিন করায় মেতে উঠতে পারলাম। আমরা আহাম্মক নই?

এখন কিসের আর্তনাদ। খেলোয়াড়রা আইএসএলে তাদের যোগ্যতা থেকে বেশি টাকা পায় কিনা এবং তা থেকে তারা বঞ্চিত হওয়াতে আর্তনাদ, এমনটা নাইবা হতে পারে! কিন্তু ক্লাবগুলো এই আর্তনাদে সামিল হচ্ছে কেন? ইমামি বা সুপার জায়ান্ট (সঞ্জীব গোয়েঙ্কা) ছাড়া ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের অস্তিত্ব আছে?মহামেডান স্পোটিং ক্লাবের অবস্থা কেমন চলছে। ওড়িশা এফসি ও হায়দরাবাদ এফসির পরিনতি কেমন? চার্চিল ব্রার্দাসকে আইএসএলে খেলার সুযোগ দিলে কেমন হতো? জেসডব্লিউ’র বেঙ্গালুরু এফসি ও টাটা কোম্পানির জামশেদপুর এফসি ‘ইচ্ছে থাকলে’ যা পারে বাংলার তিন প্রধান তা পারবে?

আইএসএল ও আইলিগের টিমগুলো আলাদা আলাদা কর্মসূচি নিয়ে চলছে কেন? এই তো সময়— ভারতীয় ফুটবলের লিগ কাঠামোকে, এই সুযোগে বদলে দিতে হবে। আইএসএল ও আইলিগের মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক। ক্লাবগুলোর স্ট্যাটাসের উপর ভিত্তি করেই যেকোন লিগকে যাচাই চলে। এখানে ক্লাব চালাতে মুখ্যমন্ত্রীকে বিনিয়োগকারী এনে দিতে হয়। তাতেও কি শান্তি আছে?ক্লাবগুলোর এত আর্থিক অনটন—তবুও আইএসএল নিয়ে এত আর্তনাদ কেন?

ভারতীয় ফুটবল ইকোসিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত শত শত খেলোয়াড়, কোচ এবং সহায়ক কর্মীদের জীবিকার উপর সরাসরি আঘাত হেনেছে,বাস্তব– তবে,এখন আর্তনাদ নয়,সিদ্ধান্ত নেওয়াতে জোটবদ্ধ হওয়ার সময় উপস্থিত।
আমরা খেলতে চাই, এবং এখনই— এত তাড়াহুড়ো কেন? খেলোয়াড়দের চুক্তির নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠছে। অনিবার্য পরিস্থিতির ধারা প্রয়োগ হতে পারে।

বিদেশি ফুটবলারদের চুক্তি নিয়ে ভারতীয় ফুটবলের পেশাদারিত্ব এবং স্থায়িত্ব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বাজারে মারাত্মক নেতিবাচক বার্তা যাবে? সমগ্র প্রক্রিয়াতেই কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে— এটাও বাস্তব। এআইএফএফ’র অভ্যন্তরীণে এই অচলাবস্থা নিরসনে ব্যর্থ হয়েছে। সংকটটি এখন জাতীয় নীতিনির্ধারক ও বিচার বিভাগীয় স্তরে স্থানান্তরিত হয়েছে। এবং ক্রীড়া মন্ত্রকের প্রবেশ করেছে। কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী পরিস্থিতি সমাধানে সহায়তা করার জন্য তিনি স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া ‘সাই’ কে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিযুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এখন দেশের সামগ্রিক লিগ ইকোসিস্টেমের স্থায়িত্ব নিয়ে আলোচনার সময়। এটা আর্তনাদের সময় নয়। তাড়াহুড়োয় লিগ শেষ করা যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী চলার পথে সমাধান চাই।

যেহেতু ফেডারেশন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ব্যর্থ হয়েছে তাই বিড ইভ্যালিউশন কমিটি-র চেয়ারপারসন বিচারপতি (অব.) এল. নাগেশ্বর রাও এই ব্যর্থতার রিপোর্টটি সুপ্রিম কোর্টে জমা দিয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক অনুমোদিত নতুন ফেডারেশন প্রেক্ষাপটে, আদালত এখন ফেডারেশনকে নির্দেশ দিতে পারে যে তারা কীভাবে লিগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। এর অর্থ হলো, ফেডারেশন এখন হয় সংশোধিত বাজার-বান্ধব শর্তাবলী সহ একটি নতুন আর এফ পি জারি করতে হবে, অথবা লিগ শুরু করার জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন স্টপ-গ্যাপ ব্যবস্থা খুঁজতে হবে।

ভারতীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরের বাণিজ্যিক ভাগ্য এখন প্রশাসনিক দূরদর্শিতা এবং বিচারিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাদম্বিনী’-কে মনে নেই? দাহ করার সময় কাদম্বিনী চিৎকার করে বলে ওঠে, সে মরে নাই এবং জীবিত প্রমাণ করতে সে পুকুরে ঝাঁপ দেয়।