সুশোভন বসু
ভোলাকে প্রায় সকলেই চেনে। বিশেষত স্টেশন এলাকায়। কখনও স্টেশন মাস্টারের চা, বিস্কুট এনে দিচ্ছে, কখনও ঘুগনির দোকানের প্লেট ধুয়ে দিচ্ছে, কখনও চায়ের দোকানের কাপ, প্লেট মেজে দিচ্ছে, জল এনে দিচ্ছে। সারাদিনই ব্যস্ত সে কোনো না কোনো কাজে। সে কোথা থেকে এলো এইখানে তা কেউ সঠিক বলতে পারে না। যত দেখি ছেলেটাকে ততই কৌতূহল হয়। মুখখানা একবার দেখলে ভোলা যায় না যদিও তার নাম ভোলা। যেমন চটপটে কথাও বলে খুব ভালো। পরিচয় হতেই বুঝলাম। আমি নিজেই একদিন তাকে ডাকলাম তখন প্লাটফর্ম ফাঁকাই ছিলো। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে গেলে যেমন হয়। এই স্টেশনে ট্রেন চলে যাওয়ার পরে আর একটা ট্রেন আসার মাঝে বেশ কিছুটা সময় পাওয়া যায়। লোকাল ট্রেন তো আছেই, আছে মালগাড়ি বাংলাদেশে যায়। প্যাসেঞ্জার গাড়ি ও আছে বাংলাদেশে যায় তবে রোজ নয় সপ্তাহে তিনদিন।
এই গাড়িটা অন্য গাড়িগুলো থেকে আলাদা। অনেকক্ষণ দাঁড়ায় এই গেদে স্টেশনে। তখন ঘুরে ঘুরে দেখে ভোলা। খুব ভালো লাগে দেখতে। ভিতরে অবশ্য উঠতে দেয় না। পুলিশগুলো বকাবকি করে, তেড়ে মারতে আসে। ভোলার খুব ইচ্ছে করে ট্রেনে চড়ে ওই পাড়ে বাংলাদেশে যেতে। গেদে স্টেশনের পরেই দর্শনা। ভোলার এই ইচ্ছের কথা আমি জেনেছি একদিন কথায় কথায়। স্টেশনে এসে একা পেয়ে একদিন জিজ্ঞেস করতেই সে বলে আমাকে কত কথা। বেশ লাগে শুনতে। সেই থেকে যখন স্টেশনে দেখা হয় ভোলার সঙ্গে আমি ওকে জিজ্ঞেস করি নানা কথা, জানতে পারি অনেক কিছু— বাবাকে মনে পড়ে না, মায়ের সঙ্গেই থাকতো শিয়ালদা স্টেশনে। মা কাগজ, শিশি, বোতল কুড়িয়ে আড়তে দিয়ে যা পেতো তা দিয়ে কোনোরকমে চলতো। কিন্তু সেই মাও একদিন কোথায় যে হারিয়ে গেল আর ফিরলো না। দু’দিন খুব কাঁদলো মায়ের জন্য, তৃতীয় দিনে চোখ মুছে উঠে পড়লো ট্রেনে মাকে খুঁজতে, জানে না ট্রেনটা কোথায় যাবে, নামলো এই গেদে স্টেশনে। মাকে পেল না কিন্তু থাকার জায়গা পেল, খাবার পেল, তাতেই চলছে, চলতে চলতে বছর পার।
বিশ্বকর্মা পুজোর দিন স্টেশনে এসে শুনি ট্রেন আসতে একটু দেরি হবে মাইকে ঘোষণা করছে, তখনই মনে হলো ভোলার কথা— দেখি তো ভোলা কোথায় আছে, কী করছে। ওর সঙ্গে দেখা হলে বেশ ভালোই লাগে কথাগুলো শুনতে। এগিয়ে যাই প্ল্যাটফর্মের মাথায় যেদিকে বাংলাদেশ বর্ডার। খানিকটা এগোতেই দেখি ভোলা দাঁড়িয়ে আছে ওপর দিকে তাকিয়ে। কী ব্যাপার দেখি তো, ওপর দিকে তাকাতেই দেখি আকাশে ঘুড়ির মেলা— বাব্বা!
কত ঘুড়ি। আমরাও স্কুলে পড়ার সময় ঘুড়ি উড়িয়েছি— লেজ দেওয়া ঘুড়ি। ভোঁ কাট্টা হয়ে গেলে মন খুব খারাপ হয়ে যেত। কারণ আবার ঘুড়ি কেনার জন্য পয়সা চাইতে গেলে বড়দের বকুনি, মুখঝামটা ছাড়া আর কিছুই জুটতো না।
‘কাকু দেখেছ কত ঘুড়ি?’ ভোলার ডাকে আমি হেসে ফেলি— তোর ঘুড়ি ওড়াতে খুব ইচ্ছে করে?
—হাঁ, খুব ইচ্ছে করে, ভালো লাগে ঘুড়ি ওড়া দেখতেও—।
—উড়িয়েছিস কখনো?
—না, কে কিনে দেবে ঘুড়ি, লাটাই। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ঘুড়ি ভোঁ কাট্টা হয়ে গেলে?
—বলিস কী, আমার তো খুব মন খারাপ হয়ে যেত ঘুড়ি ভোঁ কাট্টা হয়ে গেলে। কারণ বাড়ি থেকে তো একটার বেশি ঘুড়ি কিনে দিতো না।
—তুমি ছোটোবেলায় অনেক ঘুড়ি উড়িয়েছ, তাই না কাকু?
—হাঁ উড়িয়েছি, তবে বাবা একটার বেশি ঘুড়ি কিনে দিতো না। এই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ওড়াতাম। নিজের ঘুড়ি ভোঁ কাট্টা হয়ে গেলে তখন বসে থাকতাম কখন অন্য ঘুড়ি ভোঁ কাট্টা হবে। অন্য ঘুড়ি ভোঁ কাট্টা হলেই আমরা বন্ধুরা সব দৌড়ে যেতাম সেই ঘুড়িটা ধরতে। দৌড়ে ঘুড়ি ধরাটাও খুব মজার খেলা।
—পাখির মতো ভোঁ কাট্টা ঘুড়িগুলোকে দেখলেও আমার খুব হিংসে হয়।
—কেন?
—পাখিগুলো যেমন ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি উড়ে যেতে পারে, ভোঁ কাট্টা ঘুড়িগুলো ও তাই। আমরা তো সীমানা পেরোতে গেলেই পুলিশে ধরবে, ওদের তো ধরতে পারবে না। আজ কত ঘুড়ি ভোঁ কাট্টা হয়ে ওপারে চলে যাবে বলো।