[ভবানীপুর ক্লাব ও পিয়ারলেস ক্লাব প্রতিবছর ভালো দল গড়ে কলকাতা ফুটবল লিগে প্রিমিয়ার লিগ খেলে। এবারও তারা ভালো দল গড়েছিল। শাহিদ রমন ও হেমন্ত ডোরা এই দুই দলের কোচ ছিলেন। দু’বছর টানা দুজনে একই দলের কোচ আছেন। প্রিমিয়ার লিগের খেলা নিয়ে সরাসরি কথা বললেন রণজিৎ দাসের আলাপচারিতায়।]
প্রশ্ন: গ্রুপ বিন্যাস নির্ধারণে লটারি পদ্ধতি কী সঠিক ছিল?
হেমন্ত: এই বিষয়টা আমি খুব গুরুত্ব দিচ্ছি না। চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে তোমাকে শক্ত ম্যাচ জিততেই হবে। ম্যাচ জেতাটাই যেখানে প্রধান, লটারি সেখানে দ্বিতীয় স্থানে থাকুক। ক্ষতি নেই। তবে, যে কোনো বিষয়ে স্বচ্ছতা থাকা দরকার।
শাহিদ: সাধারণতঃ একটা বড় পরিষ্কার কাঁচের পাত্রে সব টিমকে রেখে, সেখান থেকে টিম তুলে নেওয়া হয়। সব পরিষ্কার তুমি দেখতে পাবে। যে কোনো গ্রুপবিন্যাসের খেলায় এমন লটারি হলে, এমনভাবেই হয়। লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছে। সবাই দেখেছে, কিভাবে লটারি হয়েছে। তোমার বা আমার কী করার আছে? যারা প্রতিযোগিতাটা চালাচ্ছে, তারা ঠিক করবে— কোনটা ঠিক হচ্ছে।
প্রশ্ন: গ্রুপ স্টেজের খেলা শেষ হলো। প্রতিযোগিতার মান কেমন ছিল?
হেমন্ত: এবার লিগটা সঠিক সময়ে শেষ হচ্ছে। এটাই গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়। প্রতিযোগিতার মান তখনই বাড়বে, যখন লিগে কোয়ালিটির ফুটবলাররা খেলবেন। ইস্টবেঙ্গল যেমন আইএসএলের ফুটবলারদের খেলাচ্ছে। বড় দলগুলো এমন দল নামালে, তাদের বিরুদ্ধে ছোট দলগুলোর খেলার প্রতি আলাদা মোটিভেশন থাকবে। আমাদের লিগ কখনো দীর্ঘসময়ের ছিলনা। তবে, এই ৩১ আগস্টের মধ্যে খেলা শেষ করে দিতে হবে। কিংবা বাংলার ফুটবলারদের কোটা করে প্রতিযোগিতার মান বাড়ানো যাবে না।
শাহিদ: প্রতিযোগিতা ভালোই ছিল। অনেক ভালো ভালো টিম ছিল। আরো ভালো হবে, যদি দলে বেশি বেশি করে ভালো ভালো ফুটবলার থাকবে। তবে ভালো কম্পিটিশন আছে, এটা বলতে পারি। কম্পিটিশন যখন আছে, তখন মানটা খারাপ নেই।
প্রশ্ন: ৩১ আগস্টের মধ্যে খেলা শেষ করে দেওয়া ও ভূমিপুত্র খেলানোর কোটা সিস্টেমে লিগের জৌলুস কি হারাচ্ছে না?
হেমন্ত: আমি বিশ্বাস করি, গ্রাসরুট ফুটবলের পাশাপাশি স্কুল ফুটবলের উন্নতি ঘটাতে হবে। তবেই বাংলার ফুটবলার উঠে আসবে। খেলোয়াড়দের নীচ থেকে খেলে খেলে উঠে আসতে হবে। একবারে কোটা করে টপ ডিভিশনে খেলালে হবে না। আমরা তো ব্যারটোদের মত বিদেশিদের বিরুদ্ধে খেলেই বড় হয়েছি। ৩১ আগস্টের পর ছেলেরা আইলিগ বা আইএসএলে খেলার সুযোগটা নিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে শেষ কয়েকটা ম্যাচে কিছু খেলোয়াড়ের খেলার প্রতি অনীহা দেখেছি। এতে টিমের বা লিগের কিছুটা ক্ষতি তো হচ্ছেই।
শাহিদ: খেলোয়াড়দের সঙ্গে চুক্তিটাই আসল। ৭ মাসের চুক্তি করলে, সে তো ৩ মাস পরে চলে যাবেনা। এখন ছেলেরা অনেক পেশাদার হয়ে গেছে। এই খেলাটাই তাদের রোজগারের পথ। সে তো চুপ করে বাড়ি বসে থাকবেনা। ৩১ আগস্টের পর খেলা না থাকলে ওরা কি করবে? অনেক ভালো ভালো বাংলার ফুটবলার আছেন। ওদের খুঁজে এনে তৈরি করতে হবে। একবারে প্রিমিয়ারে নামালে কি করে হবে? প্রিমিয়ার লিগ খুব টাফ কম্পিটিশন। স্টেপ বাই স্টেপ খেলোয়াড়দের খেলিয়ে তৈরি করতে হয়। বড় টিমে এসে বসে থাকলে কিছু লাভ হবে না।
প্রশ্ন: কলকাতার ঘেরা মাঠ থেকে জেলার মাঠে খেলা সরে যাওয়াতে ফুটবলের কতটা ক্ষতি হচ্ছে?
হেমন্ত: কলকাতার ঘেরা মাঠে খেলা হলে সহজে বড় দলের কর্তাদের নজরে আসা যায়। একজন ফুটবলারের একাধিক ম্যাচ দেখার সুযোগ কর্তাদের হয়। জেলার মাঠে গিয়ে বড়দলের কর্তারা ছোট দলের খেলা দেখবেনা। ফলে একজন উঠতি ফুটবলারকে বড়দলে নিয়ে খেলানোর আত্মবিশ্বাস কর্মকর্তাদের থাকছে না। জেলার মাঠে খেলা হোক অসুবিধা নেই। কিন্তু কিছু ম্যাচ ময়দানে রাখা ভালো।
শাহিদ: বারাকপুর, নৈহাটি মাঠ ভালো আছে। ভালো মাঠে ভালো খেলা হবে। তবে, ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান মাঠে খেলতে পারলে ভালো হয়। ওরা বড় ক্লাব আছে। ওদের মাঠে খেলতে পারলে ছেলেদের আলাদা ফিলিংস কাজ করে। ছেলেরা ভালো খেলার চেষ্টা করে। দূরে খেলা থাকলে জার্নি বেশি হয়। ছেলেদের খেলার এনার্জি নষ্ট হয়। কলকাতার জার্নির অনেক অপশন আছে। ছেলেরা অনেক সহজে যাতায়াত করতে পারে। তবে, একসঙ্গে যাতায়াত করতে পারলে, খেলার অনেক আগে থেকেই ম্যাচে ফোকাস রাখা যায়। সবকিছুরই পজিটিভ ও নেগেটিভ দিক আছে। ভালো পথটা বেছে নিতে হবে।
প্রশ্ন: একটা ভালো খেলায় রেফারির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবার রেফারিং কেমন হলো?
হেমন্ত: আমাকে এবার বড় টিমের বিরুদ্ধে খেলতে হয়নি। গতবার ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের বিরুদ্ধে আমাদের ন্যায্য পেনাল্টি দেওয়া হয়নি। এবার আমাকে খারাপ রেফারিং নিয়ে কোনও ম্যাচে বলতে হয়নি। সেরকম খারাপ লাগেনি, এটা বলতে পারি।
শাহিদ: আমাদের বিরুদ্ধে খুব খারাপ রেফারিং হয়েছে। জানি না, আমি কালো বলে রেফারিদের আমাকে পছন্দ নয় মনে হয়। পিয়ারলেসের বিরুদ্ধে যে রেফারি খেলালেন, উনি আমাদের বিরুদ্ধে ম্যাচ থাকলেই বাজে রেফারিং করেন। ওইদিন মাঠে আমাদের বিরুদ্ধে সব সিদ্ধান্ত দিয়ে গেলেন। ওটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ছিল। আমার প্লেয়ার গোলকিপারকে একা পেয়ে যাচ্ছে, স্টপার ফাউল করে আমাদের প্লেয়ারকে আটকাচ্ছে। প্লেয়ারকে কার্ড দেখাল না। কার্ড দেখালে তাকে রেডকার্ড দেখাতে হবে। পিয়ারলেসের ওই ম্যাচটা জিতলে আমরা চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে পারি। এমন রেফারিং হলে খেলার ক্ষতি হবে।
প্রশ্ন: বাংলা গতবারের সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন দল। এবার নতুন কোনো বাংলার ছেলেদের আপনার চোখে পড়ল?
হেমন্ত: কোচেরা তাদের রণকৌশলে প্লেয়ার চয়েস করে। আমার রণকৌশলে যে প্লেয়ার গুরুত্বপূর্ণ, অন্য কোচের কাছে সে গুরুত্বপূর্ণ হবেই, তা বলা যায় না। যারা সন্তোষ ট্রফি জিতেছে, তাদের বিকল্পের নাম এভাবে বলা যায়না। তবে আমাদের টিমে অনেক বাংলার ছেলে ভালো খেলেছেন। মাঝমাঠে রাজ রাজবর খুব ভালো খেলেছে। প্রত্যেক টিমেই এমন ২/১ জন ভালো মানের ফুটবলার লিগে অনেক ম্যাচ খেলেছে।
শাহিদ: আমি সন্তোষ ট্রফির লেভেল জানি না। তবে কলকাতা লিগের কম্পিটিশন অনেক টাফ আছে। সন্তোষ ট্রফি যদি ওই লেভেলের হয়, তবে কলকাতা লিগের ছেলেরা কেন ভালো খেলতে পারবেন না? এতো টিম আছে, একটা টুর্নামেন্টের জন্য কেন তবে ভালো স্কোয়াড তৈরি করা যাবে না? আমি নাম বলতে পারবো না। তবে অনেক বাংলার ছেলে লিগে ভালো খেলেছেন।
প্রশ্ন: গ্রুপ স্টেজ থেকে সুপার সিক্সে আপনার টিম যেতে পারলো না। কোথায় ঘাটতি হয়ে গেল?
হেমন্ত: প্রথম দিকে কিছু ম্যাচ ড্র হয়ে গেল। শেষের দিকেও পরপর কয়েকটা ম্যাচ খারাপ গেল। উয়াড়ী ম্যাচ ড্র হলো। এরিয়ান ম্যাচ হারতে হলো। ছোটখাটো ভুলে টিমের ক্ষতি হয়ে গেলো। কিছু ছেলেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পাওয়া গেল না। কার্ড সমস্যা ও ছেলেদের চাকরির পরীক্ষা ছিল। কিছু বাইরের ছেলে ট্রান্সফার উইনডোতে মন দিল। শেষের দিকটা ভালো গেল না।
শাহিদ: এই ফলাফল আমি মানতে পারছি না। এত চান্স তৈরি করেছি, কিন্তু গোল করতে পারিনি। আবার, গোলকিপারকে এমন এমন মিস্টেক করতে দেখেছি— ভাবতে পারছি না। ডায়মন্ড হারবার ম্যাচ বা এরিয়ান ম্যাচ হারার কোনো ব্যাখ্যা আমার নেই। এইসব ম্যাচে সহজ গোল মিস করেছি। আবার খারাপ গোল খেয়েছি। টিম ভালো খেলেছে, কিন্তু যে রেজাল্টটা চেয়েছিলাম, তা পেলাম না।
প্রশ্ন: কলকাতা লিগের ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে অভিযোগ উঠছে। আপনার টিমের খেলায় এর প্রভাব পড়েছে?
হেমন্ত: অফিসিয়ালদের ব্যাপার এটা। কোচ ও প্লেয়ারদের ভূমিকা তারা দেখছেন। লুকোচুরির বিষয় নেই। জানাজানি হবেই। আজকে ছাড় পেলেও, আখেরে লাভ হয় না। তবে অর্থ লাভের স্বার্থ যেখানে জড়িত, এটা বন্ধ করা কঠিন। অ্যাপসে খেলা দেখাতে গিয়ে বিপত্তি বাড়ছে। প্রতিদিন বেটিং মার্কেট ফলো করলেই সব ধরা পড়ে যাবে। তবে, যারা ফুটবলকে ভালোবাসে, তারা ফুটবল কুলষিত হোক চাইবে না।
শাহিদ: আমার ছেলেদের আমি দোষ দেবো কি করে? এটা হওয়া উচিত নয়। অনেকেই এই কথাটা বললে, সিরিয়াসলি বিষয়টা দেখা উচিত। এটা ফুটবলকে ক্ষতি করবে। আমাদের সময় থেকে এখন বাংলার ফুটবলের মান অনেক পড়ে গেছে। এমন ঘটনা সত্যি হলে বাংলার ফুটবল আরো খারাপ হবে। লিগ শুরুর আগে সব টিমের কর্মকর্তা, খেলোয়াড় ও কোচেদের নিয়ে ক্লাস করা উচিত। এটা চলতে দিলে ফুটবলের ভালো হবে না।