মুক্তিঘর

কাল্পনিক চিত্র

গগন ঘোষ

ঘরের নিজস্ব কোনও আলো ছিল না। দরকারও ছিল না খুব একটা। এমনিতে দিন-রাতের হিসেব রাখারও প্রয়োজন ছিল না ওঘরে। শুধু সময় যেন ওখানে থামতে গিয়েও চলছে, যেভাবে অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। ঘাটের দিকের বারান্দায় একটা বাল্বের হলদে আলো খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে একটা আলো-আঁধারি তৈরি হয়েছে। গঙ্গার হাওয়ায় তারের সঙ্গে ঝোলানো বাল্ব দুললে ছায়াগুলো ঘরময় খেলা করে। জানালার লোহার শিকের ছায়া সুখময়কে যেন বিছানার সঙ্গে বেঁধে ফেলে। সুখময় ভয় পায়। মৃত্যুর নয়, মৃত্যুর চেয়ে কষ্টদায়ক কিছুর। সত্যি কথা বলতে, সুখময় তো এখানে মৃত্যুরই অপেক্ষা করছে। এই বাড়ির প্রায় সবাই-ই তো তাই করছে। বেশি দেরি হলে ম্যানেজার খুব বিরক্ত হন, সুখময় জানে। পাশের ঘরেরই এক মহিলা আট মাস ধরে ঘর দখল করে রেখেছিলেন। নামটাও জানা হয়নি। আজ ঘর খালি হল। সুখময়ের ঘরের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মুখটা একবার দেখতে পেয়েছিল। কই! ওঁর মুখে তো প্রশান্তি লেগে নেই, বরং মরবার সময় বেশ কষ্ট পেয়েছেন বলে মনে হল। সুখময় এই ভয়টাই পায়। যখন সেই সময় আসবে, সে মনে শান্তি নিয়ে যেতে পারবে তো? এখানকার সবাই তা-ই চায়। সেই জন্যেই তো এখানে আসা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মণিকর্ণিকা ঘাটে দাহ হবে। তারপর মুক্তি, মোক্ষ। সুখময়ও কি তাই চায়?

দূরের কোনও ঘাট থেকে সন্ধ্যারতির শব্দ ভেসে আসে। সুখময় শব্দটা আরও স্পষ্ট শোনার চেষ্টা করে। বেলফুলের গন্ধওয়ালা ধূপকাঠির গন্ধ টের পায় সে। অথচ এই গন্ধের ধূপকাঠি এই বাড়িতে জ্বালানো হয় না। সুখময়ের বাড়িতে জ্বালানো হত, শ্রীতমা জ্বালাতো রোজ সন্ধ্যায়। সুখময় অফিস থেকে বাড়িতে ঢুকতেই বেলফুলের গন্ধ পেত। শ্রীতমার শরীর থেকেও রাতে বেলফুলের গন্ধ আসত। বেলফুল খুব প্রিয় ছিল শ্রীতমার। শ্রীতমার চলে যাওয়ার দিন বেলফুল দিয়ে খাট সাজিয়েছিল সুখময়। বাড়ি থেকে শ্মশান পর্যন্ত কালো পিচের রাস্তায় ছড়ানো খই থেকেও যেন বেলফুলের গন্ধ আসছিল। শ্মশান থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। সুখময়ের মনে আছে, ছাদ থেকে সন্ধের মরা আলোয় সারা রাস্তা যেন ধূপকাঠির ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে ছিল সুখময়।


সন্ধ্যারতির শেষে এখন উচ্চৈস্বরে গান বাজছে ঘাটে। সুখময় বিছানায় শুয়ে শোনে। এখনও খাবার সময় হয়নি। সময় হলে ঘরেই খাবার দিয়ে যাবে। সুখময় অপেক্ষা করে। একসময় গানও বন্ধ হয়ে যায়। শুধু সুখময়ের ঘর না, সারা বাড়িটা হঠাৎ করে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। খুব একটা কথা বলে না কেউ এ বাড়িতে। কথা বলার প্রয়োজন শেষ হয়েছে। কারোরই বোধহয় আর কিছু বলার নেই। শুধু ম্যানেজারের ঘরে কিছু লোকের যাতায়াত বাড়িটাকে জীবন্ত রেখেছে। সুখময় পাশ ফিরে বালিশের পাশে রাখা লাল খাতাটা টেনে নেয়। ঘরে আলো খুব কম, চোখের দৃষ্টিশক্তিও কমে এসেছে। আস্তে আস্তে খাতার পাতা ওল্টায়। খাতাটা শ্রীতমার। বিয়ের পর থেকেই নিজের ইচ্ছেগুলো লিখে রাখত। সুখময় জানে, এর মধ্যে অনেক ইচ্ছেই ও পূরণ করতে পারেনি। এই বাড়িতে ছেলে কুশল রেখে যাওয়ার সময় শুধুমাত্র খাতাটা সঙ্গে করে এনেছিল, আর পকেটে কিছু টাকা। কয়েকটা জামাকাপড় একটা ব্যাগে ভরে কুশল সঙ্গে করে এনেছিল। সুখময়কে একটু বেশি ভালোবাসে বলে কুশল একটু বেশি টাকা দিয়ে গঙ্গার দিকের ঘরটা নিয়েছে।

সুখময়ই এই বাড়িটার খোঁজ পেয়েছিল। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার এক বছরের মাথায় তখন সদ্য শ্রীতমা চলে গিয়েছে। এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছিল এ বাড়ির কথা। তবে তখনও সুখময় ছিল ঘোর নাস্তিক। মুক্তি, মোক্ষ এসব ব্যাপারে কোনও আগ্রহ, বিশ্বাস কিছুই ছিল না। শ্রীতমা ভরা সংসার রেখে গিয়েছে। বাকি জীবনটা ছেলে-বৌমা আর নাতনিকে নিয়েই কাটিয়ে দেবে ভেবেছিল। এভাবে বারো বছর কেটেও গেল। ছেলে-সহ পরিবারের সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খুব একা লাগত নিজেকে। শরীরও ভেঙে পড়ল। সুখময় বুঝতে পারছিল আর বোধহয় বেশি সময় নেই। তখন এই বাড়িটার কথা মনে পড়ে। সবকিছু থেকে মুক্তি পাবার লোভ হয় সুখময়ের। কুশল প্রথমে রাজি হয়নি। সুখময়ই বারবার বলে রাজি করায়।

দশ-বারো দিন আগে সুখময় এই বাড়িতে আসে— ‘মুক্তিঘর’। মুক্তি, মোক্ষলাভের ঠিকানা। শেষ বয়সের শেষ ঠিকানা। কিছু পয়সার বিনিময়ে আমৃত্যু থাকা ও মণিকর্ণিকা ঘাটে দাহ-সংস্কার। একেবারে নিশ্চিত মোক্ষলাভ।
বেনারসের একবারে ঘাটের কাছে বাড়িটি। সুখময়ের অবশ্য মোক্ষলাভের তীব্র ইচ্ছে ছিল না। শ্রীতমার ইচ্ছে ছিল একবার কাশী আসার। ইচ্ছে ছিল গঙ্গার পাড় বরাবর হাত ধরে সারা বিকেল ধরে হাঁটার। ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখার। বেনারসের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়ানোর। শ্রীতমার লাল খাতায় সব লেখা আছে। এখানেই মরতে চেয়েছিল সে। মোক্ষলাভ করতে চেয়েছিল। সুখময় পারেনি শ্রীতমাকে এখানে একটিবার আনতে। সংসারের চাপে সুযোগ হয়নি। রিটায়ার করার পর শ্রীতমাকে নিয়ে ঘুরবে, নিজেদের মতো করে জীবন কাটাবে ভেবেছিল। কিন্তু তার আগে থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, একেবারে শয্যাশায়ী।
রিটায়ারমেন্টের এক বছর পরই তো শ্রীতমা চলে যায়।

সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর আজ আবার বের হয় সুখময়। মেন গেটে তালা দেওয়া নেই। কোনদিনই থাকে না। এখানে যারা থাকতে আসে তাদের সঙ্গে নিয়ে আসার বা নিয়ে যাবার কিছু নেই। শুধুমাত্র ম্যানেজারের ঘর ভেতর থেকে আটকানো আছে। ঘর থেকে বেরিয়ে একটা ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে মেন গেট। বেরোবার রাস্তাটা অন্ধকার। সুখময় এই ক’দিনে অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। মেন গেট থেকে একটা গলি কিছুটা গিয়ে বড় রাস্তায় মিশেছে। গলিটাও অন্ধকার, কিন্তু বড় রাস্তায় বেশ আলো আছে। খুব জোরে হাঁটলে হাঁপ ধরে আসে সুখময়ের। আস্তে আস্তে হেঁটে বড় রাস্তায় ওঠে। বগলে চেপে রাখা লাল খাতাটা রাস্তার আলোয় মেলে ধরে। প্রথম থেকে শ্রীতমার ইচ্ছেগুলো এক এক করে পূরণ করার পর লাল কালিতে কেটে রেখেছে সুখময়। প্রায় সব শেষ হয়ে এসেছে। সুখময় একটা অটো ডেকে নেয়।

এই মুহূর্তে দশাশ্বমেধ ঘাটে লোকজন বেশি নেই। যারা ঘাটের কাছাকাছি হোটেলে উঠেছে, রাতের খাবার পর গঙ্গার হাওয়া খেতে এখানে ওখানে ছড়িয়ে বসে আছে। স্থানীয় লোকজন প্রায় নেই। সুখময় ঘাটের এককোণে বসে থাকে অনেকক্ষণ। গঙ্গায় অনেক দূরে দু-একটা নৌকার আলো দেখা যাচ্ছিল। দেখা যাচ্ছিল দূরে আলো দিয়ে সাজানো গঙ্গার ওপর ব্রিজ। সুখময় মনে করার চেষ্টা করে— আর কিছু বাকি থাকল না তো? লাল খাতাটা খুলে দেখে একবার। এই ঘাটে একসঙ্গে এসে বসতে চেয়েছিল শ্রীতমা। প্রায় নির্জন ঘাটে বসে সুখময়ের মনে হচ্ছে শ্রীতমা ওর পাশেই বসে আছে। গঙ্গার হাওয়ায় ওর চুল থেকে ভেসে আসছে বেলফুলের গন্ধ। সুখময় খাতার শেষ লাইনটা কেটে দেয়। তারপর গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেয়। লাল খাতার ভেলভেটের কভার জলে গলে গিয়ে ঘাটের কিছুটা অংশ লাল হয়ে যায়, যেমন শ্রীতমার সিঁদুরের রং ছিল। আজ শ্রীতমার মুক্তি হল সব ইচ্ছে থেকে। সুখময় ঘাটের আরও কয়েকধাপ নেমে গভীর জলের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু কিছু বোধহয় বাকি থেকে গেল। শ্রীতমা সারাজীবন চেয়েছিল সুখময় যেন খুব ভালো থাকে। এভাবে চলে গেলে শ্রীতমা কি শান্তি পাবে? না, এই ইচ্ছেটা সুখময় পূরণ করবেই। জল থেকে উঠে আসে। যে ক’দিন বেঁচে আছে, শ্রীতমার জন্য ভালো থাকতে হবে। তবেই শ্রীতমার শান্তি, মুক্তি। ঘাট থেকে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যায় সুখময়। ফিরে যাবে সে। মুক্তিঘরে নয়, নিজের বাড়িতেও নয়, অন্য কোথাও। শুধু ভালো থাকার জন্যই বাঁচবে। চাঁদের আলোয় বড় রাস্তাটা যেন অনেক স্পষ্ট করে দেখতে পায় সুখময়।