তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
১৩.
সুরঞ্জনা
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুম চয়নে৷
প্রেক্ষাগৃহের দর্শকাসন একেবারে টায়টায় ভর্তি৷
সুরঞ্জনাদের বসার জায়গা মঞ্চের এক কোণে৷ সেখানেই আগে–পিছে করে কয়েকজন গায়ক–গায়িকা, বাচিকশিল্পী, যন্ত্রকুশলী বসে৷ সঞ্চালক আছেন মঞ্চের পাশে, সবার আড়ালে৷
যে কোনও মঞ্চে নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হলে তিল ধারণের জায়গা থাকে না৷ যে–নাচের সংস্থার অনুষ্ঠান, তাদের সংস্থায় প্রচুর ছাত্র–ছাত্রী থাকে, ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি, সংস্থার কর্ণধাররা চেষ্টা করেন যত বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে নাচের দৃশ্যে রাখতে৷ তার ফলে তাদের বাবা–মা ও অন্য অভিভাবকদের উপস্থিতি প্রায় বাধ্যতামূলক৷
প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ থাকলে কুশীলবদের ভিতরেও বিরাজ করে এক ধরনের ভালো–লাগা৷
তৃতীয় ঘন্টি বাজার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী সঞ্চালক, লাবণ্য চ্যাটার্জি শুরু করলেন ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যের পশ্চাৎপট৷ ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাট্যকাব্য লেখার চুয়াল্লিশ বছর পরে লেখাটিকে নৃত্যনাট্যে রূপান্তর করেন রবীন্দ্রনাথ৷ সেই ইতিহাস বিবৃত করে বললেন, এই নৃত্যনাট্য ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত মণিপুরী পদ্ধতির উপর গড়ে উঠেছিল৷ আর মালাবার প্রদেশ, বাংলা ও অন্যান্য দেশের লোকনৃত্যও৷ ছিল কথাকলিরও অংশ৷ তখনও কথাকলি নৃত্যের শিক্ষক ছিল না শান্তিনিকেতনে, পরে উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়ার পর নৃত্যনাট্য আবার ঢেলে সাজানো হয়েছিল, বিশেষ করে অর্জুনের ভূমিকায় কথাকলি নৃত্যপদ্ধতি বেশ খানিকটা প্রাধান্য পেল অন্যান্য নাচের সঙ্গে৷ আমরা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই পরিবেশন করছি এই নৃত্যনাট্য৷ আরও একটা ঘোষণা৷ চিত্রাঙ্গদা ও অর্জুনের সংলাপ অংশে আমরা কিছুটা সংগীত রেখেছি, কিছুটা আবৃত্তি৷
সঞ্চালকের কথা শেষ হতেই মঞ্চের উপর থেকে সরে গেল পর্দা৷ শুরু হল চিত্রাঙ্গদার শিকার আয়োজন৷ শুরু হল গান :
গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে পর্বতশিখরে
মঞ্চে তখন বহু নৃত্যপটিয়সী রঙিন পোশাকে আবৃত হয়ে সৃষ্টি করছে বর্ণময় ছবির পর ছবি৷ চিত্রাঙ্গদার সখীদের কৌতুকে অপামনিত অর্জুন চলে যেতে চিত্রাঙ্গদা তখন দুঃসহ প্রেমে জর্জরিত৷ দুরন্ত নৃত্যে সেই ভূমিকায় এক সুন্দরী তরুণী অপালা৷ কিন্তু মেক–আপ রুমে এখন কিছুটা অসুন্দরী করা হয়েছে অপালাকে৷
সুরঞ্জনা অনুভব করল তার পাশে বসা তমোনাশ বাঁ–হাত রেখেছে তার ডান হাতের উপর৷ যদিও এই দৃশ্য চোখে পড়বে না কারও, তবু সুরঞ্জনার কিছুটা অস্বস্তি৷ কিন্তু এত ঠাণ্ডা কেন তমোনাশের হাতের চেটো৷ আসলে এই শীতলতা উত্তেজনা ও শঙ্কার কারণে৷ বড়ো অনুষ্ঠানের শুরুতে নবীন শিল্পীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটে থাকে এরকমটা৷
ততক্ষণে সুরঞ্জনার গানের পালা, তমোনাশের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে গাইতে শুরু করল:
ভাসায়ে দিব আপনারে ভরা জোয়ারে
সকল–ভাবনা–ডুবানো ধারায় কবির স্নান৷
মঞ্চে তখন নাচের অবর্ণনীয় রং ঘুরে চলেছে চক্রাকারে৷ অর্জুন যতই বলছেন তিনি বরণযোগ্য নন, ব্রহ্মচারী ব্রতচারী, তাঁর পক্ষে চিত্রাঙ্গদার প্রেম গ্রহণ করা অসম্ভব, চিত্রাঙ্গদা তাতে অনড়৷ অর্জুনের পৌরুষে ও সৌন্দর্যে সে পাগলপারা৷
সুরঞ্জনা তখন গাইছে চিত্রাঙ্গদার গান :
রোদনভরা এ বসন্ত, সখী
কখনও আসেনি বুঝি আগে৷
মোর বিরহবেদনা রাঙালো কিংশুকরক্তিম রাগে৷
অর্জুনকে দেখে চিত্রাঙ্গদা এতটাই প্রেমে নিমগ্ন হলেন যে, তাঁকে ছাড়া তার জীবন তখন ব্যর্থ৷ চিত্রাঙ্গদা তখন উপলব্ধি করল তার কুরূপের কারণেই অর্জুন এভাবে এড়িয়ে যেতে চাইছে তাকে৷ বাধ্য হয়ে চিত্রাঙ্গদা মদনের শরণাপন্ন হয়ে রূপবতী হয়ে এল অর্জুনের সামনে৷
কুরূপা চিত্রাঙ্গদা তখন সুরূপা চিত্রাঙ্গদা৷ সে তখন নিজের রূপ দেখে নিজেই মোহিত৷ বলছে:
এ কী দেখি৷
এ কে এল মোর দেহে
পূর্ব–ইতিহাস–হারা৷
আমি কোন গত জন্মের স্বপ্ন
শুধু কি সুরূপাই হল চিত্রাঙ্গদা৷ তার শরীরেও তখন জেগে উঠেছ ভালোবাসার আর্তি৷ প্রবল রোমাঞ্চ শরীরে নিয়ে চিত্রাঙ্গদা তখন মঞ্চে ঝড় তুলছে৷
পরের গান ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি’৷ তমোনাশের স্মরণে এল গানটি রচনার একটি ইতিহাস বলেছিল সুরঞ্জনা, তমো, ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি’ এই গানটি একদিন ঘুমের মধ্যে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ সেই যে ঘুম ভাঙল, তারপর সারারাত আর ঘুমোননি৷ মধ্যরাতে জেগে–জেগে তার বাকি কলিগুলো গুনগুন করে গাইতে থাকেন৷ গানের সুর আর অমার্জিত ভাষা নিয়ে কাটালেন বাকি রাত৷ কিছু ভাবছেন, আবার ভুলছেন, আবার মনে মনে ভাঁজছেন৷ সেদিন ভোরে বিছানা থেকে উঠেই গানটি লিখতে শুরু করেন৷ কী আশ্চর্য, সকালে উঠে গানের কিছুটা বিস্মৃত হয়েছিলেন, বাধ্য হয়ে লিখলেন অন্য কোনও কলি৷ মঞ্চে তখন সুরঞ্জনার গান:
আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি
আনন্দে বিষাদে মন উদাসী
পুষ্পবিকাশের সুরে দেহ মন উঠে পুরে,
কী মাধুরীসুগন্ধ বাতাসে যায় ভাসি৷
মদনদেবের আশীর্বাদে তখন বদলে গেছে চিত্রাঙ্গদা, সেই রূপসীকে দেখে অর্জুন তার প্রেমে পড়লেন, নিজের মনে বললেন:
কাহারে হেরিলাম আহা
সে কি সত্য, সে কি মায়া
সে কি কায়া,
সে কি সুবর্ণকিরণে–রঞ্জিত ছায়া
যে-চিত্রাঙ্গদাকে দেখে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন অর্জুন, রূপবতী চিত্রাঙ্গদাকে দেখে বদলে গেল তাঁর হৃদয়৷ অকুণ্ঠচিত্তে জানালেন তাঁর প্রেম৷ তাকে জানালেন সে কথা৷ বললেন:
‘হে সুন্দরী, উন্মথিত যৌবন আমার
সন্ন্যাসীর ব্রতবন্ধ দিল ছিন্ন করি৷’
চিত্রাঙ্গদা কিন্তু নিজের আদত রূপ নিয়ে সজাগ৷ সে জানে তার প্রকৃত রূপ দেখলে অর্জুন আর কোনও মতেই আকৃষ্ট হবেন না তার প্রতি৷ শঙ্কিত হয়ে জানাতে চাইল:
সে আমি যে আমি নই, আমি নই––
হায় পার্থ, হায়,
যাও যাও ফিরে যাও, ফিরে যাও বীর৷
অর্জুন তখন ফিরবেন কি, চিত্রাঙ্গদার রূপ দেখে প্রেমে উন্মাদ৷ চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে তার দ্বৈত নৃত্য৷
যতবার গানের বিরতি দিচ্ছে সুরঞ্জনা, তমোনাশ তার হাত রাখছে সুরঞ্জনার হাতে৷ সেই একইরকম ঠান্ডা, ত্রস্ত হাত৷
সুরঞ্জনা ফিসফিস করে বলল, তমো, এখন নার্ভাস হলে আর গান গাইতে পাররে না৷ বি চিয়ারফুল৷ অর্জুন আর চিত্রাঙ্গদা দু’জনেই এখন প্রেমের রোমাঞ্চে উৎফুল্ল৷ নাও, শুরু করো:
দ্বৈতকণ্ঠের গান শুরু হতে তমোনাশ ছেড়ে দিল হাত৷ দুজনে তখন গাইছে:
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুম চয়নে৷
সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে––
নয়নে, নয়নে৷
সুরঞ্জনার খুব প্রিয় গান এটি৷ তার কণ্ঠের এই গান খুব প্রিয় ছিল চিত্রজিতেরও৷ অনেকদিন আগে অন্য একটি সংস্থার উদ্যোগে ‘চিত্রঙ্গাদা’ নৃত্যনাট্যে অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার এই দ্বৈতসংগীত খুব দরদ দিয়ে গাইত সুরঞ্জনা৷ অর্জুনের কণ্ঠের গান গাইত ওদের দলের সন্ময়৷ সেবার সুরঞ্জনার অনুরোধে চিত্রজিৎ অর্জুনের কিছু সংলাপ পাঠ করেছিল সুরঞ্জনার পাশে বসে৷ এখন সেখানে বসে আছে তমোনাশ৷
দেখিতে দেখিতে নূতন আলোকে
কে দিল রচিয়া ধ্যানের পুলকে
নূতন ভুবন নূতন দ্যুলোকে মোদের মিলিত নয়নে––
নয়নে, নয়নে৷
দুই প্রেমিক–প্রেমিকার মনের মিলন তখন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে বয়ে যাচ্ছে দ্বৈত নৃত্যের ছন্দে৷ নৃত্যের ভূমিকায় দুই যুবক–যুবতীর রোমাঞ্চে উদ্বেল হওয়া শরীরে উঠছে রঙের তরঙ্গ৷ প্রেক্ষাগৃহে বয়ে যাচ্ছে উল্লাসের হিল্লোল৷ নতুন আলোয় কে রচনা করল ধ্যানের পুলক নতুন ভুবনে নতুন দ্যুলোকে মিলে গেছে দু’জনের চোখ৷
দ্বৈতকণ্ঠে তখন গাইছে সুরঞ্জনা ও তমোনাশ৷ কার কণ্ঠে বেশি উচ্ছ্বাস তা নিয়ে ওজন করলে হয়তো তমোনাশের দিকটাই ভারী৷
বাহির আকাশে মেঘ ঘিরে আসে, এল সব তারা ঢাকিতে৷
হারানো সে আলো আসন বিছালো শুধু দুজনের আঁখিতে—
আঁখিতে আঁখিতে৷
বাইরের আকাশে তখন মেঘ উদয় হয়ে ঢেকে দিচ্ছে সব নক্ষত্র৷ সেই হারানো আলো এসে বসল দু’জনের চোখে৷
ভাষাহারা মম বিজন রোদনা
প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা,
চিরজীবনের বাণীর বেদনা মিটিল দোঁহার নয়নে—
নয়নে, নয়নে৷৷
এই প্রেমবন্ধনের কোনও ভাষা নেই, তার কান্না প্রকাশিত হয়ে সারা জীবনের যে–বেদনা তা এসে মিলেছে দু’জনের চোখের ভাষায়৷
অর্জুন বলছেন, রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদা না জানি তিনি কত সুন্দর!
চিত্রাঙ্গদা শঙ্কিত হয়ে বলছে :
ছি ছি কুৎসিৎ কুরূপা সে৷
হেন বঙ্কিম ভুরুযুগ নাহি তার৷,
হেন উজ্জ্বলকজ্জ্বল আঁখিতারা৷
সুরঞ্জনা গাইছে, আর মঞ্চের চিত্রাঙ্গদা তখন তার তন্বী দেহলতার নৃত্যভঙ্গিমায় সৃষ্টি করছে এক অনির্বচনীয় রূপ৷ শরীরের ভঙ্গিমায় প্রকাশ করছে এক নারীর যন্ত্রণাকাতর আত্মগ্লানির রূপ, সেই অভিব্যক্তি যে কত সুন্দর হতে পারে তা–ই ফুটিয়ে তুলছে নৃত্যের মাধ্যমে৷ এই গানে সুরঞ্জনার গানের ভূমিকা যেমন অতুলনীয়, তেমনই নৃত্যশিল্পী চিত্রাঙ্গদার ব্যাকুল আকুতির বেদনাময় প্রকাশ৷ সুরের ভূমিকা এখানে বাঙ্ময় রূপকে উদঘাটিত করা ও নৃত্যের ভূমিকা তাকে ছন্দোময় করে তোলা৷
চিত্রাঙ্গদা ক্রমে উপলব্ধি করেছে অর্জুন তার এই সুরূপকে গ্রহণ করেছে ঠিকই, কিন্তু এখন যদি সে ফিরে যায় তার পূর্ব–চেহারায়, অর্জুন কিছুতে আর তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না৷
সুরঞ্জনা গাইছে সাহানা রাগাশ্রিত, ত্রিতালে নিবদ্ধ গানটি যাতে চিত্রাঙ্গদা প্রকাশ করছে তার নারীত্বের অহংকার :
আমি চিত্রাঙ্গদা, রাজেন্দ্র নন্দিনী৷
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী৷
চিত্রাঙ্গদা তখন ফিরে পেয়েছে নিজের উপর পূর্ণ আস্থা৷ অর্জুনের সঙ্গে ছলনা না করে সামনে নিয়ে এসেছে প্রকৃত সত্য৷
ঠিক এই মুহূর্তে তমোনাশ হঠাৎ স্পর্শ করল সুরঞ্জনার হাত, বলল, সুরঞ্জনাদি, আমি কি অসুন্দর?
সুরঞ্জনা বলল, সে কি তুমি কেন অসুন্দর হতে যাবে! তোমার এত সুন্দর চেহারা মানুষ অসুন্দর হয় মনে৷
সুরঞ্জনা উপলব্ধি করল তমোনাশের হাতে কীরকম অস্থিরতা৷ বলল, তমো, তুমি শান্ত হও৷
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়