চড়ুইপাখির দুঃখ

কাল্পনিক চিত্র

শ্রীমন্তী ভাণ্ডারী

কালীপূজার রাত। চারিদিক প্রদীপের আলোয়, বৈদ্যুতিক আলোর মালায় ঝলমল করছে। শুধু আলো নয় বাজির আলোয়, ধোঁয়ায়, শব্দে চারিদিক আচ্ছন্ন।

বিশেষত শব্দবাজির দৌরাত্ম্যে কান পাতা দায় একেবারে। পিন্টুদের পাড়ায় বড় ছেলেরা তো সবথেকে বেশি শব্দ বাজি পোড়ায়। কালীপটকা, দোদমা, আলুপটকা এত বেশি ফাটায় যে তার ভয়ংকর শব্দে, ধোঁয়ায় চারিদিক ভরে ওঠে, কেঁপে ওঠে। পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠরত পিন্টুর দাদুর বয়স প্রায় বাহাত্তর। আগের বছর তাঁর বুকে পেসমেকার বসেছে। এ বছর কালীপূজার দিন আসতেই তিনি একেবারে তটস্থ হয়ে আছেন। সন্ধে থেকে শুরু হবে শব্দবাজির অত্যাচার আর নিপীড়িত হবে বহু অসহায় মানুষ যাঁরা বৃদ্ধ, অসুস্থ তাঁর মতো। আর যারা একদম ছোট, সদ্যোজাত শিশু, সবেমাত্র জন্মেছে।


কালীপূজার দিন সন্ধেবেলা পিন্টু প্রস্তুত হচ্ছিল, বাজি পোড়াতে। যৌথ পরিবারের ছোট ছোট ভাইবোন, প্রায় জনাসাতেক মিলে তারা প্রতিবছর বাজি পোড়ায় তাদের বাড়ির সামনের একটি ছোট্ট খোলা মাঠে। দূরে অবশ্য বড়রা দাঁড়িয়ে থাকে। ছোটদের দেওয়া হয় পোড়াতে ফুলঝুরি, রংমশাল, রংদেশলাই কাঠি, সাপবাজি, চরকি, তুবড়ি ইত্যাদি। তাও তারা, ছোটরা যখন মাঠে বাজি পোড়ায়, তখন তাদের কাছাকাছি বড়রা, কাকু, নাহলে জ্যেঠু, বা বাবা দাঁড়িয়ে থাকে। আগুন দিয়ে সব বাজি ফাটানোর ব্যাপার বলে। এ বছরও তারা দলবেঁধে সন্ধে থেকে প্রায় ছটা থেকে প্রায় রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত বাজি পোড়াল।

বাজি পোড়াতে পোড়াতে ওরা শুনতে পাচ্ছিল দূরের থেকে দুম দাম বাজি ফাটানোর শব্দ। উঃ! কী শব্দ! যেন এক-একবার কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। হঠাৎ বুকটা চড়াৎ করে কেঁপে উঠছিল।

পিন্টু বাজি পোড়াতে পোড়াতে সেই কথাই ভাবছিল, সত্যিই দাদুর কত কষ্টই না হচ্ছে! আর তাদের পাশের বাড়ির বাদলকাকুর সদ্যোজাত ছেলেটি, যে সবে বারোদিন হল, হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছে, তার কী কষ্টটাই না হচ্ছে। সেও এই প্রচণ্ড শব্দের তাণ্ডবে কেঁপে কেঁপে উঠছে হয়ত। রাত নটা বাজল তাদের সব বাজি পুড়িয়ে ঘরে আসতে। ঘরে এসে সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে তারা সবাই দালানে পাতা শতরঞ্জির উপর একত্রে বসে লুচি, ছোলার ডাল, আলুর দম আর মিষ্টি খেল।

খাওয়া-দাওয়ার পরে সবাই মিলে একটু গল্প-গুজব করে যে যার ঘরে চলে গেল শুতে। এবার বড়রা, দাদু, বাবা, কাকা, জ্যাঠারা খেতে বসবেন। পিন্টু তার ঘরে ঢুকে বসল বিছানায়। এখন সে একটু গল্পের বই পড়বে। তারপর শোবে। দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িতে প্রায় এখন রাত সাড়ে দশটা বাজতে চলেছে। পিন্টু বসল তার প্রিয় কমিকস নন্টে ফন্টে নিয়ে। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ একটা কিচকিচ শব্দে সে বই থেকে চোখ তুলল। কোথা থেকে আসছে শব্দটা? ঠিক বুঝতে পারল না। পিন্টু ঘরের চারিদিকে চোখ বোলাল। উপরের, ছাদের সিলিংয়ের দিক থেকেই শব্দটা আসছে। পিন্টু বিছানার উপর দাঁড়িয়ে বুঝতে পারল, জানালার কিছুটা উপরে ঘুলঘুলি থেকে শব্দটা আসছে। পিন্টদের অনেক পুরনো আমলের বাড়ি। তাদের বাড়ি গ্রামে। ঘুলঘুলিতে প্রায়ই চড়ুই পাখি, পায়রা এসে বাসা বাঁধে। এবং বিছানায় কাঠি, খড়ের টুকরো, মাটির গুঁড়ো ফেলে। মা খুব বিরক্ত হয় পরিষ্কার করতে।

বাবাকে প্রায়ই বলে, ঘুলঘুলিগুলো বুজিয়ে দাও, যাতে পাখিরা আর বাসা করতে না পারে। কিন্তু তা আর করা হয়ে ওঠেনি।

পিন্টু দেখল বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলের উপর বাবার টর্চটা রাখা। পিন্টু বিছানার উপর দাঁড়িয়ে টর্চটা জ্বালিয়ে ঘুলঘুলির ভিতরটা দেখতে লাগল। পিন্টু দেখল ঘুলঘুলিতে চারটে চড়ুই পাখি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে। টর্চের আলো তাদের উপর পড়তে তারা ধীরে ধীরে ডানা ঝাপটাতে লাগল। আর মুখে কিচকিচ শব্দ করতে লাগল। পিন্টু টর্চের আলো নিভিয়ে দিল। এবার তার খুব ঘুম পাচ্ছে। বাবা এখনো ঘরে আসেনি। মায়ের আরো দেরি হবে খাওয়া সেরে ঘুমাতে আসতে।

পিন্টু ঘরের বড় আলো নিভিয়ে ছোট আলো জ্বালিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। এবং একটু পরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
ঘুমের ঘোরে সেদিন পিন্টু স্বপ্ন দেখল ওই চারটে চড়ুই পাখিকে।

তারা যেন দল বেঁধে এসে হাজির হয়েছে পিন্টুর কাছে। অসহায় গলায় বলছে, কেন তোমরা এত শব্দের বাজি ফাটাও কালীপূজার রাতে? ওই শব্দে আমাদের কত কষ্ট হয় সে কি বোঝো? ভীষণ শব্দে আমাদের বুক এত ধড়ফড় করে যেন মনে হয় আমরা হার্ট ফেল করে মরে যাব। কালীপূজার দিন যেদিকেই যাই, সেদিকেই শুধুমাত্র ধোঁয়া, শব্দ আর আলো। বাজির আলোয় আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বাজি পোড়ানোর ধোঁয়ায় আমাদের কাশি হয়। বাজি ফাটানোর প্রচণ্ড শব্দে আমাদের বুকটা এমন ধড়াস ধড়াস করে যেন মনে হয় এক্ষুণি বুক ফেটে আমরা মরে যাব। তুমি কি জান, আগের বছর কালীপূজার রাত্রে আমাদের কতকগুলো বন্ধু চড়ুই পাখি তোমাদের বাজি ফাটানোর প্রচণ্ড শব্দে বুক ফেটে, হার্ট ফেল করে মরে গেল। তবু কি তোমরা আমাদের কথা ভাববে না? তবু কি তোমরা আমাদের কষ্ট অনুভব করবে না? বলো, বলো?
ঘুমের ঘোরে, স্বপ্ন দেখে পিন্টু আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে। সত্যি তো তোমাদের কত কষ্ট গো! কত দুঃখ গো! হঠাৎ বাবার ঠ্যালায় তার ঘুম ভেঙে যায়। সকাল হয়ে গেছে। সকালের উজ্জ্বল আলো জানালা গলে এসে পড়েছে লাল সিমেন্টের মেঝের উপরে। সেদিকে তাকিয়ে পিন্টু কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে বিছানার উপরে। তারপর তড়াক করে উঠে বিছানার উপর দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করে ঘুলঘুলির মধ্যে আশ্রয় নেওয়া চড়ুই পাখিগুলোকে।

পিন্টুর বাবা অরুণবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী রে, কী দেখছিস? পিন্টু ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, বাবা, তোমার টর্চটা দাও না গো! দেখি তো ঘুলঘুলিতে চড়ুই পাখিগুলো কী করছে? বেঁচে আছে কিনা!

পিন্টু ঘুলঘুলির মধ্যে টর্চ মেরে দেখল, চড়ুইগুলো তখনো বোধহয় ঘুমাচ্ছে। তারা কেমন ডানায় মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় ঘুমাচ্ছে। হয়ত বেলা হলে উড়ে চলে যাবে অন্য কোথায়ও। সত্যি ওরা কত অসহায় অবস্থায়, কত কষ্ট, কত যন্ত্রনা সহ্য করে শব্দের তাণ্ডবে অতিষ্ট হয়ে এখানে এই ঘুলঘুলিতে আশ্রয় নিয়েছে।

বাবাকে পরে সব খুলে বলতে হবে। দেখা যাক তিনি কী বলেন, কী করেন।