প্রহরশেষের রাঙা আলোয়

কাল্পনিক চিত্র

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

১৮.
সুরঞ্জনা

তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্ত রাতে


‘ইছামতী’র অনুষ্ঠান সেরে কলকাতা ফেরার পর কী এক ঘোর বিষণ্ণতায় নীরব, অন্তর্লীন হয়ে আছে সুরঞ্জনা৷ তমোনাশ হঠাৎ এমন এক বিপ্রতীপ কাণ্ড ঘটাতে চাইবে, তা অনুমান করেনি একবারও৷ তমোনাশ রবীন্দ্রগানের এক সম্ভাবনাময় আধার৷ একবার-দু’বার ধরিয়ে দিলেই বেশ শক্ত গানও তুলে নিতে পারে অনায়াসে৷

ইছামতীতে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছিল কলকাতায় তাদের জুটির যে জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে, তা আরও বহু গুণে প্রচারিত কলকাতার বাইরে৷ মফস্বলের শ্রোতারা তাদের দিকে তাকায় এমন সপ্রশংস দৃষ্টিতে যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন দেবদেবী৷

তাদের সেই ঐশী অবস্থানে অবশ্যই ভাঙচুর ঘটবে যদি শ্রোতারা তাদের আচার-আচরণে খুঁজে পায় কোনও নৈতিক স্খলন৷

আশ্চর্য এই যে, কলকাতা ফেরার পথে তমোনাশ একটিও কথা বলেনি তার সঙ্গে৷ গাড়ি থেকে নামার সময় কোনও ‘আসি’ সম্ভাষণও ছিল না৷ সেই মুহূর্তের পর থেকে এখনও পর্যন্ত একটি ফোনও করেনি৷
তমোনাশ কি ভাবতে পারেনি সুরঞ্জনা এভাবে প্রত্যাখ্যান করবে তাকে!

আজ সারাদিন সুরঞ্জনা কাটিয়েছে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতার মধ্যে৷ সন্ধের পর হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে, অথচ ইচ্ছে করছে না গাইতে৷ এরকমটা হয় না তার৷ রবীন্দ্রগানের সঙ্গে তার এমনই গাঁটছড়া বাঁধা যে, সাংসারিক কাজের বাইরে সবটুকু সময় সে অবগাহন করে সুরের মধ্যে৷
কিন্তু আজ একটুও ইচ্ছে করছিল না হারমোনিয়াম নিয়ে বসতে৷

তমোনাশ, মানুষের জীবনে প্রেম এক অসাধারণ সৌন্দর্যের অনুভূতি৷ প্রেম মানুষের জীবনের এক ভিতর-সত্তা৷ তাকে লালন করতে হয় অতি সন্তর্পণে৷ তিলে তিলে তাকে গড়ে তোলা যত কঠিন, তাকে এক মুহূর্তে ভেঙে ফেলা অনেক সহজ৷ তুমি কি গত কয়েক মাসে একবারও অনুভব করোনি রবীন্দ্রনাথ কী সাংঘাতিকভাবে জুড়ে আছেন আমার হৃদয়৷ তাঁর এক-একটি গান কীভাবে বিন্দু বিন্দু প্রেম হয়ে জড়িয়ে আছে আমার সমস্ত সত্তায়৷ একজন স্বর্ণকারিগর যেমন নিখুঁতভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাল নীল সবুজ পাথর দিয়ে মিনে করে অলংকারের সর্বাঙ্গে, তেমন রবীন্দ্রগানের এক-একটি কলি মিশে আছে আমার মেধামজ্জায়৷

সারাদিন ম্রিয়মান থাকার পর সন্ধের পর হারমোনিয়াম টেনে বসল, অনেক ভেবেচিন্তে মনে এল কাফি-কানাড়া রাগের এই গানটি:
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্ত রাতে৷
আমার ভাঙল যা, তা ধন্য হল চরণপাতে৷৷
আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমণির হারে,
বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে৷৷

তমোনাশ যেমন তাকে ফোন করেনি, সেও করেনি৷ তমোনাশের মনে যে-ইচ্ছেই থাকুক, যেরকম বাসনাই থাকুক, সুরঞ্জনা প্রশ্রয় দেবে না তাকে৷

তমেনাশ, ইছামতী থেকে বিধ্বস্ত মনে ঘরে ফেরার পর তোমার কথাই ভাবছিলাম বারবার৷ ভাবছিলাম তোমাকে হঠাৎ পেয়েছিলাম রবীন্দ্রগানের এক পরিপূর্ণ আধার হিসেবে৷ তোমাকে তৈরি করছিলাম মনের উচ্ছ্বাস মিশিয়ে৷ আমি রবীন্দ্রনাথের এক প্রেমিকা৷ তোমাকেও চেয়েছি রবীন্দ্রনাথের আর এক প্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে৷ অথচ তুমি তা মান্য করলে না, তুমি সেই সুন্দর সম্পর্ককে ভেঙে দিলে এক মুহূর্তে৷ আমার সেই ব্যথা-বেদনা এক রক্তমণির হার হয়ে গোপনে দুলছে আমার বুকের গভীরে৷

তুমি কোলে নিয়েছিলে সেতার, মীড় দিলে নিষ্ঠুর করে—
ছিন্ন যবে হল তার ফেলে গেলে ভূমি ’পরে৷
নীরব তাহারি গান
আমি তাই জানি তোমারি দান—
ফেরে সে ফাল্গুন–হাওয়ায়–হাওয়ায়
সুরহারা মূর্ছনাতে৷

ভালোই হয়েছে তমোনাশ৷ তোমার হাতে যে-সেতার তুলে দিয়েছিলাম, ভরিয়ে দিয়েছিলাম গানের ডালি দিয়ে, তুমি তাতে নিষ্ঠুর মীড় দিয়ে ছিন্ন করে দিলে তার৷ সেই তার এখন লুটিয়ে আছে ভূমির উপর৷ সেই গান তো আর উচ্চকিত স্বরে গাওয়া হল না৷ নীরব গানের সুর তোমার দান বলেই ধরে নিচ্ছি৷ সেই সুরহারা মূর্চ্ছনা এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে বসন্ত-হাওয়ার মতো৷

এখন সন্ধে পেরিয়ে রাতের প্রহর শুরু৷ চিত্রজিৎ আজ সারাদিন ঘরে নেই৷ কোথাও গিয়েছে, দূরে কোথাও৷ দরজায় তালা লাগিয়ে নীচে নেমে গাড়িতে ওঠার পর গাড়ির দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনতে পেয়েছিল সকালে৷ সুরঞ্জনাকে বলেও যায়নি৷ বলে যাওয়া-যাওয়ির পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছে কিছুকাল আগেই৷ এখন শুধু এক ছাদের নীচে নিঃশব্দ অতিবাহন৷ কাজের মেয়েটা রান্না করে সবকিছু দু’ভাগ করে রেখে যায় ডাইনিংয়ের স্ল্যাবে৷ যার যখন সময় হয়, সেখান থেকে নিয়ে যায় নিজেদের ঘরে৷

এ এক অদ্ভুত যাপনচিত্র৷
এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে বোধ হয় আরও বহু বাড়িতে বা ফ্ল্যাটে এরকম জীবনে অভ্যস্ত৷ হয়তো আর কিছুদিন পর দু’জনের কোনও একজন চলে যাবে অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে৷
গানটা শেষ করে আরও কিছুক্ষণ হারমোনিয়াম নিয়ে বসে রইল সুরঞ্জনা৷ হয়তো ভাবছিল তমোনাশের ফোন আসবে, বলবে, স্যরি, সুরঞ্জনাদি৷
কিন্তু না, মোবাইলের স্ক্রিন কেমন ঠান্ডা ঘুমে নির্বাক৷

হঠাৎ গাড়ি থামার শব্দ হলে ভাবছে হয়তো চিত্রজিৎ ফিরল৷ দু’জনের মধ্যে কথা নেই, বাক্যহীন মুহূর্তগুলির মধ্যে তবু তার জন্য কী এক নিঃশব্দ প্রতীক্ষা৷
কিন্তু না, গাড়িটা আবার পিঁক শব্দ তুলে চলে গেল তার গন্তব্যে৷

সুরঞ্জনা উঠল হারমোনিয়াম ছেড়ে৷ ঘরের বাইরে বেরিয়ে একবার দাঁড়াল চিত্রজিতের ঘরের সামনে৷ আজকাল যখনই বেরোয় দরজায় তালা দিয়ে বেরোয়৷ এত বছর বিয়ে হয়েছে, কখনও তালা দিয়ে বেরোনোর প্রয়োজন ঘটেনি৷ এখন হঠাৎ—

সুরঞ্জনা বুঝে উঠতে পারে না, কী এমন প্রয়োজন ঘটল যার কারণে সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে রাখতে হয়! অলমিতি যখনই ঘরে আসে অমনি দরজা বন্ধ হয়ে যায়৷ অলমিতি যখন প্রথম-প্রথম আসত, তখন খোলাই থাকত দরজা৷ তারপর হঠাৎ কী কারণে দরজা বন্ধ করে দিতে শুরু করল চিত্রজিৎ৷ কী কথা তারা বলে, কে জানে!
তা হলে কি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দু’জনের মধ্যে?
তাও কি সম্ভব! অলমিতির একজন প্রেমিক আছে, তা জেনেছিল কোনওভাবে৷ তা হলে কি সেই প্রেমে ইতি ঘটে গিয়েছে ইতিমধ্যে? তাও কি সম্ভব?

কিন্তু—
হঠাৎ সুরঞ্জনার মনে হল, যতক্ষণ অলমিতি ঘরে থাকে দরজা বন্ধ করে রাখার একটা কারণ থাকতে পারে৷ কিন্তু যখন অলমিতি থাকে না, তখনও কেন দরজা বন্ধ করে রাখতে হয় চিত্রজিৎকে!
বন্ধ দরজার সামনে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুরঞ্জনা৷ দরজায় তালা দিয়ে কেন বেরোতে হয় চিত্রজিৎকে?

কী এক অজানা কৌতূহলে পেয়ে বসল সুরঞ্জনাকে৷ চিত্রজিতের ঘরের তালাটার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে৷ অনেক আগে, দু’জনে একসঙ্গে বেরোতে হলে এই তালাটা লাগানো হত ফ্ল্যাটে ঢোকার প্রধান দরজায়৷ এখন আরও একটি শক্তপোক্ত তালা লাগানো হয় সেখানে৷ আগের তালাটা তাকের উপর পড়েছিল অভিভাবকহীন৷ হঠাৎ সেটি নিয়ে চিত্রজিৎ লাগাতে শুরু করেছে তার ঘরে৷

এই তালাটার একটা ডুপ্লিকেট চাবি আছে৷ সেটি থাকে সুরঞ্জনার কাছে৷ সেই চাবিটা দিয়ে চিত্রজিতের ঘর খুলে দেখবে নাকি? খোলাটা কি উচিত হবে?

কিছু অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে, বা না করেই দ্রুত ঘরে গিয়ে নিয়ে এল ডুপ্লিকেট চাবিটা৷ চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলতে ঝাঁপিয়ে পড়ল অন্ধকার৷ ভিতরে কী আছে তা ঠিক ঠাহর হল না৷ দরজা হাট করে খুলে ভিতরে গিয়ে আঙুল ছোঁয়াল সুইচবোর্ডে৷ হঠাৎ অলোর ঝলকানিতে ভিতরে যে-দৃশ্য দেখল তাতে চমকে উঠল ভয়ঙ্করভাবে৷
এ কী করেছে চিত্রজিৎ! কী সাংঘাতিক ঘটনা। বেশ কয়েকদিন ধরে অলমিতি ঘরে এলেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে কাজ করত চিত্রজিৎ৷ কী কাজ করত তা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি সুরঞ্জনা৷ এখন সারা ঘরে পরপর সাজানো রয়েছে এক নগ্নিকার ছবি৷ বিভিন্ন পোজে, বিভিন্ন পটভূমিতে৷
মডেল নিশ্চয়ই অলমিতি৷

এত সব ছবি কি সে ঘরে বসেই এঁকেছে? না কি অলমিতিকে নিয়ে এক-একদিন, এক-এক পটভূমিতে নিয়ে গিয়েছে ছবি আঁকার প্রয়োজনে৷ অলমিতি পারল এভাবে মডেল হয়ে ছবি আঁকাতে! না কি চিত্রজিতের সঙ্গে তার সম্পর্ক এমন গভীর হয়েছে যে, তার লজ্জা করল না এভাবে নানা ভঙ্গিমায় ছবি আঁকাতে।
সুরঞ্জনার শরীরে ঘাম দেখা দিল৷

সে আরও একটু এগিয়ে গেল ছবিগুলোর দিকে৷ হঠাৎ ছবির মুখগুলোর দিকে চোখ রেখে স্তম্ভিত হল৷ মডেলের মেদহীন শরীর দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়, এই ছবিগুলোর মডেল অলমিতিই৷ কিন্তু মুখের আদল তো অলমিতির নয়।

একটু কাছে গিয়ে ছবিগুলোর মুখের গড়ন দেখে চমকে উঠল সুরঞ্জনা৷ এ কী ওই মুখ তো তারই! পরপর অনেকগুলো ছবির কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখে কাঁপুনি ধরে গেল সুরঞ্জনার শরীরে৷ তার বাঁ ঠোঁটের উপর ছোট্ট একটা কালো তিল আছে, সেই তিলটাও যথাস্থানে দিয়েছে চিত্রজিৎ৷ কী ভীষণ দুঃসাহস চিত্রজিতের, নিজের স্ত্রীকে বিশ্বময় মানুষের সামনে অপমান না করলেই কি হচ্ছিল না!

ছবিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভীষণ অসহায় আর বিপর্যস্ত লাগছিল তার৷ কী করবে, কী না করবে ভেবে দিশেহারা৷

এই ছবি কি চিত্রজিৎ প্রদর্শনীতে দেবে, না কি বিক্রি করবে কারও কাছে! এত সহজে স্ত্রীকে বিক্রি করতে বাধল না তার!

কিন্তু এখন কী করবে সুরঞ্জনা! রাগে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে গেল। কিচেন থেকে সবজি-কাটা ছুরিটা নিয়ে আসতে৷ গেল আর এল৷ তখন প্রবল হিংস্র হয়ে উঠেছে তার মুখ৷ হাতের ছুরিটা দিয়ে ফ্যাঁস করে একটা চিকে কাটল প্রথম ছবিটায়৷ ছবিটা প্রথমে দু’ভাগ, তারপর চার ভাগ হয়ে ঝুলতে লাগল ইজেলে৷ সুরঞ্জনা তার পরের ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ সেখানেও একটা চিকে৷ সেটিও ঝুলতে লগল লতপত লতপত করে৷

চিত্রজিৎ, তোমার সাহসেরও একটা সীমা আছে৷ হাতে রং তুলি থাকলেই যা খুশি আঁকা যায় না৷ শিল্পেরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে৷ তুমি সেই সীমা লঙ্ঘন করেছ৷ প্রত্যেক মানুষেরই জীবনে একটা গোপনীয়তা থাকে৷ তুমি সেই গোপনীয়তা প্রকাশ করতে চেয়েছ বিশ্বের তাবৎ মানুষের সামনে৷ এই সাহসিকতা আসলে এক মস্ত অপরাধ৷

সুরঞ্জনার হাতের ছুরির ফলা তখন একবার উঠছে উপরে, একবার সজোরে নেমে আসছে ক্যানভাসের উপর৷ উঠছে আর নামছে৷ উঠছে আর নামছে৷ যেন সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আজ ফালাফালা করে ফেলবে তীব্র প্রতিহিংসায়৷ আজ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে ব্রহ্মাণ্ডের শরীর৷

প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে প্রবলভাবে হাঁপাচ্ছে সুরঞ্জনা৷ তার ভারী বুক উঠছে, আর নামছে৷ দরদর করে ঘাম বেরোচ্ছে সারা শরীর থেকে৷ ঠিকরে বেরোচ্ছে তার চোখদুটো৷

পরপর কুড়িটা ছবিকে টুকরো-টুকরো করে তবে তার স্বস্তি৷ কিছুক্ষণ সেই ফালাফালা দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে একটা গভীর শ্বাস ফেলল৷ পিছন ফিরে দরজা দিয়ে বেরোবার মুখেই দেখল দরজার সামনে চিত্রজিৎ৷
বিস্ফারিত চোখে চকচকে ছুরি হাতে সুরঞ্জনাকে দেখল চিত্রজিৎ৷ চোখ পড়ল তার কয়েকদিন ধরে বহু যত্নে আঁকা ছবিগুলোর ছিন্নভিন্ন দশা৷ বুকের ভিতরটা খালি হয়ে গেল এক মুহূর্তে৷ চোখে চোখ রাখল মারমুখী সুরঞ্জনার৷

(ক্রমশ)

অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়