অমিয় আদক
লাড্ডুদা আমার ভাইঝির ছেলে, নাতি। সে আমায় বলে জেঠুদাদু। আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘তা লাড্ডুদা, আমি বড়োদাদু না হয়ে জেঠুদাদু কেন? তার সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘তুমি মামণির জেঠু, আমার দাদু। তাই তোমায় বলি জেঠুদাদু।’ আমি তার যুক্তিকে খণ্ডাতে পারি না। সেই দাদুভাইয়ের ভালো নাম পূর্বম। বাড়িতে তার ঠাম্মির সঙ্গে বেজায় দোস্তি। সকাল বিকাল সন্ধে কাটে ঠাম্মির কাছে। ঠাম্মি তাকে মজার গল্প বলেন। সে হেসে লুটিয়ে পড়ে। তার ঠাম্মির ছোটদের শোনানোর গল্পের ভাঁড়ার বেশ বড়ো চেহারার। কোনও মজার গল্প কিংবা রূপকথার গল্প নাতির কাছে নতুন হিসেবেই পরিবেশন করেন। নাতির স্মৃতিশক্তিও বেশ ভালো। কিছুদিন আগে বলা গল্প বিষয়ে নাতিকে জিজ্ঞাসা করেন। নাতি ঠাম্মিকে সেই গল্পের ছোট সংস্করণ শুনিয়ে দেয়। তাই ঠাম্মি নাতির গল্পবলার ঢঙও খেয়াল করেন। তাঁর বুঝতে বাকি থাকে না, নাতিও ভবিষ্যতে তাঁকে গল্প শোনাতে পারবে।লাড্ডুদা খুশির খেয়ালে ধুলোবালি নিয়েও খেলে। সারা গায়ে ধুলোবালি মেখে হাজির। একদিন তার মা তার ধুলোমাখা চেহারা দেখে বলে, ‘আমার লাড্ডু তো একটা আস্ত ভূত। বুদ্ধু কোথাকার! এতো ধুলো কেউ মাখে?’
—ধুলো নিয়ে খেলছিলাম। তাইতো গায়ে ধুলো। মামণি, আস্ত ভূত কেমন?
—এই আমার লাড্ডুবাবা যেমন।
—তাহলে কেউ ধুলো মাখলেই ভূত?
—হ্যাঁ, আর পাকামো করতে হবে না। চল, চান করতে হবে।
চান করা চলতে থাকে। আস্ত ভূত শব্দজোড়া মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। বিকেলে ঠাম্মির সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে প্রশ্নটা রাখে, ‘ঠাম্মি, আস্ত ভূত কেমন? আমাকে বলো। জানো, মামণি আমায় আস্ত ভূত বলেছে।’
—কেন? এমন সোনামণিকে মামণি আস্ত ভূত বললো কেন?
—আমি ধুলো মেখে খেলেছিলাম। তাই মামণি বলেছিলো।
—ঠিক আছে। আমি মামণিকে বকে দেবো।
—মামণিকে বকতে হবে না। আস্ত ভূত কী? তুমি সেটাই আমায় বলো।
—আস্ত বলতে বোঝায় গোটা বা পুরোপুরি। কিন্তু ভূত ব্যাপারটা তোমায় কীভাবে বোঝাই, সেটাই আমি ঠিক করতে পারছি না।
—ভূত কী? তা তুমি জানো না?
—ঠিক আছে, ব্যাপারটা তোমায় সন্ধেবেলা শুনিয়ে দেবো। এখন চলো। খালের পাড়ে পাখিগুলো কী করছে দেখে আসি।
খালের পাড়ে ফিঙে, বুলবুলি, শালিকদের খাবার খাওয়া, ওড়াউড়ি দেখে সন্ধের আগেই ঠাম্মি-নাতি ফিরে আসে। ঠাম্মির মাথায় ভূত বিষয়টা ঘুরপাক খেতেই থাকে। কীভাবে ভূত ব্যাপারটা বোঝাবেন? তা মাথায় ঢোকে খানিক পরে। লাড্ডুদার মামণির সন্ধ্যার শাঁখে ফুঁ পড়ার পরেই সে ঠাম্মিকে বলে, ‘চলো, ভূত কী, আমায় বলবে চলো।’ ঠাম্মির বিছানায় উঠে বসে। ঠাম্মি বলেন, ‘আগে একটা মন্ত্র শেখাই। সেই মন্ত্রটা বললে, ভূতের ভয় আর কাছে ঘেঁষবে না।’
—তাহলে বলো মন্ত্রটা।
—ভূত আমার পুত। পেত্নি আমার ঝি। রামলক্ষ্মণ সঙ্গে আছে। ভয়টা আমার কী?
—তাহলে আমি বলি, ভূত আমার পুত। পেত্নি আমার ঝি। রামলক্ষ্মণ সঙ্গে আছে… তারপর?
—ভয়টা আমার কী?
—তাহলে আবার বলি, ভূত আমার পুত। পেত্নি আমার ঝি। রামলক্ষ্মণ সঙ্গে আছে। ভয়টা আমার কী?
—বাঃ সুন্দর বলেছো। এবার এই কথাগুলো মনে-মনে বলতে থাকো। আমি বাথরুম থেকে এখুনি আসছি। ভয় পাচ্ছে না তো?
—না, পাচ্ছে না।
লাড্ডুদার ঠাম্মি ঘর থেকে বেরিয়ে যান। লাড্ডুদার ঠাকুর্দার ঘরে ঢোকেন। আলমারির চাবি খোলেন। খুলে বের করেন কালো কাপড়ের উপর কঙ্কাল আঁকা একটা পোশাক। লাড্ডুদার দাদু গাঁয়ের যাত্রাপালায় ভূতের অভিনয় করেছিলেন একবার। লাড্ডুদার ঠাম্মি পোশাকটা পরেন চটপট, বারান্দার আলো অফ করে দেন। মুখে চন্দ্রবিন্দু মাখানো শব্দে তিনি বলতে থাকেন, ‘হাঁউ মাউ খাঁউ, কোথা মানুষের গন্ধ পাঁউ। আঁমি লঁম্বা পাঁয়ের ভূত। খেঁয়ে হঁচ্ছে না জুত্।’ তারপর একটু লম্বা পা ফেলে ঢোকেন নিজের ঘরে। হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে কাউকে ধরার ভঙ্গিতে এগোতে থাকেন। তার সঙ্গে মুখে বলেন, ‘আঁমি লঁম্বা পাঁয়ের ভূঁত। আঁমায় দেঁখে ভঁয় পাঁচ্ছো না খোঁকা?’
বিছানায় বসে লাড্ডুদা শোনায়, ‘আমার ভয় পায়নি। আমার ঠাম্মির মন্ত্র শুনলে ভূত এমনিই পালাবে।’
—কী মন্ত্রঁ শিঁখেছো। শোঁনাও দেঁখি।
—ভূত আমার পুত। পেত্নি আমার ঝি। রামলক্ষ্মণ সঙ্গে আছে। ভয়টা আমার কী?
লাড্ডুদার ঠাম্মি পোশাকের মাথার অংশটা সরিয়ে বলেন, ‘ওরে বিচ্ছু। বেজায় মনের জোর। আমি এটাই তো চাই।’
—ঠাম্মি, তুমি এই ড্রেসটা কোথায় পেলে?
—তোমার দাদু একটা যাত্রাপালায় ভূতের অভিনয় করতো। পোশাকটা ঘরেই ছিলো। তাই দিয়েই তোমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলাম। তুমিই আমায় বোকা বানিয়ে দিলে।
—আমি কোথায় তোমাকে বোকা বানালাম? তুমি নিজেই বোকামো করেছো।
—কী বোকামো করেছি?
—আমায় ভূতের ভয় না পাওয়ার মন্ত্র শেখালে। আমি ভয় পাবো কেন? সেটা বোকামো নয়?
—মানছি সেটা আমার বোকামো। কিন্তু তোমার মনের জোর এবং ভয় না পাওয়ার জন্যেই আমি বেজায় অবাক হয়েছি।
—অবাক তুমি হতেই পারো। আমি একটুও ভয় পাইনি। এবার বলতো ঠাম্মি, ভূত কি সত্যিই আছে?
—আমি অবশ্য কখনো ভূতের দেখা পাইনি। আমিও ছোটবেলায় মিছিমিছি ভয় পেয়েছি। আমার বিশ্বাস ভূত বলে কিছুই হয় না।
তবুও আমাদের দেশের অনেক নামকরা মানুষ মরে যাওয়া মানুষের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা কতাটা সফল ছিলেন? তাও জানি না।
—তাহলে তোমার কথাই ঠিক ঠাম্মি। ভূত বলে কিছুই নেই।
লাড্ডুর মুখে তখনও মিচকে হাসি। সত্যিই আমাদের লাড্ডুদা বেজায় সাহসী।