টোটোচালক রাখী

কাল্পনিক চিত্র

সমীর গোস্বামী

রাখীর অনেক ভোরে ওঠা অভ্যেস হয়ে গেছে। কোনোরকমে মুখ ধুয়ে এসে, গ্যাস জ্বেলে চায়ের জল বসিয়ে দেয়। সারাটা দিন ওর রুটিনমাফিক কাজ। ভোরে না উঠলে সব সারতে পারবে না। ঘরে ঢুকে দেখে সুমিত তখনও শুয়ে। ছেলের না ঘুম ভাঙে, সেদিকে খেয়াল রেখে, সন্তর্পণে সুমিতকে ডাকে— ‘ওঠো, চা খাবে চল।’
সুমিত সাড়া না দিয়ে, ওর হাত ধরে কাছে টেনে নেয়।

—‘কী হচ্ছে কী? ছাড়ো, ছেলেটা উঠে পড়বে।’
—‘পাঁচ-দশ মিনিট কাছে এসো। সারাদিনে এই সময়টুকুই তো কাছে পাই।’ সুমিতের গলায় মোলায়েম সুর।
রাখীরও যে ইচ্ছে করে না, তা নয়। কিন্তু ওকে যে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়।
—‘যত্ত সব। বলিহারি তোমার।’ কপট রাগ দেখিয়ে রাখী অগত্যা বরের পাশে শুতে বাধ্য হয়।
সারাদিন দু’জনেরই হাড়ভাঙা খাটুনি চলে। সুমিত যখন রাত এগারোটার পরে কোনোরকমে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাড়ি ফেরে, রাখীর দেখে বড্ড মায়া হয়।


ওর নিজেরও প্রায় অচল অবস্থা। ঘর-বার দু’দিক সামলাতে হয়। ছোটবেলায় সাইকেল চালানো শেখায় অবশ্য কিছুটা সুবিধা হয়েছে। বাড়িতে পুরনো একটা সাইকেল ছিল। ওর শ্বশুরমশাই চালাতেন। সেটা এখন ওর হেফাজতে।

দুপুরে ছেলেটাকে বাপের বাড়িতে মায়ের কাছে রেখে, প্রায় চার কিলোমিটার দূরে একটা জায়গায় কাজ করে। আরও তিনজন মহিলা আছেন। ওখানে মেয়েদের ব্লাউজে হুক বসাতে হয়। শাড়ির ফলস্-পিকো করতে হয়। মাইনে নয়, কত ব্লাউজে হুক বসানো বা ফলস্-পিকো করা হলো, তার গুণতিতে পয়সা পায়। তাই দম ফেলার সময় থাকে না। যত করতে পারবে, তত বেশি পয়সা। এখন পুজোর সময় তো, কাজের চাপ আরও বেশি। সন্ধেবেলায় কাজ যখন শেষ হয়, তখন চোখে যেন ঝাপসা দেখে।

ফেরার পথে আবার ছেলেটাকে নিয়ে ঘরে ফেলে। মা চা খেয়ে যেতে বলে, কিন্তু বসার জোর নেই। বাড়ি ফিরেই শুরু হয়ে যায় ঘরের কাজ।

রাখী আর শুয়ে থাকতে পারে না। সুমিতকে ধমকের সুরে বলে— ‘এবার ওঠো, দু’জনেরই দেরি হয়ে যাবে।’
অগত্যা সুমিতকে বিছানা ছাড়তেই হয়। সুমিত যা হোক করে দাঁত মেজে, চা খেতে বসে। খাওয়া তো নয়। গলাধঃকরণ করা। রাখীর আর চা খেতে বসা হয় না। রান্না করতে করতেই চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে। ওর কোনওদিকে তাকাবারও যেন সময় নেই। সুমিত দু’মুঠো ভাত খেয়ে সকাল আটটা কুড়ির ট্রেন ধরবে। হরিপাল থেকে হাওড়ার ডেলি প্যাসেঞ্জাররা, অনেকটা দূরে যেতে হয় বলে, সবাই দল বেঁধে একসঙ্গে নির্দিষ্ট কামরায় যায়। সব বন্ধু হয়ে গেছে। একে অপরের জন্য জায়গা রাখে। এমনকী কয়েকজন পরের স্টেশনে উঠবে। তাদের জন্যও জায়গা থাকে। এই নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে তাদের প্রায়ই ঝগড়া বাধে। ওদের নাম হয়ে গেছে, ‘ডেলি প্যাসেঞ্জার’ নয়, ‘ডেলি পাষণ্ড’।

সুমিতের সঙ্গেও সব কামরার ‘ডেলি প্যাসেঞ্জার’দের ভাব হয়ে গেছে। কম দিন তো নয়। প্রায় সতেরো বছর হকারি করছে। বাবা বেঁচে থাকতেই শুরু করেছে। গলির মোড়ে বাবার ছোট মুদিখানা দোকানটা তখন বন্ধ হবার উপক্রম। খদ্দের জিনিস কিনতে এসে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। টাকার অভাবে ওর বাবা তখন মাল কিনতে পারছে না। সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছিল। সুমিত তখন পার্ট-ওয়ানে পড়ে। সিদ্ধান্ত নিল, এভাবে আর চলে না। আয়ের পথ ধরতে হবে। বাবা পরামর্শ দিল হকারিতে সবচেয়ে কম মূলধন লাগে। তবে ট্রেনে হকারি করতে গিয়ে কোনোরকম ঝুঁকি যেন না নেয়।

রাখী তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার। সুমিতদের পাড়াতেই থাকে। ছোট থেকেই চেনা। কথাবার্তা হতো। যত বড় হতে লাগলো ভাব গাঢ় হলো। তবে দেখা হলে সুমিত বুঝতে পারতো, ওর সঙ্গে দেখা হলে রাখীর মুখে একটা সলজ্জ হাসি ফুটে ওঠে। সুমিত সেটা উপভোগ করত। ঠায় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত ওর দিকে। রাখীও ওর চোখের ভাষা পড়তে পারতো।

রাখীরাও অবস্থাপন্ন নয়। ওর বাবা পোস্ট অফিসে ডাকপিওনের কাজ করে। তবে সুমিতদের চেয়ে ভালো। সুমিত ছুতো খুঁজতো কীকরে দেখা করা যায়!

একদিন সকালে সুমিত রাখীদের বাড়িতে গিয়ে সরাসরি ওর বাবাকে বলল, ‘কাকাবাবু, আমাদের চিঠি থাকলে আপনি আর কষ্ট করে দিতে যাবেন না। আমি সর্বদা এখান দিয়ে যাতায়াত করি। আপনি বাড়িতে রেখে দেবেন। আমি যাওয়া-আসার সময় নিয়ে নেব।’
রাখীর বাবার খুব ভালো লাগলো। বললেন, ‘ঠিক আছে বাবা। তাই হবে।’

ব্যস শুরু হয়ে গেল। সুমিত দু’বেলা খোঁজ নিতে শুরু করল, চিঠি এসেছে কিনা। রাখী সুমিতের চালাকি ধরে ফেলেছিল। একদিন বলেই ফেলল, ‘দূর! মোটেই চিঠি আসে না। এদিকে দু’বেলা খোঁজ নেওয়া চাই। তোমার ফন্দি আমি বুঝি না?’

দিন দিন সংসারে অনটনের মাত্রা যত বাড়ছে, সুমিতের মাথায় চিন্তার পরিমাণও তত বাড়এেছ। ছোট ভাইটা স্কুলে পড়ে। ক্লাস এইটে। ভাবে ওর পড়া না বন্ধ হয়ে যায়। মাস্টার রাখতে পারেনি। নিজেই পড়ে।
রাখীকে নিয়েও কম চিন্তা নয়। ওকে নিয়ে সুমিত অনেক স্বপ্ন দেখে।

অগত্যা সুমিতকে পড়া বন্ধ করে হকারি ধরতে হলো। প্রথম প্রথম কেমন যেন লজ্জা করত। ধীরে ধীরে পোক্ত হয়ে গেল। হকার্স ইউনিয়নের মেম্বারশিপও নিয়ে নিল। লাইনের সবাইকার সঙ্গে ভাব-সাবও হয়ে গেল। তবে সুমিত ওদের যে সমস্ত অলিখিত নিয়মকানুন আছে, তা সম্পূর্ণ মেনে চলে। একই জিনিস নিয়ে অন্য হকার এক কামরায় বিক্রি করতে থাকলে ও কখনও সেই কামরায় ওঠে না।

রাখী ওকে একদিন দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল, ‘সুমিতদা তুমি হকারি করতে লাগলে?’ গলায় যেন কিছুটা হতাশার সুর।
—‘কী করব বলো? এখন সবাই জিনিস কিনতে ঝাঁ চকচকে মল-এ যায়। দোকানও এখন সবাই বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছে। সেই জায়গায় আমাদের ছোট দোকান কীকরে পাল্লা দেবে বলো? সংসার চালাতে হবে। বাবা আর খাটতে পারছে না।’

একটু চুপ করে থেকে মুখে আলতো হাসি টেনে নিয়ে বলল, ‘তাছাড়া তোকে বিয়েও তো করতে হবে।’
রাখী আর দাঁড়ালো না— ‘ধ্যাৎ’ বলে মুখে একটু কপট রাগ দেখিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
সুমিতের খুব ভালো লাগল। হাসিমুখে হাঁটা দিল।

সুমিতের হকারি করা প্রায় বছর দুয়েক হয়ে গেল। ও রবিবারেও বেরোয়। তবে সেদিন একটু দেরিতে বেরোয়। কারণ সকালে তেমন বিক্রি হয় না। কিন্তু বিকেল থেকে বিক্রি বাড়ে। ছুটির দিন বলে, সপরিবারে সকলে বেড়াতে, কলকাতায় কেনাকাটা করতে বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যায়। তখন ছোটরা লজেন্সের জন্য বায়না ধরে। ফলে একটু বেচা-কেনা হয়।

সুমিত অবশ্য একই জিনিস সারা বছর বিক্রি করে না। মাঝে মাঝে পাল্টে নেয়। এর আগে হজমি, বাদাম, চানাচুর, ডালভাজা ইত্যাদি বেচেছে। তবে লজেন্স বেচতেই ওর পছন্দ। অনেকটা নির্ঝঞ্জাটে করা যায়।
একদিন খেতে বসে বাবা বলল— ‘হ্যাঁরে, এবার বিয়ে-থাওয়া তো করতে হবে, নাকি?’ সুমিত কোনও উত্তর না দিয়ে খেয়ে যাচ্ছিল। বাবা আবার বললেন— ‘উত্তর দিচ্ছিস না যে?’ তোর কাউকে পছন্দ হয়?’
সুমিত তাও চুপ।
—‘কীরে? কিছু বল।’ — বাবার প্রশ্ন।
বারে বারে জিজ্ঞেস করায় সুমিত উত্তর না দিয়ে আর পারল না।
বলল— ‘নির্মলবাবুর মেয়ে রাখীকে বিয়ে করব ঠিক করেছি।’
—‘ঠিক আছে। কাল সকালে আমি নির্মলবাবুর সঙ্গে কথা বলবো।’
সুমিতের ভাই, অমিত মুখ নীচু করে খাচ্ছিল। হঠাৎ বলে উঠল— ‘ও বুঝেছি!’ তাই জন্য রোজ সকালে রাখীদি জিজ্ঞেস করে— ‘কী রে, দাদা বেরিয়েছে?’

নির্মলবাবুর সঙ্গে কথা বলে, দিনক্ষণ দেখে সুমিতের বাবা বিয়ে পাকা করে ফেললেন। সেই মতো খুব ধুমধাম করে না হলেও বিয়ে হয়ে গেল। দু’জনে বেজায় খুশি। বিয়ের পরে কিছুদিন সুমিত কাজে যায়নি। অষ্টমঙ্গলা কেটে গেলে আবার বেরোনো শুরু করে দিল। রাখীও ভোরে উঠে রান্না বসিয়ে সুমিতকে খাইয়ে পাঠায়। সঙ্গে খাবার দিয়ে দেয়।

সুমিত বেরিয়ে গেলে, শ্বশুরের সঙ্গে চা নিয়ে বসে সঙ্গ দেয়। শ্বশুরকে আগে ‘কাকাবাবু’ বলতো। বিয়ের পরেই সুমিত বলে দিয়েছে, এখন থেকে ‘বাবা’ বলে ডাকবে।

সুমিতেরও একই ব্যাপার। রাখীর বাবা-মাকে ‘কাকাবাবু-কাকীমা’ বলতো। বিয়ের পরেই ‘বাবা-মা’ বলা শুরু করে দিয়েছে।

সুমিত আগের চেয়ে আরেকটু সকাল করে বেরোবার চেষ্টা শুরু করে দিল। রাখীকে তাড়াতাড়ি খেতে দিতে বলায়, রাখী জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘তুমি, ক’দিন ধরে হঠাৎ আগে আগে খেতে চাইছো কেন?’
—‘বোঝো না, একটু বেশি সময় কাজ করলে, দু’পয়সা আয়টা তো বাড়বে। তোমাকে একটু ভালো করে রাখতে হবে না? তাছাড়া নতুন অতিথি তো আসছে।’
—‘থামো তো।’ —রাখী ঝাঁঝিয়ে ওঠে। ‘যেমন চলছিল, তেমন চললেই হবে।’ তবে মা হতে যাচ্ছে সে কথা ভেবে আনন্দের ঝলকানিটাও মুখে লেগে রইল। সুমিত অল্প হেসে খেতে বসে যায়।

এটা সত্যি যে, সুমিতের মনে মনে ইচ্ছে, আয়টা যদি একটু বাড়ানো যায়। বউয়ের শখ-সাধ মেটাতে ওরও ইচ্ছা করে।
বেশিক্ষণ কাজ করার ফলে, ওর আয় যে একটু বাড়েনি, এমনও নয়। সেটার জন্যে ওর মনেও একটু ভালো লাগা কাজ করছে।

আগের চেয়ে একটু ঝুঁকিও দিচ্ছে। এখন এক কামরায় কাজ শেষ করে, সেখানে আর অপেক্ষা করে না। চলন্ত ট্রেনেই কামরা পাল্টে নেয়।

সেদিন সন্ধেবেলায় রাখীর হঠাৎ ব্যথা উঠল। শ্বশুর, দেওর তাড়াতাড়ি টোটো ডেকে ওখানকার হাসপাতালে নিয়ে গেল।

সুমিত রাত করে বাড়ি ফিরেই, সব শুনে ছুটল হাসপাতালে। ততক্ষণে রাখী ছেলের মা হয়ে গেছে। শুনে সুমিতের আনন্দ আর ধরে না। ওকে দেখে, যন্ত্রণার মধ্যেও রাখীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।

দু’দিন পরে সুমি ছেলে-বউ দু’জনকেই বাড়ি নিয়ে এল। ওর আনন্দ আর ধরে না। সুমিতের বাবারও খুব আনন্দ। অমিতকে বলল, ‘কী রে, তুই কাকা হয়ে গেলি?’
অমিতেরও জবাব— ‘তুমিও তো দাদু হয়েছো?’

দু’দিন কেটে গেলে, সুমিত আবার বেরোতে লাগলো। রাখীরও চাপ বেড়ে গেল। মনে মনে বলে, ‘শাশুড়ি বেঁচে থাকলে এতো চাপ পড়ত না।’ কিন্তু কোনও উপায় নেই। করে যেতেই হবে। তবে ছেলেটা খুব ভালো হয়েছে। রাত্রে ঘুমোয়। কেবল দু’বার জেগে ওঠে খাবার জন্য। আবার মায়ের দুধ খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়ে।

বেশ চলছিল। সুমিতের বাবা দোকান খুলে রোজ সকাল থেকে বসে পড়েন। যদি ক’টা টাকা ঘরে আসে।
সেদিন রাখী সবে ব্লাউজ কারখানা থেকে ফেরার পথে ছেলেটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। এমন সময় অমিত হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলল, ‘বৌদি, স্টেশনের দিক থেকে একটা লোক আসতে বলল, দাদার নাকি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। শ্রীরামপুর হাসপাতালে ভর্তি করেছে।’

রাখীর মুখে আর কথা নেই। ছেলেকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে, আবার বাপের বাড়ি রেখে দিয়ে ছুটল স্টেশনের দিকে। অমিতও এলো পেছন পেছন।

ট্রেন থেকে শ্রীরামপুরে নেমে রিকশা নিয়ে সোজা হাসপাতালে এলো। পৌঁছে দেখে সুমিতকে ‘অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে। একজন নার্স বলল, ডান পা-টা বোধহয় বাদ দিতে হবে।

রাখী-অমিত দু’জনেই কাঁদতে শুরু করে দিল। ঘণ্টা দুয়েক পরে, অপারেশন হয়ে গেলে ওদের ডেকে সুমিতকে দেখতে দিল। দেখল ডান-পায়ের নীচটা নেই। হাঁটু থেকে ওপর পর্যন্ত আষ্টেপৃষ্টে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ওর মধ্যেই সুমিত যন্ত্রণাকাতর মুখে ওদের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বুজে নিল।

রাতে বাড়ির একজনকে থাকতে বলায়, রাখী অমিতকে বলল, ‘অমিত, তুই থাক। আমি কামুদার কাছে যাচ্ছি। আমি এখন থেকে টোটো চালাবো।’ বলেই স্টেশনে যাওয়ার জন্য একটা রিকশা ধরে নিল।
অমিতের মুখে কোনও উত্তর নেই। ও বৌদির চলে যাওয়ার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।