চায়না খাতুন
লাল রঙের ফ্রক জামা পরে তিন্নি ছুটছে জমির আঁকা-বাঁকা আলপথ ধরে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন রঙিন প্রজাপতি। তিন্নির বয়স বারো। উত্তরবিলের পশ্চিম মাঠে তার ভাই টুকাই গেছে পুকুর খনন করা দেখতে। বেলা বাড়ছে দেখে ভাইকে ডাকতে যাচ্ছে তিন্নি।
উত্তরবিল গ্রামের সারা মাঠে সবুজের মেলা। গাঁয়ের ঘর-দুয়োর রুক্ষ আর অগোছালো হলেও মাঠকে মাঠ সবুজে মোড়ানো। উত্তরবিলের পশ্চিম মাঠে পিচরাস্তার পাশেই আছে মুক্তোপুকুর। পুকুরের জল যেন শ্যাওলা সবুজ কাচের মতো। পুকুর ধারে খালি গায়ে বসে আছে টুকাই। জেসিবি দিয়ে মাটি কাটা দেখছে এক মনে।
মুক্তোপুকুরের পাশে খনন করা পুকুরের নাম নাকি হবে হীরেপুকুর। একই পরিবারে জ্ঞাতিভাইয়েরা একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এরকমই নাকি পুকুরের নাম দিয়েছে। জেসিবি দিয়ে মাটি খনন চলছে আজ প্রায় মাসখানেক হলো।
উত্তরবিলের ভূমিপ্রকৃতি এমনই যে এখানে দুই হাত মাটির পরেই দেখা যায় বোল্ডারের স্তর। তবুও এক অজানা রহস্যে দুই হাত মাটির ওপরে ছলকে ওঠে ফসলের হাসি। ঠিক যেন পাতালপুরীর জাদুঘর থেকে মায়াবী কাঠির স্পর্শ পেয়ে হীরের ফলক লাগানো আছে কাঁচা ফসলে।
ব্যবসায়িক কাজে এখান থেকে কঠিন বোল্ডারগুলো বাড়ি তৈরি ও রাস্তা তৈরির কাজে চলে যায় দূর দূরান্তে। মাটি মেশানো নরম মোরাম রাস্তা-ঘাট তৈরিতেও কাজ দেয়। জেসিবি দিয়ে মাটির স্তরটা কয়েকদিন আগেই কাটা হয়ে গেছে। এবার যতো গভীরে যাচ্ছে ততই লাল বোল্ডার, কালো বোল্ডার বেরিয়ে আসছে জেসিবির শুঁড়ওয়ালা মুখে।
টুকাই গুঁড়ো লাল মাটিগুলো নিয়ে আপন মনে খেলছে আর হাসছে। সকাল থেকেই বসে আছে দু’চোখ ভরা কৌতূহল আর জিজ্ঞাসা নিয়ে। এই বুঝি হীরেপুকুর থেকে মুঠো মুঠো হীরে বেরোয়! না তো, নতুন কিছু আবিষ্কার হবে তার সামনেই।
জেসিবির কামড়ে যেই না অনেককটা বোল্ডার তোলা হয়েছে অমনি টুকাই খিল খিল করে হেসে বললো— ওই রাক্ষস, তোর মুখে কতো বড়ো বড়ো হীরে রে? হি হি, হা হা, কী মজা!
ওর হাসি দেখে মেশিন চালানো ড্রাইভারটা অবাক হয়ে একবার তাকিয়ে আবার গর্তের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। কে দেখলো না দেখলো, তাতে টুকাইয়ের খেয়াল নেই। ওর মনের ইচ্ছে অতি আশ্চর্য রকম যতো সব পাথর দেখার।
বোল্ডার নয়, সবই হীরের পাথর। টুকাই কখনও দেখেনি হীরে দেখতে কেমন! মায়ের মুখে শুধু শুনেছে আলোয় পড়লে হীরেপাথর ঝিলমিলে কাঁচের মতো ঝলমল করে। বলেছে, জানিস খোকা আমাদের জমিতে সবুজ ফসলের মতোই ঠিক ছলকে ওঠে ঝলমলে হীরে।
মা তো বলেছে, কিন্তু সে তো সেরকম কিছুই দেখতে পাচ্ছে না এখনও! মা বোধহয় জানে না যে, হীরে মোরাম কাদায় মাখা থাকে প্রথমে। তারপর রোদে শুকিয়ে গেলে তার আলো ঠিকরে পড়বে টুকাইয়ের মুখে।
অনেক আগ্রহে বসে থাকতে থাকতে মাটি নিয়ে খেলতে গিয়ে গোটা শরীরটাই লাল হয়ে গিয়েছে তার। তিন্নি ছুটে এসে ভাইকে বললো— কত বেলা হয়েছে সে খেয়াল আছে তোর? আজ কি স্কুলে যাবি না ভাই?
দিদির মুখে স্কুল যাওয়ার কথা শুনতে পায় না টুকাই। হি-হি করে হাসে আর বলে— জানিস দিদি, আজ না অনেক হীরে বেরিয়েছে। একটু পরেই রোদে শুকিয়ে ওর থেকে আলো বের হবে দেখবি?
কোথায় হীরে?
ওই দ্যাখ, জেসিবির দাঁত বের করা মুখে।
তোর মাথা হবে, তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি চল, মা বকবে।
আর একটু দাঁড়া না রে, দিদি?
ইস, গোটা গায়ে কী করেছিস? তাড়াতাড়ি ওঠ, চল বাড়ি। তোর কপালে নির্ঘাত ঠ্যাঙানি আছে।
তার আগেই তো আমি পুকুরে ডুব দেবো মা দেখবে কী করে?
খুব হয়েছে, চলো আর পাকামো করতে হবে না!
দিদি, বিকেলে আসবি এখানে?
না, কাল বড়জোড়ায় হাট আছে। বরবটি তুলতে যাবো মায়ের সঙ্গে।
মনের গোপন খোপটায় কৌতূহলদের দমিয়ে রেখে টুকাই ছুটতে থাকলো দিদির আগে আলপথে। ঠিক যেন আস্ত লাল মাটির ভূত। ইংলি পিংলি ডিংলি ঠ্যাং দুটো হাওয়ার গতিতে ছুটতে ছুটতে একেবারে ওদের মাটির বাড়িতে।
তিন্নিদের বাড়িটা বোল্ডার আর মাটির দেওয়াল দেওয়া দুই কামরা। এই গ্রামে কাঁচা ফসলের ইনকামে অবস্থা অনেকেরই ভালো। ইটের তৈরি বাড়িও আছে পাশাপাশি প্রতিবেশীর। এখানে ইটের ঘর করতে গেলে বেশি ভিত দিতে লাগে না। সিমেন্ট পাথরের ঢালাইকে মজবুত করে ধরে রাখে বোল্ডার।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, শীতের প্রকোপ তেমন নেই। উত্তরবিলের জমিতে ভরে আছে ফসল।
খুব কষ্ট করেই যেন আজ স্কুলের সময়টা পার হয়েছে টুকাইয়ের। শুধু অপেক্ষা করেছিল ছুটির ঘণ্টার। টুকাই স্কুল থেকে এসে মুক্তোপুকুরের দিকে যাবে কী অমনি ওর বাবা জিজ্ঞেস করে— কোথা যাস রে বাবা টুকু?
কোথাও না বাবা।
তাহলে দিদির সঙ্গে চল আদা ওপড়াতে।
টুকুর তো সব কৌতুহল মাটি—।
টুকাইয়ের বাবা প্রায় কাঠা দুই জমিতে আদা চাষ করেছে। আর কিছুটা বরবটি আর শশা। টুকুর হাতে উচ্ছে বীজ। তিন্নি ছোট ছোট হাতে নিপুণভাবে আলুগাছের ভেড়িতে দুটি করে বীজ পুঁতে দিচ্ছে। টুকু আলুগাছের ভেড়িতে যেখানে সেখানে পা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে ওর বাবা বললো— টুকু, গাছ নষ্ট হচ্ছে কিন্তু। তুমি বরং আদাগাছগুলো এক কাছে জড়ো করো।
বাবা, আমি আদা তুলবো গাঁইতি দিয়ে?
তুমি পারবে না, পায়ে লেগে যেতে পারে।
টুকাই কথা শোনে না। তার মনের খোপ থেকে কৌতূহলের উৎসটা খাপ খোলা তলোয়ারের মতো বেরিয়ে মাটির গভীরে ডুব দিতে চায়!
গাঁইতি দিয়ে বেশ কিছুটা মাটি সরিয়ে ফেলে টুকাই। হালকা শীতের দিনেও ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে যায় সে। এক হাতের মতো মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসে ঝাড়ঝাড় আদা। একেবারে কাঁচা আদার সুগন্ধে ভরে যায় আশপাশ। ও আরও কিছুটা মাটি খোঁড়ে। কিছু একটা রহস্য উদ্ঘাটনের আশায়! কিন্তু দুই হাতের পর আর মাটি নেই, গাঁইতি আঘাত খায় বোল্ডারে। ওর বাবা ছুটে এসে বলে— এ কী করছো টুকু? গাঁইতি যে বোল্ডারে ঠেকছে।
বাবা, তাহলে মা যে বলে হীরে আছে আমাদের ক্ষেতে?
তিন্নির বাবা হেসে বললো— পাগল ছেলে, তুই দেখবি হীরে?
হ্যাঁ দেখবো তো, কই দেখাও?
আদাগুলো ওর হাতে দিয়ে বলে, এই দ্যাখ হীরে! আর চারিদিকে চেয়ে দ্যাখ কাঁচা ফসলের হীরেগুলো কেমন ঝিকমিক করে হাসছে।
বাবার কথা শুনে টুকাই চুপ হয়ে যায়। তারপর উদাস হয়ে দূরে তাকিয়ে দেখে হীরে পুকুরের মাঝে শুঁড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে জেসিবিটা! জমির দিকে তাকিয়ে দেখে উত্তুরে হাওয়ায় সারা ক্ষেতে খুশির জোয়ার! শ্যামল উজ্জ্বল বরবটি কলাইয়ের পাশে হলুদ শশাফুলে বসে আছে একটা মৌমাছি। বোল্ডার উপেক্ষা করে মাটির নীচ থেকে সবুজ হীরে ফসলগুলো আনন্দে ঝিলমিল করতে করতে হেলছে দুলছে! এমন আশ্চর্য জিনিস টুকাই যেন এই প্রথম দেখলো। আপন মনে হেসে দিদিকে বললো— ওই দিদি, দ্যাখ
দ্যাখ, চারিদিকের ক্ষেতে কতো হীরে, কতো হীরে! হি হি হি, হা হা, হি হি—, কতো হীরে—!