প্রহরশেষের রাঙা আলোয়

কাল্পনিক চিত্র

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯.
তমোনাশ

ন্যায়–ন্যায় জানি নে জানি নে জানি নে


দেওয়াল ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি শুনে তমোনাশ অনুমান করতে পারে বাইরের পৃথিবীতে এখন আলো, না অন্ধকার— আলো থাকলে ঠিক কতটা আলো৷
আজও ট্রিরিং-ট্রিরিং শব্দে বুঝল বিকেল তখনও ফুরিয়ে যায়নি৷ এক অদ্ভুত মন-খারাপ নিয়ে অপেক্ষা করছে সুমিতাভর৷ অনেকদিন তার কাছে আসেনি সুমিতাভ৷ তার কাজের চাপ বেড়ে গিয়েছে, এমনই বলেছিল ফোনে৷ আজ সকালে বলল, ছুটি আছে আজ, সন্ধের পর তোর কাছে যাব৷
তমোনাশ বলল, যাক৷ এতদিন পরে মনে পড়েছে৷

সন্ধের ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠলে তমোনাশের অপেক্ষা আরও তীব্রতর হয়৷ ফ্ল্যাটের দরজায় কলিং বেল বেজে ওঠে৷ তমোনাশ ধীর পায়ে খুলে দিল দরজা, বলল, কী সৌভাগ্য আমার৷
—তমো, সৌভাগ্য আমার৷ তুই এখন গানের জগতের সেলিব্রিটি৷ কাগজে তোর ছবি দিয়ে খবর বেরোচ্ছে৷ গর্বে ভরে ওঠে আমার বুক৷
তমোনাশ জানত না বিষয়টা। বলল, কোথায় বেরিয়েছে?
—দৈনিক জনমানস-এ৷ তোরা ইছামতীতে ‘বর্ষামঙ্গল’ উৎসবে গান গাইতে গিয়েছিলি, সেই খবর, তার সঙ্গে একটা মজাদার খবর বেরিয়েছে৷
তমোনাশের বুকের ভিতর ধক করে উঠল, কী লিখেছে?
—জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন রোদ্দুরে জমির বুক ফেটে দশচির, তখন তোরা গান গেয়ে বৃষ্টি নামিয়েছিস৷ শাস্ত্রীয় সংগীতের বিখ্যাত শিল্পী তানসেন নাকি দীপক রাগ গেয়ে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন৷ আর এতকাল পরে সুরঞ্জনা বসু আর তমোনাশ গুপ্ত জুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে একই ঘটনা ঘটিয়েছেন।
তমোনাশ তেমন উৎফুল্ল হল না, বলল, সবই হয়েছে সুরঞ্জনাদির জন্য৷ আমার কোনও কৃতিত্ব নেই৷ সুরঞ্জনাদি বলেছিলেন, তিনি বর্ষার গান গাইলে নাকি বৃষ্টি আসে৷
—একটা পত্রিকায় সুরঞ্জনাদির ইন্টারভিউ ছাপা হয়েছে৷ তাতে উনি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে ঈশ্বরের মতো৷ রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা জানালে তিনি তা পূরণ করেন৷ একবার নাকি উনি রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, মাত্র দু’মিনিটের জন্য তাঁঁর পায়ের কাছে বসে থাকতে চান৷ রবীন্দ্রনাথ সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন৷
—সে কী! কীভাবে তা সম্ভব?
—সম্ভব হয়েছিল বাস্তবে নয়, স্বপ্নে৷ গভীর রাতে উনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই বিখ্যাত কালো জোব্বা পরে এসেছেন ওঁনাদের ফ্ল্যাটে৷ দাড়িগোঁফের ভিতর দিয়ে উদ্ভাসিত হচ্ছে মৃদু হাসির রেখা৷ এসে বসেছেন সুরঞ্জনাদির ঘরের চেয়ারে৷ আর সুরঞ্জনাদি মেঝের উপর বসেছেন তাঁর পায়ের কাছে৷ বলেছেন, ঘুম ভাঙার পরেও যেন উনি টের পাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি৷
তমোনাশ চুপ করে রইল৷

অনেকক্ষণ পরে সুমিতাভর খেয়াল হল তমোনাশের দিক থেকে তেমন সাড়া পাচ্ছে না৷ বলল, কী হল, তোকে আজ যেন বিমর্ষ লাগছে৷ কী হয়েছে?
তমোনাশ বলল, না তো, কিছু হয়নি।
সুমিতাভ হঠাৎ বলল, সুরঞ্জনাদি দেখলাম একটা গ্রুপের সঙ্গে ‘বাইশে শ্রাবণ’ অনুষ্ঠানে গান গাইছেন, অবশ্য আরও অনেকের সঙ্গে৷ রবীন্দ্রসদনের সামনে ছবি দিয়েছে সবার৷
তমোনাশ একটু বিস্মিত হল, তাই নাকি!
—হ্যাঁ৷ তোকে কিছু বলেননি?
তমোনাশ ঘাড় নাড়ে, না৷
—তা হলে মনে হয়, ওদের গ্রুপের শিল্পীরাই চান্স পেয়েছে৷ বাইরের কাউকে নেয়নি৷
তমোনাশ একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি তা বাইরের লোক-ই।
সুমিতাভ তাকে সান্ত্বনা দিতে বলল, তোর যা নামডাক হয়েছে, তাতে এরপর কেউ আর তোকে বাইরের লোক বলে বাদ দিতে পারবে না৷
তমোানাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷
এ-কথা, সে-কথার পর সুমিতাভ বলল, আজ উঠি, তমো৷ রাত হয়ে আসছে৷

সুমিতাভ চলে যাওয়ার পর তমোনাশের অন্ধকার পৃথিবীতে আরও একটু আঁধার ভরে আসে৷ কীরকম নিঃস্ব লাগে চারপাশ৷ একটা আলোর রেখা তার সামনে এসেও মিলিয়ে গিয়েছে আচমকা৷ তারই মুহূর্তের ভুলে৷ তার একা-থাকার পৃথিবী এখন আর খুঁজে পায় না সেই আলোর রেখা৷ হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেও ইচ্ছে করে না৷
হঠাৎ একদিন সকালে ফোন বাজতে মোবাইল অন করে বলল, হ্যালো—
—আমি ‘রবি-অনুরাগ’ সংস্থার রত্নদীপ বলছি।
তমোনাশের বুকের ভিতর আনন্দের হিল্লোল, বলুন—
—অক্টোবরের দু’তারিখ কি আপনি ফ্রি আছেন?
তমোনাশের এখন সব দিনই ফাঁকা, বলল, কেন বলুন তো?
—রবীন্দ্রসদনে কবিগুরুর ‘শ্যামা’ অভিনয়ের আয়োজন করেছে ‘রাবীন্দ্রিক’ গোষ্ঠীর সচকিতা রায়চৌধুরি৷ তার নির্দেশনায় মহলা চলছে এখন৷ আপনি যদি বজ্রসেনের মুখের গানগুলি ওই দিন মঞ্চে গেয়ে দেন আমরা গর্বিত হব৷
তমোনাশেকে ঘিরে ধরা অন্ধকার গভীরতর হল আরও৷ ‘শ্যামা’-র গান শুনেছে ইউটিউবে৷ কিন্তু গানগুলি তার তোলা নেই৷ রত্নদীপবাবুকে বলতেই হল কথাটা, আপনি অন্য কাউকে বলুন৷

রত্নদীপবাবু বললেন, এটা কোনও ব্যাপারই নয়৷ এখনও একমাসের বেশি সময় আছে৷ সচকিতা রায়চৌধুরী শুধু ভালো সংগঠকই নন, উনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভালো গায়িকাও৷ সারাক্ষণ গান নিয়েই থাকেন৷ যত অনুষ্ঠান করেন সবই রবীন্দ্রনাথ-কেন্দ্রিক৷ গত বছর করেছিলেন ‘চণ্ডালিকা’৷ প্রকৃতির সব গান উনিই গেয়েছিলেন৷ গান করতে গিয়ে শেষপর্যন্ত বিয়েটাও করে উঠতে পারেননি আজও৷ অথচ কী সুন্দর দেখতে ওঁকে৷ এবার ঠিক করলেন ‘শ্যামা’ করবেন৷ তখন থেকে বলছেন, বজ্রসেনের গান এবার তমোনাশ গুপ্তকে দিয়েই গাওয়াব৷ গেলবার বসন্ত উৎসবে আপনার কছেই বসেছিলেন মঞ্চে৷ আপনার গান শুনে তখন থেকেই আপনার ফ্যান৷ এবার প্রথম থেকে বলে আসছেন তমোনাশ গুপ্তকে আমরা আনবই৷
—আমার কাছেই বসেছিলেন!
—হ্যাঁ৷ ফাংশনের পর আমাকে বলেছিলেন আলাপ করিয়ে দিতে৷ কিন্তু ভিড়ের মধ্যে হয়ে ওঠেনি৷ উনি বলেছেন আপনি রাজি হলে আপনার ফ্ল্যাটে এসে গানগুলো তুলে দিয়ে যাবেন৷
তমোনাশ আপ্লুত হয়ে বলল, আমার ফ্ল্যাটে আসবেন উনি?
—নিশ্চয় আসবেন৷ আপনার পক্ষে তো রোজ রোজ মহলার ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়৷
তমোনাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তা হলে তাই হোক৷
—আপনার ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি ওঁকে৷ উনিই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবেন৷
ফোন রেখে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল তমোনাশ৷ ভাবল সুমিতাভকে ফোন করে বলবে কি না ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য পড়ে শোনাতে৷
এমন ভাবা-ভাবির মধ্যে হঠাৎ একটু পরেই বেজে উঠল ফোন, তমোনাশ বলল, বলুন৷
—আমার নাম সচকিতা রায়চৌধুরি৷ রত্নদীপবাবু আপনার নম্বর দিয়ে বললেন কথা বলতে৷
তমোনাশ কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না৷ কী সুন্দর কণ্ঠস্বর সচকিতার৷ একটু পরে বলল, হ্যাঁ, রত্নদীপবাবু আমাকে সব বলেছেন৷
—আপনি সময় দিলে আমি বজ্রসেনের গানগুলো নিয়ে আলোচনা করব৷
—আমি তো সারাক্ষণ একাই থাকি, মিস রায়চৌধুরি৷ আপনার যখন খুশি আসতে পারেন৷
ওপাশ থেকে খিলখিল হাসির শব্দ, মিস রায়চৌধুরি বললে, কীরকম সাহেবি সম্ভাষণ মনে হয়৷ আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল আপনি আমার চেয়ে একটু বড়োই হবেন৷ আমাকে সচকিতা বলে ডাকলেই আমি খুশি হব৷ আর তুমি বলবেন৷
তমোনাশ হেসে বলল, তাই হবে৷
—তা হলে আজ বিকেলে পাঁচটা নাগাদ যদি যাই।
—তাই এসো৷
বিকেল পাঁচটার একটু পরেই তমোনাশের কাছে এসে পৌঁছল সচকিতা৷ তমোনাশ তাকে নিয়ে এসে চেয়ারে বসতে বলে বলল, তোমার গায়ের গন্ধ খুব অন্যরকম৷
সচকিতা একটু অবাক হয়ে বলল, কীরকম?
—অনেকটা কামিনী ফুলের গন্ধের মতো৷
সচকিতা আরও বিস্মিত হল, হেসে বলল, আমি একটা দামি পরফিউম মেখেছি ঠিকই, তার গন্ধ কামিনী ফুলের মতো নয়৷ সামান্য ঝাঁজ–মেশানো মিষ্টি একটা গন্ধ৷ আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় তা–ই বলে৷
—সচকিতা, আমার একটা ইন্দ্রিয় একেবারেই নেই৷ বোধহয় তার পরিবর্তে আমার অন্য ইন্দ্রিয়গুলি একটু বেশি প্রখর৷ আমি প্রত্যেক মানুষের গায়ের গন্ধ আলাদা করে চিনতে পারি৷ প্রত্যেকের নিঃশ্বাসের শব্দ আলাদা করে বুঝতে পারি৷ চেনা কারও পায়ের শব্দ শুনে চিহ্নিত করতে পারি তাকে৷

সচকিতা গভীর বিস্ময়ে শুনছিল তমোনাশের কথা৷ বলল, তমোনাশদা, আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না এরকমটা হতে পাারে৷ আমি আপনাকে দেখার পর থেকে প্রতিদিন ভেবেছি আলাপ করব৷ কিন্তু সাহস হত না৷ আপনি কলকাতার মঞ্চে যেখানে যত প্রোগ্রাম করেছেন, আমি আপনার কাছে-কাছে থেকেছি৷ গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি৷ কিন্তু সুরঞ্জনাদি আপনাকে এত আগলে-আগলে রাখেন যে, আলাপ করার সুযোগই ঘটেনি৷ তাই ‘শ্যামা’ করব ভাবতেই ঠিক করেছি আপনিই হবেন বজ্রসেন৷ কিন্তু নিজে বলতে সাহস পাইনি৷ শুনেছিলাম আপনি সুরঞ্জনাদি ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে প্রোগ্রাম করেন না৷ তাই রত্নদীপদাকে দিয়ে অনুরোধ জানালাম৷ আপনি রাজি হতেই চলে এলাম আজই৷ এখন থেকে আমার কোনও অনুষ্ঠান আপনাকে ছাড়া করব না৷ আপনি জানেন না আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি৷ এতদিনে বলার সুযোগ পেলাম৷ অন্যায় আবদার কি না বলতে পারব না, কিন্তু এখন থেকে শুধু আমার অনুষ্ঠানে আপনি গাইবেন৷ সুরঞ্জনাদি আপনার জন্য যা করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি আমি করব৷ আপনি শুধু হ্যাঁ বলুন৷

তমোনাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে৷ সুরঞ্জনাদির সঙ্গে কতদিন কথা হয়নি৷ ইছামতী থেকে ফেরার পর সেও আর ফোন করেনি৷ সুরঞ্জনাদিও না৷ কী এক দুর্লঙঘ্য সঙ্কটের জটাজালে আটকে গিয়েছে দু’জনের কাছাকাছি হওয়া৷ এতদিনের একটা সম্পর্ক এখন না-সম্পর্কের সীমান্তে৷

কিন্তু তমোনাশ এখন কী করবে! বাধ্য হয়ে বলল, বজ্রসেনের কণ্ঠে অনেক গান৷ কী করে গাইব!
—আপনি একটুও ভাববেন না, তমোনাশদা৷ আমি সপ্তাহে তিনদিন করে আসব আপনার কাছে৷ একটা-একটা করে সব গান তুলে দেব৷
—তুমি আসবে! তা হলে আমি ঠিক পারব৷
—অবশ্যই পারবেন৷ আপনার গান আমি প্রতিবার আপনার পাশে বসে শুনেছি৷ মন্দ্রকণ্ঠের অধিকারী আপনি৷ আমি জানি, একবার-দু’বার গাইলেই আপনি তুলে নেবেন৷ আপনি বুঝতে পারতেন না, আপনার একদম কাছে বসে থাকতাম৷ একদিকে সুরঞ্জনাদি, অন্যদিকে আমি৷
—সচকিতা, তুমি যে কাছে-কাছে ছিলে তা এখন বুঝতে পারছি৷ মঞ্চে বসে প্রতিবার বুঝতাম কেউ একজন আছে যার গায়ে কামিনী ফুলের গন্ধ৷
সচকিতা অবিশ্বাসের গলায় বলল, সত্যি বুঝতে পারতেন!
—এও বুঝতে পারতাম সে এমন শাড়ি পরে আসে, নড়াচড়া করার সময় খসখস শব্দ হয়৷
সচতিকা আপ্লুত হয়ে বলল, ঠিক বলেছেন৷ রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান হলে আমি তসরের শাড়ি পরি৷ তসরের শাড়িতেই ওই শব্দটা হয়৷ উফ, তমোনাশদা আপনি একদম জিনিয়াস৷
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তমোনাশ বলল, যার চোখে দৃষ্টি নেই সে কী করে জিনিয়াস হতে পারে!
—পারে, পারে, তমোনাশদা৷ আপনার যে–ইন্দ্রিয় নেই, আজ থেকে আমি আপনার সেই ইন্দ্রিয়৷
তমোনাশ বুঝতে না পেরে বলল, তার মানে?
—আপনার সব আছে, শুধু চোখদুটোই নেই৷ আজ থেকে আমিই আপনার সেই দুটো চোখ৷
তমোনাশকে একরাশ বিভ্রান্তির মধ্যে রেখে সচকিতা বেরিয়ে যেতে যেতে গাইল :
ন্যায় অন্যায় জানি নে, জানি নে, জানি নে,
শুধু তোমারে জানি

(ক্রমশ)

অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়