মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
অরূপরতনকে চেনো তো? যার ডাকনাম পিকু? চেনো না? কী আশ্চর্য! কালই তো খবরের কাগজে তার ছবি বেরিয়েছে। তার আগের দিন টিভির সব চ্যানেলে তো ওর খবরই দেখাচ্ছিল! সাহসিকতার জন্যে পুরস্কার পাবে পিকু রাজ্যপালের হাত থেকে, চাট্টিখানি কথা নয়। কোন ইস্কুলে পড়ে? না, তেমন কোনও নামীদামী ইস্কুলে সে পড়ে না। ওই তো গোপালপুর ইস্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। না, লেখাপড়াতেও খুব ওস্তাদ সে, এমনটা বলা যায় না। পড়ার সময় কম পায় তো! তবে যেটুকু পড়ে মন দিয়ে পড়ে। মাস্টারমশাইরা ওকে খুবই স্নেহ করেন।
রোজ ভোরবেলায় উঠে পিকু একটু পড়ে নেয়। তারপর গোবরাকাকুর স্টল থেকে পেপার নিয়ে বাড়ি-বাড়ি বিলি করে। তারপর কাকুর কাছ থেকে পেপার বিক্রি করার জন্য যা পয়সা পায়, তা নিয়ে লালু-ভুলুদের খাবার তৈরি করার জিনিসপত্র বাজার থেকে কিনে রুক্মিণীমাসিকে দিয়ে আসে। মাসির হোটেল আছে। কাঁচা মেঝেতে বাঁশের বেঞ্চ পোঁতা। সকালেই উনুনে গনগনে আঁচ। ভাত টগবগ করে ফুটছে। ন’টা নাগাদ রাস্তার ওধারে অটো থেকে দেদার লোক নামবে আর মাসির হোটেলে মাছ-ভাত খেয়ে চলে যাবে বাড়ি তৈরির কাজে, বেশিরভাগ খদ্দেরই তাই। মোটামুটি বারোটার মধ্যে মাসির হোটেল ফাঁকা। তখন মাসি ডেকচিতে চাল আর ছিটেফোঁটা মাংস একসঙ্গে সেদ্ধ করে দেয়, মাসির হোটেলেই ডেকচির ওপর ইট চাপা দিয়ে রেখে চলে যায়। মাসি কিচ্ছু চায় না এর জন্য, শুধু একটাই শর্ত, ডেকচিটাকে ঝকঝকে করে মেজে রেখে দিতে হবে পিন্টুদার গ্যারেজে। ওখানে মাসির বাসন রাখা থাকে। সেই ভাত বালতি করে নিয়ে খবরের কাগজ পেতে পিকু খেতে দেয় লালি-ভুলি-কালি-নেড়ু— ওদের সকলকে, বেলা তিনটে নাগাদ। ওরা পথকুকুর।
মাসিকে চাল-টাল পৌঁছে দিয়েই বাড়ি ফিরে ও চটপট চান-খাওয়া সেরে ইস্কুলে চলে যায়। ইস্কুলে মন দিয়ে পড়া করলে তবু কিছুটা পড়া হয়, তাই একদিনও ইস্কুল বাদ দেয় না পিকু। বিকেলে তো মাকে সাহায্য করতে হয় রুটির দোকানে। ইস্কুল থেকে ফেরার পথে লালিদের খেতে দেয় ও। খাবার দিয়ে বসে থাকতে হয়, নয়তো ওরা গোলমাল করে। খাওয়া শেষ হবার পর জায়গাটা পরিষ্কার করে দিতে হয়, হাঁড়ি মাজতে হয়, ততক্ষণে জলও এসে যায় রাস্তার টাইমকলে।
তারপর বাড়িতে ফিরে খাওয়া-দাওয়া করে মায়ের বিক্রি-বাটার জিনিসপত্র, টেবিল ভ্যানগাড়িতে চাপিয়ে নিউ সিনেমাহলের সামনে চলে যায়। শ্রাবণী হোটেলের রান্নাঘরে রাখা মায়ের গ্যাস ওভেনটা সেট করে দেয় ওটাতে। মা আলু-ছোলার তরকারি করে আর রুটি বানায়। ও খদ্দেরদের পয়সার হিসেব রাখে আর রুটি গুনে দেয় ঠোঙায় ভরে। অনেকে বসে বসেও খায়। দু-একজন অফিস ফেরত এখানে খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে যায়, বলে এটাই ওদের ডিনার। এরকম পাঁচজন আছে। ওদের বাড়ি কলকাতায়, এখানে চাকরি করে। এসব সামলে সাড়ে আটটা-ন’টায় বাড়ি ফিরে একটু পড়তে না পড়তেই বেদম ঘুম পেয়ে যায় ওর। মা আটটার পরে পরেই দোকান গুটোতে থাকে ওর পড়া আছে বলে।
সেদিন ও রোজকার মত সকাল সকাল গোবরাকাকুর স্টলে সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিল। দূর থেকে দেখলো চারু অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বেজায় ভিড়! তিনতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তিনতলা, দোতলার মানুষগুলো পরিত্রাহী চিৎকার করতে করতে নেমে আসছে নিচে। সিঁড়ির দিকে ধেয়ে আসছে আগুনের হলকা। দোতলার কোণের ফ্ল্যাটটির জানলায় দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছেন এক বৃদ্ধা! নিজে নামার শক্তি নেই, বোধহয় একাই থাকেন। অনেকে হায় হায় করছে, কিন্তু কিছু করার নেই।
একটু থেমে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করে পিকু। তারপর চোখের পলকে সাইকেল ফেলে ছুট লাগায়। পেছনে হৈ-হৈ রৈ-রৈ শব্দ। আরে, বাচ্চা ছেলেটা কেন যাচ্ছে রে! মারা পড়বে তো! এসব ওরা বলতে বলতেই পিকু একলাফে দোতলায়। আগুন-লাগা দরজাটা ইতিমধ্যেই পুড়ে বেঁকে ফাঁক হয়ে আছে, লাফিয়ে ঢুকে পড়ে পিকু সোজা চলে যায় পরের ঘরটির দিকে। তারপর এক লহমায় ওই বৃদ্ধাকে পিঠে নিয়ে ছুট দেয় সামনের ব্যালকনিটার দিকে। ভগবান সহায়, ব্যালকনিতে একটা চাদর ঝুলছে! ঝটপট চাদরটার এক প্রান্ত লোহার রেলিঙে শক্ত করে বেঁধে ও ঝুলিয়ে দেয় নিচে, বৃদ্ধাকে পিঠে তুলে নেয়, ওর গলা শক্তভাবে জড়িয়ে ধরতে বলে। ছোট্টখাট্টো মানুষটি খুব হালকা বলে রক্ষা! রেলিঙটাও তত উঁচু নয়। তারপর অতি সাবধানে চাদর বেয়ে নিচে নামে। নাগালে আসতেই বৃদ্ধাকে ধরে ফেলে অন্যরা। পিকুর সারা দেহে তখন তীব্র জ্বালা! ও ঠান্ডা মাটিতে শুয়ে পড়ে। কে যেন ছুটে এসে ওকে জল খেতে দেয়। পিকু চোখ বন্ধ করে ফেলে।
ওদিকে দমকলের সাইরেন, লোকজনের চিৎকারের মধ্যে উপস্থিত হয়েছে সাংবাদিকরাও। ফটাফট ছবি উঠছে। সারাদিন চ্যানেলে চ্যানেলে চললো পিকুর উদ্ধারকার্যের সেই রোমহর্ষক ভিডিও। ওকে চিনতে কারুরই আর বাকি নেই এখন।
ও অবশ্য এখন খুব ব্যস্ত, ওসব দেখার বেশি সময় নেই। একবার দেখেছে গোপুমামার দোকানে, ব্যাস! গোপুমামা আবার ওকে বসিয়ে তখন গরম গরম রসগোল্লা খাওয়াল। গোবরাকাকু জোর করে একটা দামি লাল গেঞ্জি কিনে দিল। লজ্জাই করছিল ওর। পিকুর এখন সময় নেই, লালিদের জন্য একটা বিছানা বানিয়ে দিতে হবে বলে ছেঁড়া চাদর, চটের বস্তা এসব জোগাড় করতে যাচ্ছে নতুনবাজারে, শীত আসছে তো!