কবিতা গুচ্ছ

ছায়াপাখি
সুভাষ সরকার

সেই কবেকার কত কবিতার একজোড়া স্রোতস্বিনী-চোখ,
এখন শুধুই শুকিয়ে যাওয়া একটা নদীর ঠিকানা মাত্র।
কোনোদিন কোনো পথ ধরে কোনো জলধারা আর
ওখানে মিশবে না।

কত শীত ফুরিয়ে কত বসন্ত এলো গেলো, তবু দলছুট
পাখিটির মতো ‘কেউ এক’ তত্ত্বতালাশহীন কবির উঠোনে
এলো না কখনো।


শুকিয়ে যাওয়া নদীটির চারপাশে এখন বার্ধক্যবেলা।
পাখিদের ফেরা-পথে চেয়ে থাকে মৌন মনোরোগী।
শুধু ভাবে, বালিতে জড়িয়ে যদি অন্তত একফোঁটা জল,
দলছুট পাখিটিও আমার প্রাণের ডাক শ্রবণে উদ্যোগী।

 

বৃষ্টি বিষয়ক
গৌতম হাজরা

১.
ক্রমশ তুমি পল্লবিত হও বৃষ্টিশরীরে
জলকণায় পূর্ণ হও ভেতর ও বাহিরে
তোমার শাখাপ্রশাখায়, পাতায়, ফুল ও ফলে
ঝরে পড়ো অঝোরধারায় বৃষ্টির আড়ালে

মেঘমেদুর রূপকথায় তখন ভরে ওঠে চারিদিক

জলজ বাতাসে!

২.
বৃষ্টির কোনও ছায়া নেই
বৃষ্টির ফোঁটা স্পর্শ করলেই তাই
কবিতাও ঝরে ঝরে পড়ে

অনন্তে বয়ে যায় হাওয়া
বৃষ্টিধারা ভেসে আসে
মোহগ্রস্ত কায়ার স্বরূপে…

 

আমাদের হুহু পরান
তৈমুর খান

রাতের দিকে বৃষ্টি নামল
চারিদিকে কল্লোলের শব্দ
ভেজা গন্ধের ব্যাকরণ
আমাদের হু-হু পরান

পৃথিবীটা অন্ধকার হলে
অন্ধকারের ভেতর রাক্ষস জেগে ওঠে
রাক্ষসের বিভীষিকাময় কল্পনা
কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকি তখন

জোর গলায় কাকে চেঁচাব তবে?
নিরাপদ দ্বীপপুঞ্জ ডুবে গেছে
আশার জাহাজগুলি সমুদ্রের দিকে
ছাপোষা আলোর ভাষা পড়তে পারিনি

উদ্ধারের সঙ্গে দেখা হবে তবে?
ওই ভ্রম আসছে! ওইতো নিশাচর!
ওই তো সামনে এসে দাঁড়াল পাহাড়!

ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো, ওগো হাহাকার!

 

আলো অন্ধকার
হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়

আলো ছেড়ে অন্ধকারে দাঁড়াতে পারাও একটা শিল্প
কেননা শিল্পের ভেতরে যে দোলাচল
তা শুধু আলোতে নয়
অন্ধকারেও সমান উজ্জ্বল

হয়তো ঈষৎ আবেগে সে কিছুটা বিচিত্র
কিছুটা নির্লিপ্ত, চিত্রিতও বটে
কারণ প্রেমের মতো এক অপার অনুভূতিকে
সে কখনো পার্থিব হতে দেয় না…

হয়তো ক্রোধ ও কান্নার পর
মৃত্যু মাথায় নিয়ে
সে বসে থাকতে বাধ্য করে না
নিজেকে অকৃতজ্ঞ বলতে শেখায়

কিছু ঘৃণা, কিছু ক্রোধ উদার ধীমান
আর সব শিল্পের সাথে
পাশাপাশি সাজাতেই
সমস্ত শৃঙ্খল কেটে যায়…

 

দুটি কবিতা
চন্দন রায়

শরীর ছোট হয়ে এলে
শরীর ছোট হয়ে এলে আর কিছুই করার থাকে না
উন্মুক্ত তবু অসম্পূর্ণ। সাজানো অক্ষর কেঁদে ওঠে
ঠোঁটে এবং কপালে নদীর ওপারে বয়ে চলা জল
যেন আত্মীয় নয় পরবাসী—

শরীর ছোট হয়ে এলে রাত কিংবা সকাল
আর কেউ ডাকে না। কবিতার খাতা খোলা।
শারদদের করুণ ক্লান্ত কলম ঘুমের তলপেটে—

বাতাস সাঁতরে চলে যাওয়া শারদ অঙ্গ ছুঁয়ে
ছিটকে ওঠে ঘন অন্ধকারের জড়িয়ে ধরার রাস্তা
চোখ কেড়ে নেয়, বুক পুড়ে যায়, মন মানে না—

শরীর ছোট হয়ে এলে আর কিছুই করার থাকে না।

আমি বিখ্যাত হতে চাই
আমি বিখ্যাত হতে চাই। নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে
ঈশ্বরের পায়ে বেলপাতা দিয়ে, নদীর কাছে জন্মের
ইতিহাস বলে দিয়ে আমি বিখ্যাত হতে চাই—

আমি শুয়োরের পালে শুয়োর
জঙ্গলের নিচে ঘন জঙ্গল
সাপেদের মুখে ঠোঁট রেখে
আমি সারারাত বিখ্যাতদের মতো ঠোঁটে এবং
কপালে কিংবা তুষারের মতো কবিতার শরীরে
অন্য এক কবির মতো ভয় ভোগ করি—

আমি বিখ্যাত হতে চাই
শতাব্দী শেষ হবার আগে জোৎস্নায় ভাসিয়ে
দিলাম আমার ইতিহাস—

 

দুটি কবিতা
সুরঞ্জন রায়

কত দিন
কত দিন কথা নেই।
কত দিন শব্দ নেই কলমের মুখে!
আলোর নীচেই থাকে অন্ধকার ঘাপটি মেরে সুখে

কত পথ চলার হিসেব পড়ে আছে খাতার পাতায়
কত ধুলো-বালি-কথা জমে আছে সময়ের বুকে
জড়িয়ে সাহস
পথের পথিক জানে চলার ছন্দের গতিবিধি
কতটা সময় আপনি হেঁটেছেন কতটা রয়েছ বাকি চলা?

আমার সমস্ত কিছু জানা হয়ে গেছে শুধু প্রাত্যহিক হিসেবের
কথাটুকু রয়ে গেছে বলা!

শূন্য-বিভক্তির মতো
তুমি আছো, অসম্ভব-সম্ভবের প্রাণের প্রতীকে
প্রতিটি মুহূর্ত মনে রেখে তুমি আছো
শিরার ভিতরে স্রোত হয়ে বয়ে যাচ্ছো দিন রাত…
প্রতিটি অলক্ষ্য কোণে কোণে
তোমার নীরব উপস্থিতি খুঁজে পায়
সূক্ষ্ম-সমর্থন
ধুলো-বালি-প্রতি-কণা-নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে
তুমি আছো শূন্য-বিভক্তির মতো অনন্ত-কারকে…

আমাদের হৃদয়-বন্ধন-ফুল গাঁথা আছে বিশ্বাস-সুতোয় অমলিন
মরচেহীন ইস্পাতের মতো ভাবীকাল
মাথা ঝুঁকে
ভেসে যাবে ভয়মুক্ত কলঙ্কের পরিসীমা ছুঁয়ে সাবলীল
শূন্য-বিভক্তির মতো রহস্য-কারকে…

 

ভাঙন
দুর্গাদাস মিদ্যা

সব ভেঙে যাচ্ছে, ভাঙছে মানুষের মন
ভাঙছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন, অবলীলায়।
আলুথালু দিন সেও ভেঙে যায়
ভুল বোঝা-পড়ায়।
বর্তমান সময়— সমন্বয়হীন এক সময়
কেউ যেন কারো কাছাকাছি নয়
এমন বিষময় সময় দেখে হৃদয় বিকল হয়।
অথচ একদিন এক আপোসহীন সংগ্রামে
গড়ে উঠেছে মানুষের সামাজিক পরিচয়।
গড়ে উঠেছে ঘর বাড়ি সারি সারি সামাজিক টানে
তবে কেন এখন এমন ভাঙনের জয়গান শোনা যায়
একবিংশ শতাব্দীর প্রগতির অববাহিকায়!
ভয় হয় কেন এমন মানসিক অবক্ষয় মানুষের জীবনে দেখা যায়?