সুতপন চট্টোপাধ্যায়
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অজয় সাক্সেনার নম্বরে ফোন করল গোয়েল। অচেনা নম্বর, কেউ তুলল না। তাছাড়া গোয়েলকে চেনে না অজয়। আলাপও নেই। সে রাজ্যের সেলস টিমের সদস্য। তার সঙ্গে হেড অফিসের কোনও সম্পর্ক নেই। অতনু বলল, বিমলকেই কথা বলতে দাও। আমাদের তো সে চেনে না। আমরা কিছু বললেও সে তার বসের কাছ থেকে নির্দেশ মতো কাজ করবে। তার ওপর এখন রাত। ভয় হচ্ছে, এই রাতে বিমল যদি অজয়কে ধরতে না পারে, অজয় যদি নিজের বাড়িতে না থাকে, সে কি ট্যুরে গিয়েছে? গোয়েল আবার ফোন করল বিমলকে। ফোন এনগেজড। আবার অপেক্ষা।
অতনু আর গোয়েল বসে আছে। কারো মুখে কথা নেই। এবার অতনু একবার অজয়কে ফোন করল। ফোন যাচ্ছে না। কারোর সঙ্গে কথা বলছে। হয়ত বিমলের সঙ্গে কথা হচ্ছে। এনগেজড। গোয়েল বলল, তার মানে সে বিমলের সঙ্গেই কথা বলছে, নাও হতে পারে।
তবু খুব আশা করে গোয়েল বলল, এবার হয়ত বিমলই ফোন করবে। কিন্তু বুম্বা যদি ওই ট্রেনে না থাকে? এ কথাটা গোয়েলের মাথাতেও ঘুরপাক খাচ্ছে।
১৪)
আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। অজয়কে ফোন করল অতনু। কিছুক্ষণ বাজতে বাজতে ফোনটা ধরল অজয়। ‘আমি অতনু মিত্র। আপনি ইলাহাবাদ স্টেশনে আছেন তো? কোন সম্ভাষণ ছাড়াই বলল সে। অজয় বলল, হ্যাঁ স্যার। আছি। আর একটু পরে ট্রেনটা ঢুকছে। আমি আরপিএফ-এর সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। এখন স্টেশন মাস্টারের ঘরে। একটু পরে আমি কলব্যাক করছি।
অজয় আবার বলল, স্টেশন মাস্টার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
—দিন।
স্টেশন মাস্টার পান্ডেজি প্রথমেই বলল, সরি স্যার। খুব চিন্তায় আছেন। আমি জানতে চাইছি আপনি ছেলেটির বাবা তো?
—হ্যাঁ।
—আপনি কি অজয় সাক্সেনাকে চেনেন?
—হ্যাঁ, উনি আমার অফিসের লোক।
—কোন অফিস?
অতনু বলল।
তারপর আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। অতনু অধৈর্যের গলায় বলে বলল, কী ব্যাপার? কথা বলছেন না কেন?
পান্ডেজি বললেন, সরি, ইন বিটুইন কল ছিল।
—আচ্ছা, যদি বাচ্চাটা থাকে, আপনি কী করতে চান?
—ইলাহাবাদে নামিয়ে নিতে চাই।
—উনি একটা আবেদন নিয়ে এসেছেন। ছেলেটিকে উনি নিতে চান, বলছেন। যদি বাচ্চাটা ট্রেনে থাকে তাহলে ওঁর হাতে দিতে পারি? আপনার মত আছে তো?
অতনু জোর গলায় বলল, হ্যাঁ। দেবেন। আমি পারমিশন দিচ্ছি।
দাঁড়ান, আপনার কথাটা রেকর্ড করা হবে। বলে অজয়কে বললেন, আপনি বয়ানটা লিখুন। নীচে ওঁর নাম লিখুন। তারপর আপনার নাম লিখুন। উভয়ের নাম ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখুন।
ফোনের ভিতর দিয়ে সব শুনতে পাচ্ছে অতনু। লেখা হয়ে গেলে, তিনি কথা বললেন, ধন্যবাদ। আপনার নামটা জানতে পারি? অতনু নাম বলল।
ঠিকানা?
তাও জানাল।
—ঠিক আছে অপেক্ষা করুন। বলে ফোনটা অন্য দিক থেকে কেটে দিলেন।
গোয়েল বলল, কী বলল?
চেক করছিলেন আমি বুম্বার বাবা কি না? অজয়ের স্টেটমেন্ট ঠিক কি না।
—আর কিছু বলল?
ঠিকানা জানতে চাইল, বুম্বার ভালো নাম জানতে চাইল, পেশা কী জানতে চাইল।
—আর?
আর কিছু জানতে চাইল না। তারপর নন্দিনীকে ফোনে অতনু বলল, চলে এস। কিপ ইয়োর ফিঙ্গার ক্রসড। অজয় ওখানের সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।
অজয় আর ফোন করল না। সবাই টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে বসে। যে কোনও সময়েই খবরটা আসবে। ট্রেনটা বেশিক্ষণ থামবে না। তার মধ্যেই তাকে নামাতে হবে। ওরা অতনুদের চেনে না, জানে না। রেকর্ড করলেও ওরা অজয়কে বিশ্বাস করবে কিনা তাও জানে না। এলোমেলো কথা মাথায় আসছে। এতক্ষণে নন্দিনী ফিরে এল। সে আর থাকতে না পেরে বলল, অজয় না করলেও তুমি ফোন কর অজয়কে। বার বার করো।
অতনু বলল, দাঁড়াও, ও আমাদের কোম্পানির লোক। ঠিক সময় ঠিক খবর দেবে। শর্মাজি সেই রকমই নির্দেশ দিয়েছেন। ওকে বারবার বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
কিছুটা আশ্বস্ত হল নন্দিনী।
দশ মিনিট দেরিতে চলছে ট্রেন, মাথায় ছিল না। গোয়েল বলল, এখনও ট্রেন ঢোকেনি। মনে নেই দশ মিনিট লেট? রাস্তায় আরও লেট হতে পারে। ভাবিজি, আপনি একটু সবুর করুন। অজয় আছে যখন…, বলে থেমে গেল।
টানটান উত্তেজনা। দেখতে দেখতে পনেরো কুড়ি মিনিট কেটে গেল। এতক্ষণে ট্রেন এলাহাবাদ স্টেশনে ঢুকল। প্রাথমিকভাবে সিআরপিএফ-এর সঙ্গে স্টেশন মাস্টারের যোগাযোগ করতে সময় লাগছে। তারপর যুগ্মভাবে মিলিত হল প্লাটফর্মের একটা জায়গায়। কথা বলতে বলতে রেল পুলিশের কামরার দিকে ভিড় ঠেলে এগোতে লাগল। এদিকে আর কোনও খবর আসছে না। আরও ছয় মিনিট হয়ে গেছে। নন্দিনী এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অজয়ের কোনও ফোন নেই। সে তখন নিশ্চিত, বুম্বা ওই ট্রেনে নেই। মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বসে আছে। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে। অতনুও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। গোয়েলকে ধরে ভেঙে পড়ল। মনের মধ্যে বুম্বার মুখের কোমল আদলটা ভেসে আসছে। তাহলে কি ইটাওয়ার লোকটা মিথ্যে কথা বলেছিল? তার সব কথা সাজানো? বানানো? বীর সিং নামে অন্য লোক তাকে গায়েব করে দিয়েছে?
ঠিক তখন অজয়ের ফোন। স্যার, আপনার ছেলেকে স্পট করা গিয়েছে। সে রেলপুলিশের কামরায় ঘুমিয়ে ছিল। তার কাছে এই এলাম। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে প্ল্যাটফর্মে।
(ক্রমশ)