রাজনীতির আসল চাণক্য কে? শরদ পাওয়ার, না অমিত শাহ?

শরদ পাওয়ার (Photo: IANS)

মহারাষ্ট্রে বিজেপি’র ফড়নবীশ সরকার গঠনের পর সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন বর্ষীয়ান এবং পােড় খাওয়া রাজনীতিবিদ শরদ পাওয়ার। একদিকে তাঁর ভাগ্নে অজিত পাওয়ার এনসিপি’র পার্টি লাইনকে বুড়াে আঙুল দেখিয়ে চলে গেলেন বিজেপি ক্যাম্পে। শুধু তাই নয়, ফড়নবীশ মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পর অজিতেরও শপথ হয়ে গেল উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। তখন কিন্তু মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনের রূপরেখা চূড়ান্ত করতে বসেছিল শিবসেনা, কংগ্রেস ও এনসিপি।

চারদিকে প্রশ্ন উঠতে শুরু কাল তাহলে কি একদিকে শিবসেনা কংগ্রেসকে অন্ধকারে রেখে শরদ পাওয়ার নিজের খেলাটি খেলে দিলেন অজিত পাওয়ারের মাধ্যমে বিজেপির সরকার গঠন করে। এই প্রশ্ন আরও বেশি করে উঠতে শুরু করেছিল কারণ মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনের আগে শরদ পাওয়ার দেখা করতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদির সঙ্গে। সেই সাক্ষাৎকে ঘিরে জল্পনা আরও বেড়ে গেল যে তাহলে কি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতেই শরদ পাওয়ার রফার সূত্র চূড়ান্ত করে এলেন বিজেপির সঙ্গে।

শুধু এই নয়, বাজারে খবর উড়ল বিজেপির তরফে শরদ পাওয়ারকে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে যদি উনি মহারাষ্ট্রে বিজেপির সরকারকে সমর্থন করেন। আবার এর মধ্যেই রাজ্যসভার বিশেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করে বসলেন শরদ পাওয়ারের নেতৃত্বাধীন এনসিপি’র। এইসব ঘটনার জন্য শরদ পাওয়ারের বিজেপির সঙ্গে গােপন আঁতাতের গল্প ছড়িয়ে পড়ল দ্রুতগতিতে। এই সন্দেহ সত্য বলে মানতে শুরু করলেন মানুষ, যখন ২৩ নভেম্বর শরদের ভাগ্নে অজিত পাওয়ারের সাহায্যে মহারাষ্ট্রের মসনদে আসীন হলেন বিজেপির ফড়নবীশ।


২৩ তারিখের ঘটনার পর সবাই অপেক্ষা করেছিলেন শরদ পাওয়ার এই গােটা ঘটনাক্রম নিয়ে কী বলেন, তা শােনার জন্য দুপুরেই শরদ পাওয়ার শিবসেনা প্রমুখ উদ্ধব ঠাকরেকে নিয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন, যেখানে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সন্দেহ নিরসন করে বলেন যে, এনসিপি, কংগ্রেস এবং শিবসেনা একসঙ্গে আছে এবং থাকবে। অজিত পাওয়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি জানান, তিনি যে বিজেপিকে সমর্থন করেছে, সেটা সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে এনসিপি দলের কোনও সম্পর্ক নেই। এই অপকর্মের শাস্তি অজিতকে পেতে হবে। সেই সাংবাদিক সম্মেলনে উদ্ধব ঠাকরেও শরদ পাওয়ারের প্রতি তাঁর আস্থা জ্ঞাপন করেন।

শরদ সেদিন সাংবাদিক সম্মেলনে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, অজিত পাওয়ারের সঙ্গে মাত্র ১০/১১ জন বিধায়ক রয়েছে, কিন্তু পরমুহুর্তে তিনি জানিয়েছেন তারাও শীঘ্রই মুল এনসিপিতে ফিরে আসবেন। পরে দেখা গেল সত্যি সেই বিধায়কা শরদের কাছেই ফিরে এলেন। কারণ তাঁরা জানালেন যে ভুল বুঝিয়ে তাঁদের রাজভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন অজিত পাওয়ার। এর পরেই শরদ ঘােষণা করলেন অজিতের সঙ্গে তিনজন বিধায়ক ছাড়া আর কেউ নেই।

পরে দেখা গেল বিজেপি গুরুগ্রামে যে এনসিপি’র তিনজন বিধায়ককে নজরবন্দি করে রেখেছিল, তাঁরাও শরদের কাছেই ফিরে আসেন। পরের দিন শরদ পাওয়ারের নতুন রাজনৈতিক কৌশল দেখল সারা ভারতবর্ষ। তখনও কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের রায় আসেনি। আবার তখন দিল্লির একাধিক বিজেপি নেতা এবং মহারাষ্ট্রের গােটা বিজেপি ইউনিট বয়ানের পর বয়ান দিয়ে চলেছে যে বিধানসভায় তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করবে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টেও বিজেপির আইনজীবী সওয়াল করতে গিয়ে বিজেপির পক্ষে ১৭০ জন বিধায়কের সমর্থনের কথা জোর গলায় বলে চলেছে।

শরদের পরামর্শে সােমবার রাতে মুম্বইয়ের এক পাঁচতারা হােটেলে শিবসেনা-কংগ্রেস-এনসিপি’র ১৬২ জন বিধায়ককে হাজির করা হয় সংবাদ মাধ্যমের সামনে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শরদ পাওয়ার, শিবসেনা প্রমুখ উদ্ধব ঠাকরে, কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খাড়গে প্রমুখ। ১৬২ জন বিধায়কের সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তাঁরা মারাঠি অস্মিতার কথা তুলে ধরলেন, পাশাপাশি বিজেপির পিছনের দরজা থেকে ক্ষমতায় আসার জন্য সমালােচনা করলেন দিল্লির শাসকবর্গের।

পরের দিন সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায় ঘােষণা করে বলে দিল বুধবারই বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে হবে ফড়নবীশ সরকারকে। বিপাকে পড়ল বিজেপি কারণ এতক্ষণে জানা হয়ে গেছে বিজেপির কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। এরইমধ্যে অজিত পাওয়ারের মানভঞ্জন করার প্রয়াস জারি ছিল শরদ পাওয়ারের নির্দেশে। এরপর শরদ পাওয়ার সরাসরি কথা বলেন অজিত পাওয়ারের সঙ্গে। তারপরেই অজিত পাওয়ার উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বিজেপি বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে যাবে না।

মঙ্গলবার বেলা ৩.৩০ মিনিটে মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীশ সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সুপ্রিম কোর্টের রায় আসার পর দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি এবং অমিত শাহের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় যে ফড়নবীশ ইস্তফা দেবেন। সেই মতাে সাংবাদিক সম্মেলনের আগে ফড়নবীশের কাছে বার্তা যায় দিল্লির বিজেপি নেতৃত্বের এবং সাংবাদিক সম্মেলনেই তাঁর ইস্তফার কথা ঘােষণা করেন দেবেন্দ্র ফড়নবীশ, যিনি দ্বিতীয় দফায় মােট ৮০ ঘণ্টা মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন ছিলেন। অজিত পাওয়ারও ফিরে এলেন শরদ পাওয়ারের কাছে।

কর্নাটক ও গােয়ায় চাতুরির সঙ্গে বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ কংগ্রেস ও জনতা দল (এস)-এর বিধায়কদের দল ভাঙিয়ে নিয়ে এসেছিল বিজেপির দিকে, ফলে ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল বিজেপি। কিন্তু কর্নাটক ও গােয়ায় যে রাজনৈতিক কৌশল সফলভাবে প্রয়ােগ করতে পেরেছিলেন অমিত শাহ, সেটা মহারাষ্ট্রে চলতে দেননি ৮০ বছর বয়স্ক ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ শরদ পাওয়ার।

কর্নাটক ও গােয়ায় কংগ্রেসের কাছে কোনও শরদ পাওয়ার ছিলেন না কিন্তু মহারাষ্ট্রে সরাসরি আঘাত এসেছিল শরদ পাওয়ারের উপর যেটি তিনি প্রতিহত করেছেন চাণক্য কুটনীতির সুচতুর খেলায় অমিত শাহকে পরাজিত করে। কারণ তাঁর নাম যে শরদ পাওয়ার।