সুতপন চট্টোপাধ্যায়
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এর মধ্যে অফিস থেকে আরও একদল সহকর্মী এসে হাজির। তারা দিল্লিতে নানান ছেলে-মেয়ের কিডন্যাপের গল্প নিয়ে ফিসফাস করছে, কানে এলো অতনুর। একজন বলল, ওয়েট কর, কিছুক্ষণ পরেই ফোন আসবে, দশ লক্ষ চেয়ে। আজকাল মার্কেট রেট। কথাটা মিথ্যে নয়। ক’দিন আগেই নয়ডা থেকে এক ডাক্তারের একমাত্র ছেলেকে গায়েব করে কুড়ি লক্ষ টাকা দাবি করে ফোন এসেছিল। পরে দশ লক্ষে রফা হয়। ছেলেকে মীরাট থেকে উদ্ধার করেছিল। কিন্তু ছেলেটা কেমন হাবাগোবা হয়ে ফিরেছে।
ঠিক এমন সময় একটা ফোন এল। নন্দিনী ফোন করছে স্টেশন থেকে।
—আমি আর পবন নিউদিল্লি স্টেশন চষে ফেললাম। কোথাও নেই, না প্ল্যাটফর্মে, প্ল্যাটফর্মের বসার জায়গায়, এমনকি ওয়েটিংরুমগুলোতেও নেই।
—তাহলে ওখান থেকে একবার পুরনো দিল্লি স্টেশনে চলে যাও। ওখান থেকেও ঘোষণা করাও। অতনু বলল।
ফোনটা রেখে দিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল অতনু, তোমার সঙ্গে কি কোনো ব্যাপারে জেদাজেদি করেছিল আজ?
মা মুখ নীচু করে বসে আছে। কোনও উত্তর নেই। মায়ের নিরুত্তর মুখের দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করল অতনু, কিছু একটা হয়েছে, না হলে মা বলত। কিন্তু কী সে কথা?
আবাসনে থাকে বুম্বার দুই বন্ধু। একজন তার ইস্কুলেই পড়ে। আর একজন অন্য ইস্কুলে, কিন্তু তাদের মধ্যে খুব হৃদ্যতা। অতনু তাদের একজনের বাড়ি গেল। সন্ধে হয়ে এসেছে। কোনো খবর নেই। বিলতুর মা অতনুকে এই সময় দেখে অবাক। তাঁর বাড়ি আগে কোনওদিন যায়নি অতনু। নন্দিনী গেছে। অতনুকে তিনি নানান অনুষ্ঠানে দেখেছেন, কিন্তু আলাপ নেই। বিলতুর বাবার সঙ্গে দু-একবার দেখা হয়েছে। তেমন ঘনিষ্ঠতাও গড়ে ওঠেনি।
অতনুকে দেখেই বিলতুর মা বললেন, কী ব্যাপার, আপনি? নন্দিনী আসেনি?
—না। আমিই একটা খবর জানতে এসেছি।
—বলুন?
—এখানে বুম্বা এসেছে?
তিনি অবাক হয়ে বললেন, না তো! কেন? সে ইস্কুল থেকে ফেরেনি?
—ফিরেছে। কিন্তু তারপর কোথায় গেছে কেউ জানে না।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, সে কী? কী বলছেন?
—হ্যাঁ। আচ্ছা, বিলতু এসেছে?
—হ্যাঁ। এসে তো ঘুমিয়ে গেছে।
অতনু তাঁকে বিস্তৃত ঘটনা বলতেই তিনি বিলতুকে ঘুম থেকে তুলে দিলেন। বললেন, তুই আজ একসঙ্গে ফিরিসনি?
বিলতু বলল, হ্যাঁ ফিরেছি। ও তো বাড়ির দিকেই গেল। তারপর তো আমি জানি না!
বিলতুর মা অসহায় ও বিস্ময়ে তাকালেন অতনুর দিকে। কী বলবেন বুঝতে না পেরে বিলতুর মা অতনুর সঙ্গেই বেরিয়ে এলেন। বললেন, চলুন তো দেখি আমি পাশের পার্কে খেলছে নাকি? বা অর্জুনের বাড়ি গেছে কিনা?
অর্জুন পড়ে অন্য ইস্কুলে, থাকে দুটো ব্লক ছেড়ে। রাস্তার দিকে। অর্জুনের বাড়িতে ঘণ্টা বাজল। বাড়িতে কেউ নেই। অর্জুন বেরিয়ে এসে অতনুকে দেখে অবাক। বুম্বা এখানে আছে নাকি?
অর্জুন বলল, না তো আঙ্কল। আমি আজ অনেক আগেই চলে এসেছি। আমার সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডেও দেখা হয়নি। জানি না তো আঙ্কল।
তোমাদের মধ্যে কোথাও যাবার কথা হয়েছিল কোনওদিন?
—না।
—বুম্বা কোথাও যাবার কথা বলেছিল কোনওদিন?
—না।
—কারোর সঙ্গে ঝাগড়া ছিল বুম্বার, জানো?
—না আঙ্কল। তবে আজকাল ও খুব কম কথা বলত। কেমন নিজের মনেই থাকত। আমাদের সঙ্গে খেলার সময়ও কথা বলত না। কেন জানি না।
বিলতুর মা বলল, তার মানে সে এক গেট দিয়ে ঢুকে অন্য গেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। অন্য গেটগুলোয় খবর নিয়েছেন?
—হ্যাঁ, নিয়েছি। কেউ দেখেনি বলছে।
বিলতুর মা বললেন, দশটা বাস এসে বাচ্চাদের নামায়। ওরাই বা কী করে মনে রাখবে বলুন তো? ওরা তো গেঁড়ি-গুগলি সামলাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার ফাঁক দিয়ে কখন গলে বাইরে গেছে, খেয়াল রাখেনি বোধহয়।
—হবেও বা। বলে বিমর্ষ হয়ে অতনু ফিরে এল বাড়িতে।
মা জিজ্ঞেস করল, কোনো খবর? অতনু ঘাড় নাড়ল। মুখে কোনো উত্তর নেই।
৫
থানা থেকে খবর নেই, নন্দিনী কোথায় এখন জানা নেই। গোয়েল যাদের পাঠিয়েছে তাদেরও কোনো ফোন নেই। ফরিদাবাদের কাছে সার্কাস থেকেও কোনো খবর এল না। অতনু থানায় ফোন করল। থানা থেকে বলল, স্টেপ নিয়েছে, জালে কেউ পড়েনি। খবর হলেই ফোন যাবে। বারবার ফোন করার কোনো দরকার নেই। চুপ কর গেল সে। গোয়েলকে বলল, আর কোথায় যাবার সম্ভাবনা?
গোয়েল বলল, দেখ, বাড়ির সামনে দিয়ে মেন রোড ধরে দিল্লির নানান দিকে বাস যায়। কোনো বাসে উঠে পড়লে কীভাবে জানব বল তো? কিন্তু আশা ছেড়ে দিলে হবে না। এমন সময় নন্দিনীর ফোন এল। অতনু সচকিত হয়ে প্রশ্ন করতে যাবে নন্দিনী বলল, না। কোনো হদিস নেই। বাড়ি ফিরছি। তোমার কাছে কোনো খবর আছে?
অতনু নিচু স্বরে বলল, না।
আবার এক আতঙ্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে মনের মধ্যে। তাহলে?
বুম্বাকে যদি সত্যি কেউ কিডন্যাপ করে, যে কোনো মুহূর্তে ফোন আসবে। নয়তো তাকে পাচার করে দেবে কোথাও। এমন ছেলেধরার খবর অনেক কাগজে আসে, তারা ছেলে বা মেয়েকে বিক্রিও করে দেয়। যদি কেউ তাকে আটকে রেখে লক্ষ লক্ষ টাকা চেয়ে বসে? কোথা থেকে জোগাড় করবে? কেউ তো নেই এই শহরে? যদি এমন প্রস্তাব আসে তাহলে কি নিজেই তার মুখোমুখি হবে, না পুলিশে খবর দেবে? কেউ যদি তাকে নিয়ে অন্য দেশে চাইল্ড লেবার হিসেবে পাচার করে দেয়? কী করবে মাথায় আসছে না অতনুর। ঠিক এমন সময় আবার একটা ফোন এল। প্রায় আঁতকে উঠে কাঁপাকাঁপা হাতে ফোনটা তুলতেই, বুম্বার ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। খবরটা শুনে তিনি প্রবল উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। বাস- ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। বললেন, বুম্বাকে আমাদের গেটে নামিয়ে দিয়েছিল সে। প্রতিদিনের মতো। গেট নাম্বার সাতে। তারপর সে কিছু জানে না। অন্য সব কী কী করা হয়েছে তার বিস্তারিত খবর নিয়ে ফোনটা ছাড়লেন।
আরাত্রিকা অ্যাপার্টমেন্ট অনেক বড়, তার অনেকগুলো গেট। এক গেট দিয়ে প্রবেশ করে অন্য গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলে খেয়াল রাখা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া এক গেটের যাতায়াতের মানুষকে অন্য গেটে চিনে রাখা সম্ভব নয়, এটা সবাই জানে। বড় আবাসনে বাস করার এই এক বিরাট অসুবিধা। এই অসুবিধার কারণে গেটের কাছে ফ্ল্যাট নিয়েছিল অতনু। তবুও।
নন্দিনী এখনও আসেনি। অতনু আবার থানায় ফোন করল। কেউ ধরল না। তারা তো একটা মিসিং কেস নিয়ে বসে থাকবে না? কত কী যে হচ্ছে পৃথিবীতে!
(ক্রমশ)