রণজিৎ দাস
ভারতীয় দল কিংবা ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান ক্লাবের ফুটবল দলে এখন বাঙালি ফুটবলারকে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে।বাংলা দল এবার সন্তোষ ট্রফি জিতেছে। কিন্তু সন্তোষ ট্রফি জয়ী দলের ফুটবলারদের নিয়ে বড় দলে টানাটানি হলো না।বর্তমানে ডুরান্ড কাপের নকআউট পর্বে খেলার জন্যে কলকাতা লিগ ঝিমিয়ে পড়েছে। ডুরান্ড কাপ এখন ডার্বির উত্তাপ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের ঐতিহ্যের লড়াইয়ে তাই ডার্বি টিকিটের হাহাকার দেখতে পাওয়া গেল।বাঙালির ফুটবল মানেই ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের ডার্বি। এইতো কয়েকদিন আগে কলকাতা লিগের ডার্বি হয়ে গেছে। এবারে ডুরান্ড কাপের ডার্বি হয়ে গেল। দুটো ডার্বির প্রেক্ষাপট বলে দেয়,ঐতিহ্যের কলকাতা লিগ আজ কোন জায়গায় নেমে গেছে। ভারতীয় ফুটবলে আইএসএল রাজের দৌলতে বহু সর্বভারতীয় টুর্ণামেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে।তারমধ্যে ঐতিহ্যের ডুরান্ড কাপ মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে। ঘুরে দাঁড়াতে দিল্লির বদলে তারা বাংলা ও উত্তরপূর্বের অঞ্চলকে বেছে নিয়েছে। আর বাংলার ঐতিহ্যের কলকাতা লিগ ও আইএফএ শিল্ডের পরিনতি কি দাঁড়িয়েছে?
আইএসএল যেখানে তাদের বাণিজ্য ধরে রাখতে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। আইএফএ সেখানে বারে বারে মোহনবাগানের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ডুরান্ড কাপ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে,ভারতীয় ফুটবলের বাজার বলতে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানকে সঙ্গে নিয়ে চলা। ডুরান্ড কাপ তার ঝটিকা টুর্নামেন্টকে একমাসে করছে। কিন্তু লিগ ও নকআউটের সংমিশ্রণে তাকে আকর্ষণীয় করা গেছে?কলকাতা লিগকে ২মাসে দায়সারাভাবে করতে গিয়ে আইএফএ খেই হারিয়ে ফেলছে। বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে
আইএফএ’র বির্তক তৈরি হয়েছে। নিউ আলিপুর সুরুচি সংঘের পর মোহনবাগান ক্লাবের সঙ্গে ব্যবধান বাড়িয়ে তুলেছে। এদিকে ২৪ঘন্টার ব্যবধানে পিয়ারলেস ক্লাবের দুটো কঠিন ম্যাচ খেলতে গিয়ে তার সুপার সিক্সের লড়াই থেকে ছিটকে যাওয়ার মুখে। গত মরশুমে ডায়মন্ড হারবার ক্লাবের সঙ্গে মতবিরোধ আদালতে গড়িয়েছে।আইএফএ ও তার অধীনস্থ একাধিক ক্লাবের সঙ্গে এই দ্ধন্দ্ধের মাত্রা বেড়েই চলেছে।
গতবছরের ডুরান্ড ডার্বির কথা মনে করুন,নিরাপত্তার অভাবে সেদিন ডার্বি করা যায়নি। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে।মোহনবাগান সমর্থকের কাঁধে চেপে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের প্রতিবাদের ছবি ভাইরাল হয়েছিল। এবারের ১৭ আগষ্টের ডার্বি আরেক নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল। ডুরান্ড কাপ ও কলকাতা লিগ একসঙ্গে চলছে।কিন্তু ডুরান্ড কাপ যে ক্ষেত্র তৈরি করতে পারছে,তা আইএফএ করতে পারছে না।
দ্ধিতীয়তঃ ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের ডার্বি বাঙালির একান্ত সংস্কৃতির লড়াই হিসেবে খ্যাত। মাঠে ও মাঠের বাইরের লড়াইয়ে বাঙালি নেতৃত্ব দিয়েছে। মাঠের বাইরের নেতৃত্বে বাঙালি এখনও আছে। কিন্তু মাঠের ভিতর লড়াইয়ে বাঙালির নেতৃত্ব কোথায়? স্থানীয় লিগ থেকে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানে খেলার যোগ্যতা মানের ফুটবলার উঠে না আসার দায় কার? কলকাতা লিগের পরিকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্ব কারা আগলে রেখেছেন?
তৃতীয়তঃ ৮বছর পর বাংলা দল সিনিয়রদের সর্বভারতীয় ট্রফি জিতলো। সন্তোষ ট্রফি জয়ী বাংলা দলের ফুটবলারদের নিয়ে প্রচুর উন্মাদনা তৈরি হলো। রাজ্য সরকার ২২জন ফুটবলারকে চাকরি দিল। বাংলা দলের অধিনায়ক চাক্কু মান্ডি ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলার। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের মূল দলে সুযোগ পাওয়ার ধারেকাছে নেই।তাই,আইএফএ’র বোঝা উচিত, সন্তোষ ট্রফি জয়ের আত্মতুষ্টিতে থাকলে চলে না। কলকাতা লিগের প্রতিযোগিতার মান বাড়ানোর কথা ভাবতে হবে।কলকাতা লিগে ফুটবলাররা এক মরশুমে কিভাবে আরো বেশি সংখ্যায় ম্যাচ পায়,তার ভাবনা করতে হবে।একটা উদাহরন হাতের সামনে আছে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কলকাতা লিগের ফুটবলার বিক্রম প্রধান বাংলা সন্তোষ ট্রফি জয়ী দলের সদস্য।এবার কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে নিয়মিত সে লেফ্টব্যাকে খেলছে। বিক্রম প্রধানকে কোচ সঞ্জয় সেন তাঁর সন্তোষ জয়ী বাংলা দলে নিয়মিত রাইটব্যাকে খেলিয়েছেন। অর্থাৎ বিক্রম প্রধান সাইড ব্যাকের দু’টো পজিশনেই খেলতে পারেন। এই প্রতিভাবান ফুটবলাররা যথেষ্ট ম্যাচ না পেয়েই হারিয়ে যাচ্ছেন।
দুই মাসের কলকাতা লিগ ও দেড় মাসের বেঙ্গল লিগের সার্কাস ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদী একটাই লিগ করা প্রয়োজন।যেখানে থেকে ফুটবলাররা যথেষ্ট ম্যাচ খেলতে পারবেন।
দুটো আন্তজার্তিক টুর্নামেন্টের জন্য ভারতীয় সিনিয়র দল ও অনূর্ধ্ব-২৩ ভারতীয় দলের প্রস্ততিতে ফুটবলারদের নাম ঘোষনা হয়েছে। সিনিয়র দলে একমাত্র বাঙালি ফুটবলারের নাম রহিম আলি। সে কিন্তু বাংলার কোনও দল থেকে নির্বাচিত হয়নি। বাংলা থেকে ১১জন ফুটবলার সিনিয়র দলের প্রস্ততিতে ডাক পেয়েছেন।মোহনবাগান থেকে ৭জন,ইস্টবেঙ্গল থেকে ৩জন ও ডায়মন্ড হারবারের হয়ে আইলিগে খেলা ১জন ফুটবলার সে সুযোগ পেয়েছেন। অনূর্ধ্ব-২৩ ভারতীয় দলে বাংলা থেকে ৫জন ফুটবলার ডাক পেয়েছেন। তাতে ২জন বাংলার ফুটবলার। মোহনবাগান থেকে দীপেন্দু বিশ্বাস ও ইউনাইটেড স্পোর্টস থেকে সাহিল হরিজন সে সুযোগ পেয়েছে।
যার অর্থ এই দাঁড়ায়,ডার্বি নিয়ে হইচই আছে,কিন্তু খেলার মাঠে দূরবীন দিয়ে বাংলার ফুটবলার খুঁজতে হচ্ছে। বাংলার তাদের নিজস্বতার ডার্বি জিততে হচ্ছে বিদেশি ও ভিন্ন রাজ্যের ফুটবলারদের উপর নির্ভর করে।সেখানে কোনও বাংলার চরিত্র নেই। একসময় একাধিক বাঙালি ফুটবলার সারা ভারতবর্ষের অনুপ্রেরণার কাজ করতো। এখন সেই বাঙালিকে তার অস্বিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করতে হচ্ছে।