সুবীর চট্টোপাধ্যায়
বসন্ত বিলাসের উষ্ণ মায়ামাখা বাতাসে ঘোষণাটা পাক খেতে খেতে চটুল হিন্দি গানের সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে। শুধু নন্দীপুর নয়, আশপাশের আর পাঁচটা গ্রাম তাতে আলোড়িত হচ্ছে। নন্দীপুরে আজ অবাক করা কাণ্ড ঘটতে চলেছে। গাঁয়ের ক্লাবঘর থেকে সারাদিন ঘোষণা চলছে। সবাই কৌতূহলী উত্সুক। কী জাদু দেখাবে মানিককুমার? বলা হচ্চে জাদুসম্রাট মানিককুমার মঞ্চে প্রাগৈতিহাসিক ডায়নোসর জীবন্ত দেখাবে। কথাটা শুনে অব্দি বিন্দুর ঘোর কাটে না। চটুল হিন্দি গানের কলিগুলো আনমনে গেয়ে ওঠে। চোখের ওপর ভেসে ওঠে ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া, কাগজটার ভেতর জল হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অপরূপ সুন্দরী মেয়েটাকে টেবিলে শুইয়ে ধারালো করাত দিয়ে— উহ ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। মানিককুমারের কেরামতির চক্করে বিন্দু যেন বাঁধা পড়ে ঘুরতে থকে। জীবন্ত ডায়নোসর খোলা মঞ্চে। বাপরে! লোকটার ক্ষ্যামতা আছে বলতে হবে। ক্ষ্যামতা না থাকলে কি আর জাদুসম্রাট হয়? খালি বাক্স থেকে পায়রা, পায়রা থেকে বেড়াল, বেড়াল থেকে রুমাল— চোখ-হাত-পা বেঁধে বাক্সের ভেতর থেকে উধাও হয়ে মোড়ল বাড়ির ছাদ থেকে নেমে আসা— উহ ভাবা যায়!
নদীর পাড়ে পাশাপাশি দু’টি ঘর একে অপরের দিকে চুপটি করে তাকিয়ে আছে। হয়তো বা ফিসফিস করে কথাও বলে। কী বলে কে জানে! মাটির দেয়াল, খড়ের ছাউনি। একটা বৃন্দাবন ও তার বৌ বিন্দুর আর একটা পড়ার ক্লাবঘর। এই ক্লাবঘর থেকেই মাঝে মধ্যে বিভিন্ন গলায় মানিক কুমারের প্রশস্তি ভেসে আসছে। সকাল বিকেল ক্লাবঘরে ভিড় লেগেই আছে। সব মিলিয়ে আশ্চর্য মানুষটাকে নিয়ে বাজার গরম হয়ে উঠেছে। আর বিন্দুর বুকের ভেতর কোথা থেকে উঠে আসছে তুমুল ঢেউ। ভেঙে যাচ্ছে পাড়। অথচ বিন্দু বিবাহিত। বৃন্দাবন ওকে যথেষ্ট ভালোবাসে। তবু কোনো মুগ্ধতা বেশিদিন একগামী নয়। থাকতে পারে না। আসলে মেয়েদের কাছে ভালোবাসার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকে না। বিন্দুর আজ কী হয়েছে কে জানে! ওর মন যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্চে ক্ষণে ক্ষণে। সংসারের কাজকর্ম ভুলে উঠোনে খুঁটিতে হেলান দিয়ে উদাস বসে আছে। রোদটা তার ভালো লাগছে। শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়ার গভীরে শীতের ইঙ্গিত।
—অমনধারা বসি থকলি হবি? ভাত রাঁধতি হবিনি। নে উঠ। দুটি মুখে দে কাজে বেরুতি হবে।
বৃন্দাবনের কথায় উঠে দাওয়ার কোল থেকে ঝাড়ুখান নিয়ে উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে বলল— হ-গ, ম্যারপের ভেতর খোলা জায়গায় জান্ত ডায়নোসর দেখাবে? বলতিছে যে কদিন থিকে খুব।
—শুনচি তো ক’দিন থিকে সেই রকম। তারপর ভ্গবান জানে। তারপর বলল— ও, ওরম কয়। বলতি হয়। লোক জড়নের লিগে। বলে দাওয়ায বসে ঢক ঢক করে জল খায়। ওদিকে ঘোষণা ও গান ক্রমাগত হয়ে চলেছে। বৃন্দাবন বিরক্ত হয়। অষ্টপ্রহর কানের ভেতর ঝিঁঝিঁপোকা ডেকে চলছে। নেত্যকার বাঁচার লড়াইয়ের মধ্যে এ যেন এক রসিকতা।
আজ দুপুরের পর যখন পলাশ-শিমুল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে শেষ বিকেলের ফিরোজা রঙের রোদ, ঠিক তখনি খেয়াঘাটে সে কী হইচই। চিল্লামিল্লি। এমনটা জীবনে দেখেনি বিন্দু। ক্লাবের ছেলেরা গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে দিল। যুবতী মেয়েরা কপালে চন্দনের ফোঁটা দেবার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করল। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা মেয়ের দল শাঁখ বাজাতে লাগল। মাইকে ক্রমাগত ঘোষণা হচ্ছে— বন্ধুগণ, বন্ধুগণ আমরা সানন্দে জানাচ্ছি বাংলার গৌরব, আমাদের পরম আকাঙ্খিত জাদুসম্রাট মানিককুমার এইমাত্র নন্দীপুরের মাটিতে পা রেখে আমাদের ধন্য করলেন। আমরা তাঁকে আন্তরিক স্বাগত জানাচ্ছি।
বিন্দু হাঁ করে দেখছিল মানুষটাকে। নীল রঙের স্যুট প্যান্ট মাথায় মস্ত টুপি। মানুষটা গর্বিত ভঙ্গিতে হাতে একটা ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে হেঁটে চলেছে। বিরাট উল্লাস জয়ধ্বনি আর হাততালিতে ফেটে পড়ছে। বিন্দু অবাক হয়ে দেখছিল, একটা মানুষকে নিয়ে কত কি হচ্ছে। তা ক্ষ্যামতা আছে বলেই না। বিন্দুর বুকের ভেতর একশো মোচড় লাগে। চোখের কোলে চিকচিক করে ওঠে জল।
বৃন্দাবন বাজারের দিকে যাচ্ছিল। বিন্দু বলে— কোথা যাবা? উদিকপানে দেক কী কাণ্ডখানা হচ্চে মানুষটাকে নিয়ে। একনি জাদু শুরু হবে। এট্টু দেখি যাও।
বৃন্দাবন বলে— এখন তো জাদুখেলা হবেনি। তখন দেকব। একনি আমার মেলা কাজ পরি আছে। বলে, বৃন্দাবন বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে বিন্দু বলল— তোমার কি শখ আহ্লাদ বলে কিচু থাকতি নেই!
বৃন্দাবন বলে— ম্যাজিক তো বিকেলে। দুকুরে এসে দেখব।
ওমা মানুষটার কী ক্ষ্যামতা গো। অবাক হয়ে দেখে বিন্দু। মাথার টুপিটা খুলে সকলকে দেখালো ফাঁকা শূন্য। হাতের ছড়িটা চারবার বুলিয়ে ওপর দিকে ছুঁড়ে দেবার মত ছুঁড়ে দিতেই দুটো ধবধবে সাদা পায়রা ওড়াউড়ি করতে লাগল। ভিড়টা ঘনঘন হাততালি আর চিত্কার করে উঠল। আরো নানা ছোটখাট খেলা, তাসের খেলার পর বন্ধ বাস্কো থেকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় উধাও হয়ে যাওয়ার পর শুরু হল সব থেকে রোমাঞ্চকর ম্যাজিক। সুন্দরী এক নারীকে ধারালো করাত দিয়ে পেট থেকে কেটে দু আধখানা করা। বিন্দু ঘোর লাগা চোখে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। লাল স্কার্ট পরা ফরসা টুকটুকে মেয়েটি টেবিলে শুয়ে পড়ল। মানিককুমার যখন ধারালো করাতটা মেয়েটার পেটের ওপর ধরল তখন অবাক বিস্ময়ে, ভয়ে, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিল নিজেও জানে না। হঠাৎ প্রবল হাততালি আর চিত্কারে বিন্দুর চোখ খুলে গেল। আসল খেলাটাই তার দেখা হল না। যাক, তার জন্য দুঃখ নেই তার। আবার কাল দেখবে। কাল ডায়নসোরের খেলা দেখতে দেখতে দেখবে তার স্বপ্নের পুরুষকে। হ্যাঁ, মানিককুমার যখন খেলা দেখাচ্ছিল তখন তার ঘামে আলো পড়ে আলোকময় হয়ে ওঠে মানুষটা। কী যেন এক মোহময় রূপ ফোটে। বিন্দুর চোখের তারা ফুলঝুরির মত ঝিকমিক করে ওঠে। তার মনে হয়, এই তো তার স্বপ্নের পুরুষ। তার বিশ্বাস, এই সেই মানুষ, যে তার সব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার ক্ষমতা রাখে।
মানিককুমার বলে— চলো চলো বিন্দু। আমি তোমার খালি কোল ভরে দেবো— না না, তা হয় না। ঘরের মানুষটা জানতি পারলে খুব কষ্ট পাবে। ও আমায় খুব ভালোবাসে।
মানিককুমার বলল— জীবন একটাই। ভালোবাসার ফসল পেতে হলে পিছুটান ভুলতে হয়। চলো চলো তাড়াতাড়ি।
চুপ করে কত কী ভাবে বিন্দু। পুরুষ মানুষ তো কম দেখলো না। সবাই তাকে কামনা করে। সুখে রাখার গল্প বলে। বৃন্দাবন অক্ষম। তাই কোল ভরাবার স্বপ্ন দেখায়। আরো কত কী বলে। তোমার জীবনটাই ক্ষয় করে দিচ্ছে। এখন তো তোমার সুখ ভোগ করার সময়। গতরে ভাঙন ধরলে কেউ আর ফিরে তাকাবেনি। আর দেরি কোরো না। তাড়াতাড়ি চলো। সকাল হয়ে আসছে।
—একটু দাঁড়াও মানুষটাকে শেষবারের মত একবার দেকি ঝাই।
—তালি আমাকে আর পাবিনি। আমি চলি।
—না না যেওনি। চিত্কার করে ওঠে বিন্দু। যেওনি— যেওনি—। পায়ে পড়ি—।
—এই বিনু, বিনু কার পায়ে পড়তেচিস। সপন দেকচিলিস। ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে দেয় বৃন্দাবন। বিজবিজে ঘামে ভেজা বিন্দুর শরীর। বুকের ভেতর যেন হাপরখানা, লোহা পেটাই হচ্ছে। খুব হাঁপাচ্ছে সে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে ঢকঢক করে জল খায় বিন্দু। কোথায় মানিক কুমার, কোথায় তার সেই প্রেমের আকুল আহ্বান।
জানলার সামনে এসে দাঁড়ায় বিন্দু। কুয়াশায় ঢাকা ক্লাবঘর। আজ জাদু খেলার শেষ দিন। পেয়ে হারানোর হাহাকার বুকে বাজে তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিন্দু। হঠাৎ বুক চিরে বেরিয়ে আসে— চোকের সামনে থেকে ই সব বিদেয় হলে বাঁচি। আপদটা বিদেয় হলে বাঁচি। বিন্দুর এই গভীর গোপন উচ্চারণের সাক্ষী থাকলো না কেউ। না ঘুমে কাতর বৃন্দাবন। না জাদুসম্রাট মানিককুমার। না উদাস পৃথিবী।