মন্ত্রীর বুদ্ধি

কাল্পনিক চিত্র

সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

অনেককাল আগের কথা। তখন আনন্দনগর রাজ্যের রাজা ছিলেন মহারাজাধিরাজ নরেন্দ্র প্রতাপ সিংহ।‌ রাজ্যটার নাম আনন্দনগর হলেও জলের অপ্রতুলতার জন্য প্রজারা ছিল নিরানন্দ। একমাত্র নদীতে বর্ষাকাল ছাড়া সারা বছর চড়া পড়ে থাকত। ফলে জল থাকতো না। সামান্য কিছু পুকুরের অল্প জলে প্রজারা নিত্যদিনের কাজকর্ম, চাষাবাদ করত। জনসংখ্যা কম, তাই অল্প চাষের ফসলেই প্রজাদের কোনোরকমে দিন কেটে যেত।
রাজামশাই কিন্তু এসব নিয়ে একদমই ভাবতেন না। তাঁর বাগানে ছিল মস্ত বড় এক দীঘি। সেই দীঘির টইটম্বুর জলে খেলা করত কত রাজহাঁস, বালিহাঁস, জলপিপি, মাছরাঙা, পানকৌড়ি ও আরও কত নাম-না-জানা পাখি। আর ফুটে থাকত সুন্দর সুন্দর পদ্মফুল। তিনি ওই বাগানে বসে দীঘির শোভা দেখতে দেখতে আমোদ প্রমোদে মেতে থাকতেন।‌

মন্ত্রীমশাই রাজ্যের মানুষদের জলকষ্টের কথা জানতেন।‌তিনি বহুবার তাদের এই দুঃখের কথা মহারাজের কাছে নিবেদন করেছিলেন। বলেছিলেন, কয়েকটা গভীর পুকুর খনন করবার জন্য। কিন্তু রাজামশাই কর্ণপাত করেননি। মন্ত্রীমশাই সর্বদা ভাবতেন, কীভাবে তাদের এই দুঃখকষ্ট দূর করা যায়। শেষে অনেক ভেবে ভেবে একদিন তিনি একটা বুদ্ধি ঠাওরালেন।


রাজামশাই বসে ছিলেন তাঁর রানির সঙ্গে বাগানে।‌ মন্ত্রীমশাই করজোড়ে এসে কুর্নিশ করে দাঁড়ালেন। রাজামশাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মন্ত্রী কিছু বলবে বলে মনে হচ্ছে?’
‘আজ্ঞে অনেকদিন ধরে একটা কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যদি অভয় দেন তো নিবেদন করি মহারাজ।’
‘বলো বলো, তোমার কী নিবেদন।’

‘আজ্ঞে হুজুর, শুনেছি, পৃথিবীর সকল শ্রেষ্ঠ নৃপতিদের অনেকগুলো করে প্রাসাদ আছে। তা হুজুর—’
‘এটা তো বেশ ভালো একটা কথা বললে। বেশ ভেবে দেখতে হয়’— রাজামশাই গম্ভীরমুখে উত্তর দিলেন। পরদিন রাজসভাতে তিনি মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিলেন তাঁর জন্য একটা নতুন রাজপ্রাসাদ গড়বার।

মন্ত্রীমশাই তৎক্ষণাৎ রাজ্যের সেরা স্থপতিকে খবর পাঠালেন। পরদিনই স্থপতি এল।‌ মন্ত্রী বললেন, ‘শোনো স্থপতি, মহামান্য হুজুরের জন্য একটা সুদৃশ্য, মজবুত রাজপ্রাসাদ বানাতে হবে।’

‘হুজুর, যদি অনুগ্রহ করে বলেন, কোথায় রাজপ্রাসাদটি হবে, তাতে কী কী থাকবে।’ — স্থপতি নতজানু হয়ে নিবেদন করল।

মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘আমাদের রাজ্যের ঠিক মাঝখানে একমাত্র যে পাহাড়টি রয়েছে, তার উপরেই গড়তে হবে এই সুরম্য রাজপ্রাসাদ। রাজপ্রাসাদটি খুবই শক্তিশালী পাথর দিয়ে বানাতে হবে।‌ঝরনার জলে হবে অপরূপ বাগান। তাতে থাকবে ফলের গাছ, ফুলের গাছ।’

স্থপতি বলল, ‘পাথর দিয়ে রাজপ্রাসাদ বানাতে হবে, তাই পাহাড়ের একদিকের পাথর ভেঙে নিতে হবে।’
‘না না স্থপতি, পাহাড়ের পাথর ভাঙা চলবে না। তা ভাঙলে পাহাড় হবে ভঙ্গুর। যখন তখন ধস নেমে মহারাজের রাজপ্রাসাদের ক্ষতি হতে পারে।‌ আমি তোমাকে পাথরের খোঁজ দিচ্ছি।‌তুমি কিছু চিন্তা করো না। এসো আমার সঙ্গে।’

এই বলে মন্ত্রীমশাই স্থপতিকে নিয়ে গেলেন জনবসতিপূর্ণ প্রতিটি স্থানের পাশে। আর আদেশ দিলেন, বড় বড় পুকুর খুঁড়তে। সমস্ত মাটি সরালেই নিচে পাওয়া যাবে পাথর।

স্থপতির লোকজনেরা অনেকগুলো পুকুর তৈরি করল। তারপরে সেই মাটি এনে ফেলল পাহাড়ের গোড়ায়। সেই মাটির উপর দিয়ে রাস্তা তৈরি হল পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত। তখন পুকুরের তলার পাথর ভেঙে নিয়ে আসা হল পাহাড়ের উপরে। সেই পাথর দিয়ে স্থপতি তৈরি করতে লাগল এক বিশাল সুরম্য রাজপ্রাসাদ।
পুকুর হয়ে যাওয়াতে প্রজাদের দুঃখও দূর হল। সেই জল আর শুকোচ্ছে না, কারণ তা পাথর সরানো অনেক তলার জল।

প্রজারা রাজার নামে কোনোদিন জয়ধ্বনি দিত না। কিন্তু রাজামশাই যখন নতুন বানানো রাস্তা দিয়ে উঁচু পাহাড়ে রাজপ্রাসাদে চললেন, প্রজারা খুশি হয়ে বারবার জয়ধ্বনি দিতে লাগল।‌ তারা আজ খুশি।‌
খুশি মন্ত্রীমশাইও।