সম্বুদ্ধ দত্ত
রবিনগর বাসস্ট্যান্ড যেন এক মিলন তীর্থ। বাসস্ট্যান্ডের একেবারে পূর্ব দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এক বিখ্যাত ক্লাব। নাম রবিনগর উন্নয়ন সমিতি। এমন নামের অবশ্য একটা মাহাত্ম্য আছে। কারণ সমিতির সদস্যরা বছরভর উন্নয়নের নানা মহান কাজের মধ্যে নিজেদের যুক্ত রাখে। উদাহরণ হিসাবে বলার মতো বিষয়ের অভাব নেই। সমিতির কর্তাদের নেতৃত্বে বাসস্ট্যান্ডের জায়গা জুড়ে ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ নামে একটা শববাহী গাড়ি এবং একটা অ্যাম্বুলেন্স সদা মানুষের সেবায় প্রস্তুত। ডাক এলেই পৌঁছে যায় একেবারে প্রতিবেশীদের দ্বারে।
আজব এই বাসস্ট্যান্ড। কী নেই এখানে। বাসস্ট্যান্ডের জায়গা দখল করে পান, বিড়ি সিগারেটের গুমটি আছে। সন্ধ্যার অন্ধকার নামার আগেই এখানে ফুচকা আর ফাস্টফুডের স্টলে আলো জ্বলে উঠছে। এসবের পাশাপাশি ধীরে ধীরে বাসস্ট্যান্ডে সবজি থেকে বেশ কয়েকটা ফলের দোকানও গজিয়েছে। পুরুষ ও মহিলা পথচারীদের হঠাৎ নিম্নচাপের কথা ভেবে সরকার বাসস্ট্যান্ডে সুলভ শৌচালয় তৈরিও করে দিয়েছে। এই বাসস্ট্যান্ডে বলার মতো আরও অনেক কিছু আছে । এই যেমন ফিবছর বিশাল দুর্গাপুজো, কালীপুজো থেকে বিশ্বকর্মা পুজোর আয়োজন আছে। কালীপুজার পরেই মহাসমারোহে তুবড়ি প্রতিযোগিতায় আছে। পুজোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশাল সংগীতানুষ্ঠান আছে। বলিউড ও টলিউডের শিল্পীদের রাত কাঁপানো পারফরমেন্স আছে। শীতের রাতে আলো ঝলমলে বাসস্ট্যান্ডে আন্ডারআর্ম ক্রিকেট টুর্নামেন্টও আছে। এখানেই অবশ্য শেষ নয়। প্রতিবছর মানব কল্যাণে রক্তদান উৎসব আছে। ঘটি, বাটি, হাঁড়ি, পাতিল থেকে বালতি রক্তদাতাদের পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। বৈশাখে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা আছে। ১৫ই আগস্ট, ২৩ শে জানুয়ারি থেকে ২৬ শে জানুয়ারি জবরদস্ত দেশপ্রেমের অনুষ্ঠান আছে। আছে ইংরাজি বর্ষ বরনের আলো ও আতশবাজি সমারোহে দমফাটা উত্তেজনা। ১লা বৈশাখে বাংলা সনের সংখ্যা বলতে না পারলেও উৎসবের চাকচিক্য আছে। একেবারে নিয়ম করে রাখিবন্ধন উৎসব আছে। রথযাত্রায় রথের প্রর্দশনীর সঙ্গে পুরস্কার আছে। লোক সমাগমের এমন কেন্দ্র বাসস্ট্যান্ডে সমস্ত রাজনৈতিক দলের সভা লেগেই আছে। রবিনগর বাসস্ট্যান্ডকে বিজ্ঞাপন করে প্রমোটার ও দালালদের রমরমা কারবার আছে। একটা নয়, দু’দুটো অটোরিক্সা স্ট্যান্ডের পাশাপাশি সাইকেল রিকশা স্ট্যান্ডও আছে। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এত, এত কিছু আছে। সেই বাসস্ট্যান্ডে একটা জিনিসই নেই। তাঁর নাম ‘বাস’। মোদ্দা কথা, রবিনগর বাসস্ট্যান্ডে বাস ছাড়া সবই আছে। বাস্তবে বাসস্ট্যান্ডটাই ধীরে ধীরে দখল হয়ে গেছে।
রবিনগর বাসস্ট্যান্ডের কথা বলতে গেলে যে কথাটা না বললে রবিনগর অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য অপূর্ণ থেকে যাবে সেটা হল এই বাসস্ট্যান্ডের আড্ডা। এখানে সকাল থেকে অন্তত রাত ১১টা অবধি বেশ কয়েকটা দল পর্যায় ভাগ করে আড্ডা দিয়ে চলে। এই আড্ডাবাজদের বয়স ২০ থেকে ৮০। চাকরিজীবী থেকে ব্যবসায়ী, সব পেশার আড্ডাবাজদের এখানে সহাবস্থান। এই আড্ডাকে কেন্দ্র করে কখনও সখনও ছোটখাটো ঝামেলা ও অশান্তির ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। তবে এই আড্ডায় হাসিঠাট্টার সঙ্গে মজার ঘটনাও কিছু কম ঘটে না।
এই যেমন পাড়ার অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের শিক্ষক ভবতোষ ঘোষালের প্রতিদিন বাসস্ট্যান্ডের আড্ডায় হাজির হওয়া চাই-ই চাই। বাসস্ট্যান্ডে দু’বেলা হাজির না হলে তাঁর পেটের ভাত হজম হয় না। সংসার চুলোয় যাক কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের আড্ডা মিস করা তাঁর চলবে না। এই আড্ডা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে ভবতোষ মাস্টারের কম অশান্তি হয়না। ভবতোষ মাস্টারের সোজা কথা সংসারের অশান্তি আর নানা হ্যাপা থেকে মুক্তি পেতেই তো এখানে আসা। সুতরাং আড্ডায় আসা তাঁকে কেউ আটকাতে পারবে না।
ভবতোষ মাস্টার অবশ্য এলাকায় ভব মাস্টার নামেই পরিচিত। ভব মাস্টার সমিতির বাইরের একটা বেঞ্চে নিয়মিত আড্ডায় বসেন। এখানে তাঁর পুরনো ছাত্রদের কাউকে একবার দেখতে পেলেই তাঁকে আঁকড়ে ধরেন। ছাত্রটির কর্মজীবন এবং সাংসারিক জীবনের বিস্তারিত খবর না জানা অবধি ছাত্রটির নিস্তার থাকে না।ছাত্রদের উন্নতির সংবাদে ভব মাস্টারের বুকের ছাতি চওড়া হয়ে ওঠে। আড্ডার সঙ্গী সাথীদের কাছে নিজেকে মানুষ গড়ার কারিগর বলে বুক ঠুকে জাহির করেন। কিন্তু ভব মাস্টারের একটা মহা বদভ্যাস আছে। সেটা হল জীবনে অসফল ছাত্রদের বাসস্ট্যান্ডে সবার সামনে নানা হাসি ও ব্যঙ্গ তামাশা করা। ছাত্ররা মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও ছোটবেলার মাস্টারের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করে না। মুখ বুঁজে অপমান হজম করে। কিন্তু সব ছাত্র তো সমান না। কেউ কেউ আড়াল থেকে ভব মাস্টারকে কটুক্তি করতেও পিছপা হয় না। ব্যপারটা ভব মাস্টার যে জানে না তা নয়। তবুও এই অভ্যাস সে কিছুতেই বদলাতে পারল না।
একদিন ভব মাস্টার ক্লাবের সামনে বেঞ্চে বসে অনেকের সঙ্গে প্রতিদিনের মতোই আড্ডা দিচ্ছেন। এমন সময় সেখানে একটা মাটি ভর্তি লরঝরে লরি এসে দাঁড়াল। লরিটা দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ভব মাস্টারের পুরনো ছাত্র নিমাই নিয়োগী এক লাফে ড্রাইভার কেবিন থেকে নিচে নেমে এল। নিমাইকে দেখেই ভব মাস্টার তাঁকে বেঞ্চে বসতে বলে পিঠে হাত রেখে বললেন, নিমাই তুই এখন তাহলে এই রাবিশ আর মাটি সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করছিস। বাহ্ বেশ ভালো। কোনও কাজই অবশ্য খারাপ না। কোনও কাজেই লজ্জা নেই। কিন্তু আমার এক একজন ছাত্র আজ কোথায় পৌঁছে গেছে তা আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারি না। তাদের দেখলে বুকটা আমার ভরে ওঠে। আর তুই কিনা শেষে…, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভব মাস্টার আবার শুরু করল, নিমাই তাহলে শোন, একটা ঘটনা বলি। কিছুদিন আগে একটা কাজে ডালহৌসি গেছি। ফেরার সময় বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। বাস দেখলেই দুই পা এগোই। ভাবি, এই বুঝি আমাদের রবিনগরের বাস এল। কিন্তু কোথায় বাস। মনে মনে বেশ বিরক্ত লাগছে। এমন সময় ঘটল এক আজব কান্ড। হঠাৎ দামী ব্লেজার গায়ে হাতে ব্রিফকেস নিয়ে এক বছর চল্লিশের সুপুরুষ রাস্তার মাঝে আমাকে সটান পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসল। আমি তো একেবারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছি। ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। হতভম্ব হয়ে শেষে ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, মশাই আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না? ভদ্রলোক মাথা নিচু করে উত্তর দিল, মাস্টারমশাই আমায় চিনতে পারলেন না? আমি আপনার হাত গড়া নেত্রমোহন স্কুলের ছাত্র নিখিলেশ, মানে মিত্র বাড়ির অমলেশ মিত্রর ছেলে। কথাটা শোনামাত্র আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। মনে হল আমার মাস্টার জীবন সার্থক। আর আজ যখন দেখি তুই আমার ছাত্র হয়ে এই লড়ঝড়ে লরিতে মাটি আর রাবিশ সাপ্লাই করছিস তখন আমার মাথাটা একেবারে মাটিতে মিশে যায়। বুকটা চুপসে আসে। ওরে নিমাই, তখন তোকে কতবার বলেছি ভাল করে লেখাপড়াটা কর। সেদিন আমার কথা শুনলে আজ তোকে অন্তত এই রাবিশ- মাটি বেচে খেতে হত না।
ভব মাস্টারের এমন কথায় নিমাইয়ের মাথায় আগুন ধরে গেল। তবুও সে কোনও উত্তর না দিয়ে এক লাফে লরিতে উঠে পড়ল। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে লোকের মাঝে নিমাই এতবড় অপমানটা কিছুতে মেনে নিতে পারল না। সে মনে মনে ভব মাস্টারকে এই অপমানের ফিরতি জবাব দেওয়ার জন্য মুখিয়ে রইল।
ঘটনার সপ্তাহ খানেক পরে ওই একই জায়গায় নিমাইয়ের সঙ্গে ভব মাস্টারের আবার দেখা। নিমাই যেন এই দিনটার জন্যই মুখিয়ে ছিল। সে ভব মাস্টারের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, মাস্টারমশাই গতকাল থেকে আপনাকেই খুঁজছিলাম। ভব মাস্টার উৎসাহের সঙ্গে কারণ জানতে চাইলে নিমাই বলল, এই তো গত পরশু হাওড়া ব্রিজের বাঁদিকের ফুটপাত ধরে বড়বাজারের দিক থেকে হাওড়া স্টেশনের দিকে হেঁটে যাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ কানে এল— কে যেন নিমাই নিমাই চিৎকার করে আমায় ডাকছে। আমি তো একেবারে অবাক। এখানে আবার কে আমায় ডাকবে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখছি। অথচ কোনও চেনা মুখও নজরে আসছে না। হঠাৎই চোখে পড়ল ব্রিজের পূর্ব দিকের বড় থামের পাশে কপালে সিঁদুরের টিপ লাগিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবী পরা একটা লোক খাঁচায় টিয়াপাখি নিয়ে বসে আছে। লোকটার হাতের ইশারায় শেষে বুঝতে পারলাম, সে আমাকেই ডাকছে। হাজার চিন্তা মাথায় নিয়ে এক-পা দু-পা করে লোকটার কাছে এগিয়ে গেলাম। টিয়া জ্যোতিষীর কাছে যেতেই সে বলল, তুই আমাদের রবিনগরের নিমাই না? টিয়া জ্যোতিষীর কথায় আমি তো একেবারে হাঁ। মাথা ঝুঁকিয়ে তার কথায় সম্মতি জানাতেই সে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল, নিমাই আমায় চিনতে পারছিস না? আমি অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই ওই টিয়া জ্যোতিষীকে চিনতে পারছি না। তখন লোকটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে আবার বলল, সে কি রে ভাই, আমায় চিনতে পারছিস না? আমি আবার মাথা দুলিয়ে না বললাম। এবার সে আমাকে সম্পূর্ণ অবাক করে বলল, আমি রবিনগর নেত্রমোহন স্কুলের ভবতোষ মাস্টারের ছাত্র হীরেন। হীরেন হাওলাদার। ভব মাস্টার বুঝতে পারল, একেই বলে ইটের জবাবে পাটকেল। ভব মাস্টারের আড্ডার সঙ্গীরা সবাই তখন হো হো করে হাসছে। সঙ্গীদের মধ্যে থেকে একজন আবার ফুট কেটে বলল, মাস্টারমশাই কিছু বুঝলেন? রাগে অপমানে ভবতোষ মাস্টারের মুখ থেকে শুধু একটা শব্দই বেরিয়ে এল ‘ডিসগাস্টিং’।