সায়নী সাহা
পঞ্চমীর দুপুর। স্কুল ছুটি পড়ে গেছে কাল থেকেই। পাড়ার সবাই খুশি, কিন্তু রুদের মুখ ভার। ওর নতুন জামা হয়নি, ঠাকুর দেখার প্ল্যানও নেই, আর বাবা-মা আবার ঝগড়া করে আলাদা ঘরে আছে। দুপুরবেলা একা বারান্দায় বসে থেকে থেকে রুদ বিরক্ত হয়ে গেল। পুকুরপাড়ের বুড়ো শিউলি গাছটার দিকেও তাকাতে ভালো লাগছে না। ঠিক তখনই বেজে উঠল পেছনের গলির পরিচিত আওয়াজ, ‘হাত ঢুকিয়ে দেখি জাদু! পাঁচ টাকায় রঙিন টয়!’
রুদ ছুটে গেল। ও জানে কে এসেছে। টুকটুকে রঙের ঝোলাঝুলি নিয়ে আসা খোকনকাকু। ওর বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ, কিন্তু আচরণ একেবারে বাচ্চার মতো।
‘এই যে রুদ মশাই! এই যে একেবারে নতুন ‘সুপার-হিরো’ আইটেম!’ বলেই পকেট থেকে বার করল এক আজব জিনিস। রঙচটা, প্লাস্টিকের মুখোশ। ব্যাটম্যান না স্পাইডারম্যান বোঝা মুশকিল। রুদের চোখ জ্বলে উঠল।
‘কত?’
‘তোর জন্য? দে চার টাকা।’
রুদ হাসল, পকেট থেকে দুটো দু’টাকার কয়েন বের করে দিল খোকনকাকুকে। মুখোশটা পরে রুদ ছুটল ছাদে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবল, ‘আমি যদি সত্যি হিরো হতাম? আমি যদি বাবার মোবাইলটা গায়েব করে দিতে পারতাম, যেটাতে সারাদিন শুধু অফিস কল… আমি যদি মায়ের মুখে আবার হাসি আনতে পারতাম!’
সেই মুখোশ পরেই ও ছুটে গেল পাড়ার বাচ্চাদের খেলার মাঠে। তাদের ফুটবল গড়িয়ে গেছে ড্রেনে। কেউ নামতে চায় না।
রুদ গম্ভীর গলায় বলল, ‘সরে যাও! সুপার-রুদ আসছে!’ ও সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল ড্রেনে। কাদা-মাটি-জলে গা ভিজে একসা, কিন্তু বল নিয়ে ফিরে এল হাতে তুলে। বাচ্চারা সবাই হাততালি দিল। কেউ একজন বলল, ‘ওই মুখোশটা থাকলে তুই একেবারে হিরো!’
রুদ হাসল। মুখোশের ভেতরে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘হিরো হওয়ার জন্য মুখোশ না, দরকার একটু সাহস। আর একটু পাগলামি।’
পরদিন সন্ধ্যায় পুরো পাড়ায় চাঞ্চল্য। রুদের মুখোশ খোয়া গেছে। ছাদে শুকাতে দেওয়া জামাকাপড়ের পাশেই মুখোশটা রাখা ছিল। কেউ যেন সেটা নিয়ে পালিয়েছে। রুদের মন খারাপ। মনে হচ্ছে ওর হিরো রূপটাই বুঝি হারিয়ে গেল। সেই মুখোশ পরে ও কেবল ফুটবল উদ্ধার করেনি, পাড়ার কাকিমার ছাতা গাছে আটকে গেলে তুলেছিল, পুঁচকে রিমুর হাত থেকে পড়ে যাওয়া চকোলেট কুড়িয়ে দিয়েছিল, এমনকি স্কুলে একবার এক জুনিয়রের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেলে নিজেরটা খুলে দিয়েছিল।
সবাই বলত, ‘ওই মুখোশটা পরলেই রুদের মধ্যে কিছু বদলে যায়।’
এখন রুদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, চুপচাপ।
নিজেকে দেখে বলে, ‘আমি কি এখন আর হিরো না?’
ঠিক তখনই নিচে হইচই পড়ে গেল। পাড়ার প্রিয় বেড়ালটা— মিঠু, তিনদিন ধরে নিখোঁজ। আজ সকালে রাস্তার ধারে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে। কিন্তু পাড়ার কেউই কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। গায়ে কাদা, রক্ত, চোখ ফোলা। সবাই দূর থেকে তাকিয়ে দেখে বেড়ালটাকে। রুদের চোখে জল এসে গেল।
সে ছুটে গেল ঘর থেকে একটা পুরোনো তোয়ালে নিয়ে। কেউ কিছু বলার আগেই রুদের হাঁটু ভিজে কাদা হয়ে যায়। ও সাবধানে মিঠুকে তোয়ালে জড়িয়ে কোলে তোলে।
‘পিছাও সবাই’, রুদ বলে, ‘ও এখন ভয় পেয়েছে। চিৎকার করলে আরও কষ্ট হবে।’
সেই সন্ধ্যায় রুদ, মা আর পাড়ার রিয়াদি মিলে মিঠুকে স্নান করিয়ে ওষুধ দিয়ে, কাপড়ে মুড়ে রাখে। রিয়াদি হেসে বলে, ‘তুই এখন আগের থেকেও বেশি হিরো, রুদ।’
রুদের মা দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ শুনছিলেন। হঠাৎই তিনি বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে, মুখোশটা আমি সরিয়ে রেখেছিলাম। আমি দেখছিলাম, মুখোশ ছাড়া কী করে সামলাস সব কিছু!’
রুদ অবাক! মা কাছে এসে কপালে চুমু দিয়ে বলল, ‘আজ বুঝলাম, তুই মুখোশ ছাড়া আরও বড় হিরো।’
সেই রাতে, রুদ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে বলল, ‘একটা প্লাস্টিকের মুখোশ যদি আমাকে সাহস শিখিয়ে দিতে পারে, তাহলে সেই সাহসটা আমার ভেতরেই ছিল। আমি হিরো হতে পারি… মুখোশ ছাড়াও।’