(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সুতপন চট্টোপাধ্যায়
৩
সম্প্রতি নয়, বেশ কয়েক মাস আগে বেড়াতে গিয়ে ছিল মুসৌরি। ইস্কুলে জেনেছিল বুম্বা, বিখ্যত লেখক রাস্কিন বন্ড থাকেন মুসৌরিতে। তাই নাম শুনেই এক কথায় লাফিয়ে উঠেছিল। রাস্কিন বন্ড বুম্বার খুব প্রিয় লেখক। মাঝে মাঝেই ইস্কুল থেকে রাস্কিন বন্ডের বই নিয়ে এসে মন দিয়ে পড়ত। তাতে কেউ বাধা দিত না। পড়ুক, পড়তে ভাল লাগলে একটা ভাল অভ্যাস তৈরি হবে। রাস্কিন বন্ড থাকেন মুসৌরিতে দীর্ঘকাল। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল অতনুরা সপরিবারে। কার না প্রিয় লেখকের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করে? সবাই দেখে তো অবাক। বাড়িতে লেখার জন্য তার মাত্র একটি চেয়ার ও একটি টাইপ রাইটার। সেখান বসেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত গল্প, উপন্যাস রচনা করে চলেছেন। তাঁকে দেখে বুম্বার চোখের পলক পড়ে না। বিস্ময়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল। রাস্কিন বন্ড জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমার লেখায় কাকে তোমার ভালো লাগে? বুম্বা বলেছিল, রাস্টি। শুনে খুব খুব আদর করেছিলেন বন্ড। কিন্তু সেখানে সে কেন যাবে? তার পক্ষে একা একা ওখানে যাওয়া সম্ভবই নয়।
পাড়ার শ্যামামাসি খবরটা শুনে অতনুর বাড়িতে এসেই বলল, আচ্ছা কাছে পিঠে কোথাও সার্কাস জাতীয় কিছু হচ্ছে কেউ জানো? অতনু বলল, না জানি না তো। শ্যামামাসি বলল, সার্কাসে হাতি, বাঘ, সিংহ, বানরের খেলা থাকে। তাই দেখতে চলে গেল না তো? আমার ইস্কুলের একটা ছেলে এমন কান্ড ঘটিয়ে ছিল। অতনুর অফিসের একটা ছেলে বলল, ফরিদাবাদের মুখে একটা সার্কাস বসেছে জানি। শ্যামামাসি বলল, একবার সেখানে খোঁজ করা যায় না? বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সেখানেই হয়ত চলে গেছে? বারণ করবে বলে বাড়িতে বলেনি? একটি ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে মোটর বাইক হাঁকিয়ে চলে গেল ফরিদাবাদের দিকে। ফরিদাবাদ এখান থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার। গোয়েল বলে দিল, সার্কাসের মালিকের সঙ্গে দেখা করে টেন্টের সব জায়গা দেখে আসতে। ভালোবেসে হয়ত ভাল্লুকের সঙ্গে খেলতে শুরু করে দিয়েছে আপন মনে?
৪
নন্দিনী তার অফিসের বদলে দিল্লি স্টেশনে গিয়ে হাজির হয়েছে। এমন তো হতে পারে, কোনও বাসে সোজা স্টেশনে গিয়ে প্লাটফর্মে প্লাটফর্মে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ও একটু ভাবুক প্রকৃতির। চারদিকে দেখতে ভালোবাসে আর ক্ষণে ক্ষণে প্রশ্ন করে।
স্টেশনে গিয়েই অফিসের কার্ড দেখিয়ে স্টেশন মাস্টারের কাছে সহজেই পৌঁছে যায় নন্দিনী। স্টেশন মাস্টার ফোনে ব্যস্ত। তা সত্যেও নন্দিনী অপেক্ষা না করে বলল, ফোনটা এক মিনিট ধরবেন স্যার? আমার কথাটা আগে শুনুন প্লিজ। স্টেশন মাস্টার চশমার ফাঁক দিয়ে একবার তাকিয়ে বললেন, রিলাক্স ম্যাডাম, বসের ফোন।
চুপ করে গেল নন্দিনী। বসের ফোন শেষ হলে নন্দিনী সব জানিয়ে বলল, আমাকে হেল্প করতে হবে স্যার। চুপ করে শুনলেন তিনি। তারপর এক সেকেন্ড দেরি না করে একজনকে ডেকে পাঠালেন। নির্দেশ দিলেন অ্যানাউন্সমেন্ট করা শুরু করতে। দু-মিনিট অন্তর অন্তর করতে হবে। খুব জরুরী। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার পাঠালেন নিকটবর্তী স্টেশনে, কেউ দেখতে পেলে তাঁকে যেন সত্তর জানায়। তারপর নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কিছুক্ষণ বসে যান। ঘোষণার খবর দেখি তার পর যাবেন। বেশ কিছুক্ষণ কোনও খবর না আসায় তিনি বললেন, একঘন্টা পরে খোঁজ নিন। কোনও খবর হলে সঙ্গে সঙ্গে আমি জানাব। নন্দিনী ও পবন দু’জনে স্টেশন মাস্টারের অফিস থেকে বেরিয়ে এলে পবন বলল, বিবিজী, আপনি এখানে চেয়ারে বসুন। আমি সব প্ল্যাটফর্মে এক এক করে দেখে আসি। কোথাও বসে থাকলে বা বেঞ্চে ঘুমিয়ে থাকলে আমার চোখ এড়াবে না। বলে সে চলে গেল। বাড়িতে ফোন করল নন্দিনী। কোন খবর নেই।
চেয়ারেই কতক্ষণ বসে থাকা যায়? ছটফট করছে মন। বুম্বার মত কোনও বাচ্চাকে দেখলেই তার চোখ জলে ভরে উঠেছে। কী করবে? পিছন থেকে বুম্বার মত একটি ছেলেকে দেখে সে তার মুখ দেখার জন্য দৌড়ে গেল একবার। সেই থেকে সে চেয়ার ছেড়ে উদ্ভ্রান্তের মত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল স্টেশন চত্বরে।
শুধু তো দিল্লিতে একটা স্টেশন নয়। সার্থক গোয়েল বলল, আরও দুটো আছে। নিজামুদ্দিন ও পুরানো দিল্লি। সেখানেও দেখা দরকার। বাসস্ট্যান্ড পুরানো দিল্লির কাছে। সেখানেও যাওয়া দরকার। কেউ কিডন্যাপ করে ওই স্টেশন দিয়ে দিল্লি থেকে বেরিয়ে গেলে আর ধরা যাবে না।
কিডন্যাপ? শুনেই বুকের গভীরে ধস নামল অতনুর। গোয়েলের কথায় অফিসের তিনজন দুটো রেলস্টেশন ও একটা বাস ডিপোর দিকে রওনা হয়ে গেল। বুম্বার ছবি তিনজনের পকেটে। গোয়েল বুঝিয়ে দিল। ওরা চলে গেলে অতনুর মনে একটা প্রশ্ন এলো। আচ্ছা, বুম্বা তো বাড়িতে এসে বেরিয়ে গেছে। সে নিজেই বেরিয়েছে তাহলে তাকে কিডন্যাপ করবে কে? করলে তো আগেই করতে পারতো। তাকে কি বাড়ির বাইরে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোথাও নিয়ে গেছে কেউ? লোভ বা প্রলোভন দেখিয়ে?
গোয়েল বলল, আর কোথায় লোক পাঠানো যায়? অতনু বলল, আমার মাথায় কিছু আসছে না। কিডন্যাপ করে দিল্লির কোনও জায়গায় যদি বুম্বাকে গায়েব করে, আমরা কি খুঁজে বের করতে পারবো? কোথায় খুঁজব? আমার সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
(ক্রমশ)