সুমি খান
ভাটির দেশ— নদী, খাল, বিল আর আকাশের মতো অনন্ত জলাভূমি। সাগরের মোহনায় কর্ণফুলীর পাড়ে নতুন চর জেগেছে। গভীর রাতে নদীর পাড়ের খুপড়ি ঘরে ঘুম ভেঙে যায় রঙ্গতির। দূর থেকে হাঁক পাড়ে লাঠিয়াল দল, ‘অই… তরিক্কা জউম্মা, ক’ডে তোরা? দু’রি আয় বেক্কুন… দইজ্জাত চর জাইগ্যে অউডা…!’ হুম হুম করে তেল মাখানো লাঠি হাতে এক গ্রামের জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো আরেক গ্রামের জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর উপর। নতুন চরের দখল নিতেই হবে। জিনে নিতে হবে চর, জমিদারের হুকুম। লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু হলো আবার। কিন্তু রঙ্গতি জানে, যে দলে চেকনাই তাগড়া তরুণ রূপাই মাঝি থাকে, সেই দলকে হারাতে পারে কেউ। নদীর পাড়ে দশ গ্রামের লোকের ভীড়ের মাঝে রঙ্গতি তার ‘কাজল ভ্রমরা’ রূপাইয়ের ডাগর নয়ন খুঁজে ফেরে!
রূপাইয়ের জন্ম জেলে পরিবারে। জলই তার জীবন, সাগরের উত্তাল ঢেউ তার খেলার সাথী চিরকাল। কর্ণফুলী শুধু তার পেটের খিদে মেটানোর রুজি নয়, তার সকল খেলায় খেলা করা সাথের সাথী। প্রতিদিন সূর্য উঠলে সে বৈঠা হাতে নদীর দিকে যায়। নদীর জলে নৌকা নামানোর সময় বলে, ‘ও মা জননী নদী আমার, আইজও আমার জান বাঁচাইয়ে মায়ের বুকে ফিরাই দিস।’
রঙ্গতি কুড়িয়ে পাওয়া অনাথ। ৫ বছর আগে এক নৌকাডুবিতে অনেক হতাহতের স্তূপ থেকে নাকি তাকে কোলে তুলে নেয় মজলু মিয়া। মজলু মিয়ার পরিবারও নৌকায় করে ভেসে বেড়াতো। এক যুগ হলো এ দরিয়া পাড়ের বসতি। এমন মায়াবি ভাষা চট্টগ্রামের লোকেদের, বুঝতে পারলেও এ কয়েক বছরে রঙ্গতি এখনো আয়ত্ত্ব করতে পারেনি এ ভাষা, বড়ো দুর্বোধ্য ঠেকে তার। আজ পূর্ণিমা। রঙ্গতিকে মা বলেছিলো, তাড়াতাড়ি খেয়ে যেন শুয়ে পড়ে। কিন্তু দশ গেরামের লোক লাঠিয়ালদের লড়াই দেখতে ছুটে আসছে। কী করে ঘুমাবে রঙ্গতি? বেশ ক’বার চর জেগেছে। রঙ্গতি লাঠিয়ালদের রক্তক্ষয়ী লড়াই জানে। জমিদারদের চর দখলের লড়াইয়ের হাতিয়ার লাঠিয়াল বাহিনী, কঠিন এদের সংগ্রাম। কোনোমতেই শত্রুর কেন্দ্রে দলনেতা যায় না। শুরুতেই টার্গেট শত্রুবূহ্যের মাঝে লাঠি হাতে ঘূর্নির মতো চোখ বুঁজে শত্রু দমন। তাগড়া জোয়ান একেকজন। মহিষের মত গায়ের রং অধিকাংশের, মাথায় ঝাঁকড়া বাবরি চুল, হাতে লাঠি। ৫০ থেকে ১০০ লাশ পড়ে প্রতিবার। পেট কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়, যেন কারো লাশ খুজে পাওয়া না যায়। ভোরের আলো ফুটবার আগেই যে দল চরের দখল নিতে পারে, চিরকালের জন্য সেই লাঠিয়ালের জমিদারের হয়ে যায় নতুন চর। মহিষ পালন আর কিছু লাঠিয়াল পরিবার নিয়ে চিরদিনের জন্যে মালিকের হুকুমদাস হয়ে চর পাহারা দেয়।
রঙ্গতি আকাশপানে চেয়ে বলে, ‘খোদা, আইজকা পূর্ণিমার রাইত, আসমান ভাইঙ্গা জোছনার ঢল নামে য্যান! আমার দিলে যার ঠাঁই, আমার মাঝিরে য্যান কেউ একটা টোকাও দিবার না পারে।’ জেলে পরিবারের সন্তান রূপাই তার লড়াকু জওয়ানীতে কাবু করে দেয় প্রতিপক্ষকে। টর্পেডো হয়ে যেন রূপাই বিঁধে যায় রঙ্গতির কোমল নরম বুকের গহীনে। ঠিকই, রূপাই জিনে নেয় নতুন চর। জমিদার আগেই বলেছে, রূপাইকে তার ভবিষ্যৎ গড়তে নতুন চরে বাড়ি করে দেবেন জমিদার বিলায়েৎ আলি খাঁ। নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে রঙ্গতি।
জেলে-নৌকা নিয়ে ভোরের আগেই গভীর সমুদ্রে চলে যায় রূপাই। নীলাভ চোখের অদ্ভুত মায়াময়তায় রূপাই যেন মুগ্ধ করে রাখে রঙ্গতিকে। যে চোখের গভীরে নীল বিষণ্ণতা। রূপাইয়ের নৌকা বেয়ে যাওয়ার সময় জলে সূর্যের ছায়ায় কাঁপন ধরে তার বুকের ভেতর। কর্ণফুলীর ঢেউয়ে ভেসে আসা রঙ্গতি এখন ষোড়শী। দিনভর গাছে গাছে কাঠবেড়ালির সঙ্গে খেলায় মত্ত রঙ্গতি। বাপের আদরের দুলালি রঙ্গতি কোনো শাসন-বারণ মানে না, গ্রামের সবাই জানে। পারিজাত আর স্বর্ণালু ফুলের গাছের সারির নিচে বসে প্রতীক্ষায় থাকে কবে রূপাই ফিরবে। কেন জানে না, উত্তাল সর্বনাশা দরিয়াকে বড়ো ভয় তার। একদিন রূপাইকে বলে, ‘ডিঙ্গিতে উঠলে কেমন যেন বুক ধড়ফড় করে, যেন ঢেউ আমারে টেইনে নিয়ে যাবে, মাঝি!’ রূপাই হাসিতে ভেঙে পড়ে। বলে, ‘আমারে দরিয়া ডরায়, জানস না, সোনার কইন্যা? আমার বুকের ছাতি দেখছস? এত্ত বড়ো ছাতির লগে কইলজার ভিতর তরে বাইন্ধা রাখমু তরে আমার সোনার কইন্যা। ঢেউ আর কৈ পাইবো আমাগোরে?’ নিবিড় আলিঙ্গনে হারিয়ে যায় দীঘল বেণীর রঙ্গতি। সন্ধ্যাতারার দিকনির্দেশনায় যেন রূপাই এসে দাঁড়ায় রঙ্গতির খিড়কির নিচে। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘সোনার কইন্যা, আইয়া পড়। নদীর কূলে— তোরে আমার বুকে বাইন্ধে সাগরের ঢেউয়ে ভাসুম আইজ রাইতভর।’ রাতজাগা চাঁদ নদীর জলে জোয়ার নামায়। রূপাইয়ের শক্ত বাহুর বন্ধনে রঙ্গতির স্বর্গ যেন। ঢেউয়ের তালে তালে রূপাইয়ের পরানের গহীন ভিতর আরো নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখে তার সোনার কইন্যাকে। পাশ থেকে বাঁশিটা নিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে সুর তোলে। রূপাইয়ের বাঁশির সুর বড়ো মায়াবী। ভাটির দেশের কইন্যা রঙ্গতি গেয়ে ওঠে তার প্রিয় ভাওয়াইয়া— ‘যদি বন্ধু যাইবার চাও, ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে, বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে, কোন দিন আসিবেন বন্ধু— কয়া যাও রে…’ গানের মাঝেই রঙ্গতির চোখে নীরব অশ্রুধারা। জানে না কেন। এ গান কি তবে কোনো বার্তা দিলো তার ভেতরঘরে? অজানা ভয়ে থমকে যায় রঙ্গতি!
আষাঢ় মাসে কর্ণফুলীতে সাগরের জোয়ার নামে। সাগর ক্ষুব্ধ, ঢেউয়ের গর্জনে বুকে কাঁপন ধরে রঙ্গতির। সুবর্ণ দ্বীপের নতুন বণিকের নৌকা বর্মা শহর যাবে। জাহাজ কূলে ভিড়েছে। লোকমুখে শুনে বণিক রূপাইকেই চায়। তার বাবাকে অনেক টাকা নাকি দিয়েছে রূপাইকে বণিকের জাহাজের সারেং করে নিতে। বণিক নাকি বলে দিয়েছে, তার রূপাইকেই চাই, বড়ো দানের মাল নেবে, ডাকাত ঠেকাতে হবে। তাগড়া জওয়ান, লাঠিয়াল, দক্ষ সারেং রূপাইকে চাই। রঙ্গতির মনে ‘কু’ ডাকে। রূপাইকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘যাস না মাঝি, দরিয়ায় বান ডাকতিছে রে। মনে আমার ‘কু’ ডাকে। সাগর কাউরে ফেরাইতে দেহি নাই, মাঝি…!’ রূপাই হা-হা করে হাসে, ‘সাগর আমার বন্ধু রে সোনার কইন্যা। নিত্যদিন মায়ের বুকে আমারে ফিরাই দেয়। এইবার ফিরায়ে দেবে তোর বুকে।’ জাহাজে উঠবার মুহূর্তে শেষ রাতে রঙ্গতির জানালার ধারে এসে ডাক দেয় রূপাই। একটা শঙ্খ রঙ্গতির হাতে দিয়ে বলে, ‘কবে যে ফিরুম জানি না সোনার কইন্যা, তয় ফিরুম। যদি মন কান্দে, এই শঙ্খডা তর কানে ধরিস। আমার বাঁশির সুর শুনবি, যে সুরে তুই আমার ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাইতে কস, সেই সুর। এমন ধবল জোছনায় আকাশের দিকে চাইয়া সেই গানটা গাইবি। তর মাঝি ঠিক তর বুকে ঝাঁপাইয়া পড়বো… যাই রে সোনার কইন্যা আমার, বিদায় দে।’
কেঁদে ওঠে রঙ্গতি, ‘বিদায় নিতে নাই মাঝি, মায়ে কইতে শুনছি। কইয়া যাও গো, কবে আসপা?’ খিড়কিতে রাখা রূপাইয়ের হাত দুটো ধরে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে রঙ্গতি, নিজেও জানে না এ বাঁধ ভাঙা কান্না কেন? কান্না থামিয়ে, শঙ্খ বুকে নিয়ে রঙ্গতি শুধায়, ‘মাঝি, আমার চোখে তোর দরিয়ার মতো নীল চোখ রাইখে কও দেহি— ফিরবি তো তোর সোনার কইন্যার বুকে?’ রূপাই রঙ্গতির নুয়ে পড়া আকুল মুখটি দু’হাতে জড়িয়ে তার কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। জোছনার ধবল প্রহরে সে কী অপরূপ রূপমাধুরী! গভীর নিবিড় চুম্বনে রূপাই নীরব করে দেয় রঙ্গতির আকুল পাগল প্রগলভতা। কতটা সময় কেটে যায়, কেউ জানে না। নিবিড় চুম্বনের আবেশভরে রূপাই বলে ওঠে, ‘জোছনার কসম, আমার সোনার কইন্যার বুকে এমন ধবল চাঁদনি পহর রাইতে আমি ফিরা আসুম, কইয়া দিলাম, সোনার কইন্যা।’
পরদিন ভোর থেকে সমুদ্র উত্তাল। বণিকের জাহাজ কূল ছেড়ে গেছে বটে, আর কুলে ফেরেনি। আকাশ অন্ধকার, সাগরের উত্তাল বিশাল উঁচু সব ঢেউ ভাসিয়ে নিয়েছে নদীর কূলের যতো জেলে পরিবারের বাড়ি ঘর। তিন দিন পর ঝড় থামলে সবাই খোঁজ করে স্বজনদের। সাগরের অতলে ভেসে গেছে সব জেলে নৌকা। রূপাইয়ের জাহাজ নাকি ডুবে গেছে, কেউ বাঁচেনি। রঙ্গতির যে বিশ্বাস হয় না! প্রতিরাতে খিড়কির সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘মাঝি, তোমার সোনার কইন্যার কাছে আর আইলা না? আর ডিঙ্গিরে ডরামু না— জোছনার কসম কাটছ তুমি। চাঁদ উঠছে, ডিঙ্গি বাইবা না? বাঁশিটা মনে কইরা নিও। আমারে নিয়া যাও মাঝি…!’ প্রতি পূর্ণিমায় নদীর কূলে বসে থাকে। এমনই এক পূর্ণিমা রাতে রঙ্গতি চিৎকার করে ওঠে। বলে, ‘মাঝি, আইছ? জানতাম তুমি আইবা… তোমার সোনার কইন্যার কাছে না আইয়া পারবা তুমি? জোছনার কসম খাইয়া কইছিলা মাঝি..!’ শঙ্খটি কানে নিতেই রূপাইয়ের বাঁশি বাজে। রঙ্গতি গেয়ে ওঠে, ‘ও কি ও বন্ধু, কাজল ভ্রমরা রে, কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও, কয়া যাও রে..!’ একদিন গভীর রাতে দূর থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসে। রঙ্গতি ছুটে যায় নদীর দিকে। শান্ত, চাঁদের আলোয় যেন মিলায় রঙ্গতির দুঃখসুখের সকল অবসান। ধবল জোছনায় বেদনার জলে ভেসে যায় রঙ্গতি… স্তব্ধ তরুর কোন ছায়া! চুলে ধবল রেখা! ধবল জোছনার ছাপ রেখে যায় জীবনের সাথে সাথে। ঢেউয়ের খেলায় দূর থেকে দেখা যায়, নৌকার ছায়া ভাসছে। গভীর নীলাভ চোখ মেলে জোছনার আলোয় হারিয়ে যায়…। সেই যে সাগর মোহনা! এখনো জনশ্রুতি আছে রঙ্গতি-রূপাই অমর প্রেম চিরকালীন বিরহগাথা হয়ে বেঁচে আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বুড়োবুড়ি গল্প বলে— কর্ণফুলী নদী নাকি এক আরাকান রাজকন্যার হারিয়ে যাওয়া কানফুল নিয়ে নামকরণ। রাজকন্যা এক বণিককে গভীর ভালোবাসে। এক নৌবিহারে রাজকন্যার কানের দুল স্রোতের তোড়ে ভেসে যায়। সেই কানফুল হারানোর গল্পে কর্ণফুলীর নামকরণ। তেমনি নাকি রূপাইও ফেরেনি তার সোনার কইন্যা রঙ্গতির কাছে। গ্রামের মন্দিরে আজও পূর্ণিমা রাতে কেউ কেউ বলে— ‘চাঁদ উঠলে কর্ণফুলীর জলে জোড়-ছায়া দেখা যায়। বাঁশি বাজায় প্রেমিক, তার প্রেয়সী গান গেয়ে যায় তার কাজল ভ্রমরার বাহুবন্ধনের নিবিড় আলিঙ্গনে। কেউ বা বলে রঙ্গতির ছায়াতে শঙ্খ কানে ধরে থাকে এক নারী। রূপাইয়ের বাঁশির করুণ সুর ভেসে আসে বহু দূর থেকে মোহনার জলের ঘূর্ণিস্রোতে।
কর্ণফুলীর মোহনায় এখন বড়ো জাহাজ আসে, নতুন কারখানার ভিত দেয় সরকার। তেমন কেউ জানে না রূপাই-রঙ্গতির অমর প্রেমের গল্প। কিন্তু পূর্ণিমার রাতে যখন চাঁদনী পহর আলোয় ভেসে যায় দুই কুল— নদীর ঢেউয়ের তালে মৃদু নীল আলো খেলে যায় হতাশার শ্বাস। কর্ণফুলীর জল আজো নোনতা— সেই নোনাজলে মিশে বিরহ কালের করুণ বেদনার সুর বেজে ওঠে নতুন কারো প্রাণে— তরুণ প্রেমিক যুগলের অকালবোধন।
নতুন শতকে, এক পূর্ণিমায় জোছনায় অবগাহন করবে অনল আর ঋতজা। ৭ বছরের প্রেম পরিণতি পেল, তারা বিয়ে করবে পারিবারিকভাবে। কর্ণফুলীর ধারে অনল আর ঋতজা নৌবিহারে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ করে অনল তার ঠাকুরমার কাছে শোনা এক গল্প বলে ঋতজাকে, ‘জানিস, এই মোহনায় নাকি প্রতি পূর্ণিমারাতে এক প্রেমিক মাঝি তার প্রেয়সীর প্রতীক্ষায় বাঁশি বাজাতো— আমার ঠাকুরমাদের অনেকেই নাকি দেখেছেন।’
ঋতজা হঠাৎ আতঙ্কে অনলকে জড়িয়ে ধরে। অনল হাসিতে ভেঙে পড়ে বলে, ‘আরে, এসব মিথ।’ ঋতজা সামলে নেয় নিজেকে। স্মিত হেসে বলে, ‘তুই যেন রূপাইয়ের মতো!’ অনল চমকে তাকায়, ‘রূপাই? এই নাম কী করে জানলি তুই?’ ঋতজা বলে, ‘জানি না রে, মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।’ নৌবিহার শেষে মোহনার ধারে দু’জন দু’জনের পিঠে হেলান দিয়ে বসে নীরব অহংকারে অনুভব করে ভালোবাসার প্রগাঢ়তা। হঠাৎ দূরে কোথাও নদীর ওপার থেকে আকুল পাগলপারা বাঁশির সুর ভেসে আসে। অনল আর ঋতজা থমকে তাকায় দুজনের মুখোমুখি। ঋতজা অস্ফুটে বলে ওঠে, ‘অনল, জানিস, এই সুর আমার অনেক দিনের চেনা!’ সামনে তাকিয়ে দেখতে থাকে— চাঁদের আলোয় স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জলে দূরে একটা ডিঙি, বৈঠা হাতে এক তরুণের মুখাবয়ব, তার চোখে চোখ রেখে অপলক চেয়ে থাকা প্রেয়সী রঙ্গতির মুখে চাঁদের বাঁধ ভাঙা হাসি ছলকে পড়ে।
রাত্রির নীরবতা ভেঙে অনল বলে ওঠে, ‘ডিঙি বেয়ে কারা যায়?’ ঋতজা বলে ওঠে, ‘আমরা, রূপাই আর রঙ্গতি…।’ কূলে যেন বিশাল পাহাড়সমান ঢেউ আছড়ে পড়ে। রূপাই তার বাঁশির সুরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়— বাহুবন্ধনে রঙ্গতি। ভাটির দেশের মানুষেরা রূপাইয়ের বাঁশির মাদকতায়, পরম্পরায় বেয়ে যায় তার ডিঙি নৌকা। সঙ্গে সোনার কইন্যা। মাঝির প্রেমময় বাঁশির সুর মাতায় সকলকে, যখন আষাঢ় মেঘ নামায় কূল ছাপানো ঢেউয়ের তোড়ে, প্রচণ্ড গর্জনে দেয়া ডাকে। কর্ণফুলীর জলে ভেজা গাঁয়ের নারীরা লোকগান হ’লা গেয়ে বৃষ্টি থামায়। বলে, ‘আইয়ের আঁরার লাইঠ্যাল মাঝি রূপাই দ্যাশত আইয়ের! রঙ্গতিরে ঘরত তুলিব এইবার।’ কর্ণফুলীর জলে তাদের যুগল ছায়া অনেকেই দেখেছে, রঙ্গতির হাতে সেই শঙ্খ! কেউবা বলে, ‘সাগর ফিরিয়ে দেয় না, অমর প্রেম তাদের এক করেছে মোহনায়, নদীর নোনাজলে।’ চাঁদজোছনায় ভাসানো নবীন প্রেমে মাতাল নওলকিশোর গেয়ে ওঠে, ‘এক যে ছিল সোনার কইন্যা মেঘবরণ কেশ, ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কইন্যার দ্যাশ, দুই চোখে তার আহা রে কী মায়া, নদীর জলে পড়লো কইন্যার ছায়া…!’ নীলাভ গভীর জলে রূপালী চাঁদের আলো— হৃদি ভেসে যায় কর্ণফুলীর জলে। ভাটির দেশের সোনার কইন্যার অমর প্রেমের প্রতিধ্বনি দেয়াং পাহাড় থেকে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়চূড়ার বৃষ্টিভেজা ঘন সবুজছায়ায় ছড়িয়ে পড়ে আকাশজুড়ে।