কালের নিয়মে শুকোবে ‘মহামারি’র ক্ষত, কিন্তু তার দাগ থেকে যাবে শতাব্দীর গায়ে

প্রচ্ছদ চিত্র

প্রবীর মজুমদার

‘মহামারি’র সঙ্গে বাঙালির পরিচয় অবশ্যই নতুন কিছু নয়। তবে বাঙালির গেরস্থালিতে তার নাম ‘মহামারি’ ছিল না। বাঙালির আবহমান তাকে চিনত ‘মড়ক’ হিসেবে। মহামারি এ দেশের ইতিহাসে নতুন কিছুই নয়। আবহমানে বারবার এ দেশে আর পাঁচটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো মড়কও এসেছে। কিন্তু তার হিসেব প্রাক-আধুনিক বাংলা তথা ভারত রাখত না। আসলে রাখার দরকারও ছিল না সে কালের রাষ্ট্রের। মুঘল শাসন ‘প্রজাহিতৈষী’ হতে পারে, কিন্তু আধুনিক অর্থে ‘কল্যাণকর’ ছিল না। সেখানে জনগণনার প্রয়োজন ছিল না। ‘জনস্বাস্থ্য’ ব্যাপারটাই ছিল ধারণার বাইরে। মড়ক তাই মড়কের মতো এসেছে, তার পরে প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে গিয়েছে। অজন্মা, শস্যহানি, বর্গীর হাঙ্গামের মতো মড়কও একটা ‘হাঙ্গাম’ হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছে।
হাল আমলের ‘মড়ক’ করোনাকাল আজ অতিক্রান্ত। করোনা ভাইরাসের দাপট কমলে বাংলার সাহিত্যিকরা একে উপজীব্য করে উপন্যাস বা গল্প লিখবেন না, তা কি হয়! বিশ্বসাহিত্যে যেমন আছে ‘প্লেগ’ বা ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার অফ সলিটিউড’! মহামারির স্মৃতিকে তো হারিয়ে যেতে দিলে চলবে না। তাকে আবার দরকার পড়বে আবার কোনও এপিডেমিকের সময়ে। মিলিয়ে নিতে হবে অভিজ্ঞতা। কাল বদলাবে। কিন্তু ‘কালান্তর’-কে মনে করিয়ে দেবে সাহিত্য। সম্প্রতি হাতে এলো শ্যামলী রক্ষিতের লেখা করোনা মহামারী কালের পটভূমিতে নগর জীবনের এক চিত্রিত উপন্যাস।

শ্যামলী রক্ষিত একজন আধুনিক বাংলা সাহিত্যিক, যিনি গল্প এবং উপন্যাস— উভয় ক্ষেত্রেই নিজের স্বতন্ত্রতা প্রমাণ করেছেন। বিশেষত, তাঁর লেখায় জীবনের জটিল সম্পর্ক, মধ্যবিত্ত সমাজের টানাপোড়েন এবং মনোবিজ্ঞানের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ফুটে ওঠে। উপন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি কাহিনীর মাধ্যমে চরিত্রগুলোর মানসিক দ্বন্দ্ব এবং বিবর্তনের ওপর জোর দেন। তাঁর উপন্যাসগুলো কেবল ঘটনার বর্ণনা নয়, বরং চরিত্রগুলোর মনোজগতের এক বিশদ চিত্রায়ণ। শ্যামলী রক্ষিতের লেখার ভাষা অত্যন্ত সাবলীল ও কাব্যিক, যা পাঠকের সঙ্গে তাঁর বিষয়বস্তুর একটি নিবিড় সংযোগ স্থাপন করে। তিনি নারী চরিত্রের মানসিকতা ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শী। তাঁর সাহিত্য মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতাকে তুলে ধরে, যা পাঠকদের কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়েছে।


শ্যামলী রক্ষিতের লেখা আজকের আলোচ্য উপন্যাসটির নাম ‘আবহমান’। উপন্যাসটি ‘উচ্ছ্বাস’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ২০২১-২২ সালে। এই বছরের মাঝামাঝি বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাসটি। উপন্যাসটি করোনাকাল নিয়ে লেখা কলকাতা নগর জীবনের এক জীবন্ত দলিল। দক্ষিণ কলকাতার কসবা অঞ্চলের এক জনদরদী আইনজীবীর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের কাহিনী দানা বেঁধেছে। করোনাকালের কোয়ারান্টাইনে জেরবার অসহায় মানুষ, যখন করোনা আক্রান্ত প্রিয়জনকে বাঁচাতে পাগলের মতো দিশেহারা হয়ে পথে পথে ঘুরছে, সেই সময়ের চিকিৎসা সংকট, হাসপাতালের বাস্তব পরিস্থিতি এবং রোগীর পরিবারের অপরিসীম যন্ত্রণার ছবি এই উপন্যাসে নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে।

কাহিনীর পটভূমি দক্ষিণ কলকাতার কসবা অঞ্চলের এক আবাসন। এ শহরের এক প্রান্তে নতুন গড়ে ওঠা আবাসন সাঁঝবাতি অ্যাপার্টমেন্ট। এক সময় যেখানে থেমে গিয়েছিল নগরায়নের গতি, সে প্রান্তেই নতুন করে হাত পা ছড়িয়ে গড়ে উঠছে এমন সব আবাসন। আধুনিক বহুতলের ছায়ার নিচে পড়ে থাকা বস্তি আর বস্তিবাসীদের পাশে নিয়েই গড়ে ওঠা আবাসন সাঁঝবাতি অ্যাপার্টমেন্ট। পেশায় আইনজীবী বিকাশ যার অন্যতম বাসিন্দা। ভরা লকডাউনে সকলের মতোই গৃহবন্দি দশায় বিকাশ আর তার স্ত্রী শতাব্দী। মেয়ে রুমি আটকে পড়েছে ব্যাঙ্গালোরে পড়তে গিয়ে। দায়িত্বশীল, সদাসতর্ক বিকাশ হাঁপিয়ে ওঠে গৃহবন্দি দশায়। সামান্য অসতর্কতায় শিকার হয় সেই অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণের। আর কাহিনী গতি পায় তখনই।

বিকাশের শৈশব কেটেছে এই এলাকাতেই। আশৈশব বস্তি-জীবনকে দেখেছে খুব কাছ থেকে। আর বস্তির মানুষের সঙ্গে তার গড়ে ওঠা সখ্য ছিল আন্তরিকতায় ভরা। শতাব্দী ওরফে বুড়ির ছোটবেলাও কেটেছে পাশের পাড়ায়। মানবদরদী স্বামী বিকাশের যোগ্য স্ত্রী শতাব্দী। যারা আত্মকেন্দ্রিক ফ্ল্যাট কালচারকে কিছুতেই পারে না রপ্ত করতে। সেই বিকাশ পড়ল কোভিডের কবলে।

সংকটের সময় আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও মানুষ যে কতটা অসহায়, কতটা বিপন্ন বোধ করেছে , তা আখ্যানের পাতায় পাতায় এঁকেছেন ঔপন্যাসিক। বিকাশের শ্যালক বাবলু। সহোদরের মতোই সম্পর্ক তাদের।

পলিটিক্যাল কানেকশনও যথেষ্ট ভালো বাবলুর। সেই ডাকাবুকো বাবলুও জামাইবাবু বিকাশকে নিয়ে আতান্তরে পড়ে এই শহর কলকাতায়। কাজ করে না কোনো রাজনৈতিক যোগাযোগ। বিপদের সয়য় ফোনে সাড়া দেয় না ঘনিষ্ঠ নেতা, বন্ধুরা। সরকারি হাসপাতালের মেঝেতে বিনা চিকিৎসায় পড়ে বিকাশের মৃত্যুর প্রহর গোনার বর্ণনায় পাঠকের চোখের জল বাঁধ মানে না কথাকারের লেখনীর গুণে। কী অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আক্রান্তের প্রিয়জনদের কাটাতে হয়েছে তার এক জীবন্ত ছবি এই আবহমান। মৃত করোনা রোগির প্রিয়জনদের প্রতি কতটা নির্মম আর অমানবিক আচরণ করতে বাধ্য হয়েছিল সমাজ, সভ্যতা— তার এক মর্মস্পর্শী ছবি এঁকেছেন শ্যামলী রক্ষিত। মৃত স্বামীর দেহ চোখে দেখার সুযোগ টুকুও না পেয়ে ফিরে এসে একলা এক নারীর ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিজের হাতে বৈধব্যের বেশ ধারণ করার বর্ণনা আর একের পর এক হৃদয়বিদারক ঘটনা অতি বড়ো হৃদয়হীনের চোখেও প্লাবন আনবে এ উপন্যাস। শহর কলকাতায় বিকাশের মর্মান্তিক মৃত্যু আর পরিস্থিতির সঙ্গে শতাব্দীর অসম লড়াইয়ের পাশাপাশি সুদূর ব্যাঙ্গালোর থেকে মেয়ে রুমিকে ওই ভরা লকডাউনে স্পেশাল গাড়ির ব্যবস্থা করে কলকাতায় নিয়ে এসে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করায় বাবলু।

লেখক শ্যামলী রক্ষিতের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল এই উপন্যাস। পাঠককে বেশ অনেকগুলো নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই আখ্যান। মানুষের অর্থ, সততা, ওপরমহলে অল্পস্বল্প যোগাযোগ— সমস্ত কেমন অর্থহীন হয়ে পড়ে চরম সংকটের সময়। এমন বেশ কিছু নির্মম বাস্তবতার সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন লেখক।

অত্যন্ত সহজ, সরল বর্ণনায় এগিয়েছে এ আখ্যান। কাহিনীতে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যাদের ছাড়া এ কাহিনী পূর্ণতা পেত না। আবাসনের দারোয়ান রামবিলাসের চরিত্রটি চমৎকার মমতায় ও অসাধারণ দক্ষতায় এঁকেছেন লেখক। এই রামবিলাসও উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। করোনাকালে শহর কলকাতার সচ্ছল মধ্যবিত্ত মানুষও কতটা অসহায়, কতটা বিপন্ন হয়েছিলেন, তার এক জীবন্ত দলিল হয়ে থেকে যাবে আবহমান।

আজ ছন্দে ফিরেছে পৃথিবী। যার স্বাভাবিক ছন্দকে প্রায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল এক আণুবীক্ষণিক পরজীবী। মাত্র তো কয়েক বছর আগের কথা। স্বজন হারানো অসংখ্য মানুষের মনের সেই দগদগে ক্ষতে প্রলেপ পড়েনি আজও! কালের নিয়মে একদিন হয়তো সে ক্ষত শুকোবে, কিন্তু তার দাগ থেকে যাবে শতাব্দীর গায়ে। মহাকাল বহন করে চলবে সে দাগ।

বই : আবহমান
লেখক : শ্যামলী রক্ষিত
প্রকাশক : সপ্তর্ষি প্রকাশন
মূল্য : ৩৫০ টাকা