পঞ্জুড়ি

কাল্পনিক চিত্র

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

রজতাভ অবাক হয়ে দেখছিল চারপাশ। এই প্রথম সে কলকাতা বিমানবন্দরের ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে এসেছে। সারাটা জীবন কলকাতার অফিসে প্রশাসনিক দপ্তর সামলে কখনও এতো কাছে থাকা টার্মিনালে আসাই হয়নি। আসলে সরকারি চাকরির বিধিনিষেধে হারিয়ে গিয়েছিল রজতাভর মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা সেই সুপ্ত ইচ্ছে। সানন্দা সেটা বুঝতে পেরেই মনে মনে শান্তি পাচ্ছিল। এই বিদেশ সফর তার জীবনেও তো প্রথম। ঠিক যেন স্বপ্নের মতো।

কৌশিক আর রুমা চেক-ইন ব্যাগেজের ব্যাপারগুলো দেখছিল। ওদের কাছে বিদেশ ভ্রমণ জলভাত। রজতাভ আর সানন্দার কাছে তাদের ছেলে-বৌমা একটা গর্ব করার বিষয়। আত্মীয়মহলে আলোচনা শুরু হলে ওদের কথা আসবেই। খানিক তফাতে মিস্টার আর মিসেস ঘোষ দাঁড়িয়ে। ঘোষপরিবার রজতাভদের বেয়াই-বেয়ান। তারাও তাদের সহযাত্রী। যদিও কখনও তাদের বেয়াই-বেয়ান মনেই হয় না ওদের। এতো বড় একটা পরিবার নিয়ে আজ চল্লিশ বছর বিকাশভবনে কলম পেশা রজতাভর বুকের প্রস্থ পঞ্চাশ ইঞ্চি।
—বাবা, এটা বোর্ডিং পাস। আর এটা পাসপোর্ট। এগুলো একদম হারাবে না। আলাদা করে রাখবে। মা দেখো, বাবা যেন ভুলে না যায়…


আজকাল অদ্ভুত এক অসুখ হয়েছে রজতাভর। ছোটছোট অনেক জিনিস মনেই থাকে না। এই তো সেদিন, চশমাটা টিভির সামনে রেখে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তারপর আরেকদিন, স্কুটারের চাবিটা স্কুটারে লাগিয়ে রেখেই চলে গিয়েছিল বাজারে। এই মনে না থাকাটা নিউরোলজিস্ট দেখে বললেন ‘আর্লি ডিমেনশিয়া’। কিন্তু ওষুধপত্র তেমন দিলেন না। দু-একটা। বরং বললেন ঘুম, খাওয়া আর গড়িয়ে পড়া পাথরের ওপর বাধা সৃষ্টি করে তার গতিবেগ কমানোর চেষ্টার মতোই এই রোগের চিকিৎসা। এইসব।

অবশ্য সানন্দা থাকলে তার কোনও চিন্তা থাকে না। সানন্দা মনে করিয়ে দিচ্ছিল সব। তাই কৌশিক বলতেই রজতাভ সাবধানে বুকপকেটে রেখে দিল পাসপোর্ট আর পাস। এতো বড় প্লেন সে কখনও দেখেনি। প্লেন আকাশে ভাসমান হতেই মিস্টার ঘোষ বললেন, ‘কী রজতাভবাবু, কেমন লাগছে?’ রজতাভ হেসে বলল, ‘স্বপ্নের মতো!’ সারাটা প্লেন সানন্দার হাত ধরে রইল সে। মাঝে বৌমা এসে কী করে টিভি দেখতে হয় দেখিয়ে দিয়ে গেল। একটা ইংরাজি সিনেমা দেখছিল সে। ‘ফাদার’। খানিকটা দেখতে দেখতে ভাবল সে। এসব বিদেশেই হয়। ওখানে বাবা-মা বুড়ো হয়ে গেলে বাতিলের খাতায় চলে যায়। তখন তাদের বৃদ্ধাশ্রমের বিনে ফেলে দেওয়ার নাম হল সভ্যতা। এটা তার দেশের সংস্কৃতি নয়। ভাগ্যিস নয়।

আবুধাবি ছুঁয়ে এবার প্লেন চলল হিথরোর দিকে। রজতাভ দেখল তার পা কাঁপছে। ছেষট্টি বছর বয়সে এই প্রথম তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই তারা লন্ডনে পৌঁছোবে। লন্ডন। ভাবা যায়! কালাপানি পেরিয়ে ইংরেজদের দেশে। সানন্দা হেসে বলল, ‘কি গো, ভয় করছে?’ রজতাভ হেসে বলল, ‘নাহ্‌। রোমাঞ্চ হচ্ছে। প্রথম প্রথম তোমার সঙ্গে দেখা করার আগে যেমন হতো।’ সানন্দা মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘ওখানে আবার কোনও মেমসাহেবের প্রেমে পড়ো না যেন।’

হিথরো থেকে গাড়ি বলা ছিল। রজতাভরা চলল লন্ডনের হোটেলের দিকে। এখানে কত রাত অবধি সূর্য থাকে। এখন সন্ধে সাড়ে সাতটা। আকাশ দেখে তা বোঝারই উপায় নেই! চারপাশে খটখটে রোদ্দুর!
—বাবা। পাসপোর্ট হারাবে না। এখানে গাড়ি খুব তাড়াতাড়ি যাতায়াত করে। আর রাস্তা পার হলে জেব্রা ক্রসিং ধরেই পার হবে।

কৌশিক বুঝিয়ে দিচ্ছিল। মিস্টার আর মিসেস ঘোষের অবশ্য এটা প্রথম বিদেশসফর নয়। মিস্টার ঘোষ ব্যাঙ্কে ছিলেন। ব্যাঙ্কে অতো নিয়মের কড়াকড়ি থাকে না। তাছাড়া রজতাভর বৌমা, রুমা তো লন্ডনেই ছিল চাকরি পাবার পর। বছর দুয়েক। কৌশিকের সঙ্গে সেখানেই আলাপ। অবশ্য ঘোষবাবু বেশ মিশুকে। লন্ডনের দোতলা বাসে বসে রজতাভ ভাবছিল, তার চারপাশ কেমন স্বপ্নের মতো যেন।
—কাল আমরা ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে যাব। তারপর রয়্যাল অ্যালবার্ট হল।

নিমেষেই যেন দিনগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে। তবে এদেশে এসে একটা জিনিস বুঝতে পারল সে। এখানে সবকিছুরই একটা কিউআর কোড আছে। হোটেলে গিয়ে রিসেপশনে ঘরের জন্য বাড়তি মাজন চাইলে কিউ আর, রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ যদি কোনও বাগানে হাঁটতে ইচ্ছে করে, তাহলেও কিউ আর। এখানে লোকজনের হাসিটাও কিউআর-এই মাপা। সবাই সবাইকে কথায় কথায় ‘প্লিজ টু মিট ইউ’ আর ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলছে। অথচ তারপর আর কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। কৌশিক রজতাভকে একটি ফোরেক্স কার্ড দিয়েছে। এই কার্ডটা অনেকটা ডেবিট কার্ডের মতো। নিজের দেশ ছাড়ার আগে প্রত্যেকের জন্য টাকা ভরিয়ে দিয়েছে কৌশিক। কার্ড থাকলে ফরেন কারেন্সির ঝঞ্ঝাট নেই। কার্ড সোয়াইপ করো। হয়ে গেল। সব দরজা খুলে যাবে। রজতাভ আর সানন্দার জন্য একটি তেমনই কার্ড করিয়ে দিয়েছে কৌশিক। বিগ বেন দেখতে দেখতে রজতাভ সকলকে বলল, ‘এখানে একটা ছবি তোলা যাক।’ ছবি তোলার পর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কৌশিক আবার মনে করিয়ে দিল, ‘বাবা, পাসপোর্ট সামলে রাখবে। আর মোবাইলও। এখানে কিন্তু পকেটমারিও হয় খুব’। ঘোষবাবু হেসে বলল, ‘আমাদের মেয়েও ঠিক এমন করে সবসময়। চিন্তা করবেন না চৌধুরীবাবু। আমরা খেয়াল রাখছি।’

একটা বড় কাচের ঘরে বসে তারা আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। নীচে বয়ে চলেছে টেমস্ নদী। এর নাম লন্ডন আই। দূর থেকে লন্ডন শহর দেখতে দেখতে রজতাভ হঠাৎ হাওড়া ব্রিজ খুঁজতে চাইছিল। এই নদী ঠিক যেন ভাগীরথীর মতোই। শহরটার সঙ্গে তার নিজের শহর কলকাতার কতো মিল। শুধু অভিমান করেই কলকাতা থেকে ডাবলডেকারগুলো তুলে দিল সরকার! আই থেকে নামতেই বৃষ্টি নামল। লন্ডনে এমন বৃষ্টি যখন তখন নামে। পাশেই অদ্ভুত সুন্দর ছাতা বিক্রি হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্ট। এমন ছাতা কলকাতায় সচরাচর পাওয়া যায় না। রজতাভ সানন্দাকে বলল, ‘একটা ছাতা কিনি চলো, বাচ্চাগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে।’ সত্যি কৌশিক আর রুমা ভিজছিল বৃষ্টিতে। তবে এতে তাদের দূর থেকে বেশ রোম্যান্টিক কাপল্‌ লাগছিল। ছাতার দাম দুই পাউন্ড। প্রায় দুশো টাকা। খুব বেশি নয়। কার্ডটা বের করতে গিয়েই হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল রজতাভর। প্যান্টের পকেটে তার পার্সটা নেই! পার্সেই তো কার্ডটা ছিল। পাসপোর্ট? বুক খামচে দেখল, নাহ। ওটা আছে। তাহলে পকেটমারিই হল। কৌশিক জানলে বকা দেবে খুব। বৃষ্টির ভিতরেও দরদর করে ঘামছিল সে। সানন্দা বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?’
—আমার পার্সটা…চুরি হয়ে গেছে…
—সে কী! এই তো দেখলাম তুমি ওই আইএ বসে সীটে পার্স রেখে বসেছিলে। তোমাকে কতবার পার্সটা প্যান্টে ঢোকাতে বললাম। তুমি তো ঢোকালেও…
—ঢুকিয়েছিলাম কি! সীটেই ফেলে রেখে এলাম না তো…
সানন্দা একটু ভেবে বলল, ‘দাঁড়াও। কৌশিককে বলি একবার। এটা তো সভ্য দেশ। এখানে তোমার পার্স কেউ নেবে না।’

বৃষ্টিটা ধরে গেছে। এটাই লন্ডনের নিয়ম। এই বৃষ্টি এই রোদ। সারা বছর। সানন্দা কথাটা কৌশিক আর রুমাকে বলতেই ওরা দু’জনে চিন্তিত হয়ে পড়ল। একবার দৌড়ে গেল আই অপারেটরের কাছে। অপারেটরের ঘাড় নাড়া দেখে বুঝল এতো ভীড়ের মাঝখানে ওই ক্যাপস্যিউল থেকে রজতাভর পার্স খুঁজে বের করা অসম্ভব। মিস্টার আর মিসেস ঘোষ কিছু একটা ঘটেছে আন্দাজ করে এগিয়ে এলেন। সব শুনে মিস্টার ঘোষ বললেন, ‘পাসপোর্টটা হারাবেন না। পাসপোর্ট হারালে কিন্তু খুব হ্যাপা।’

মিসেস ঘোষ বললেন, ‘আহা, চিন্তা করছেন কেন? আমরা তো একসঙ্গেই আছি। ক’টা দিনের তো ব্যাপার। সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।’

যাক। খানিকটা হালকা লাগল এবার রজতাভর। বুকপকেট খিমচে একবার দেখে নিল সে। না, পাসপোর্ট ঠিক আছে। ঠিকই তো। সুজন হলে তেঁতুলপাতায় ন’জন, আর তারা তো মাত্র ছ’জনের পরিবার। অবশ্য এইসব তালেগোলে তার আর ছাতা কেনা হল না।

রাতে হাউন্সলোতে ফিশ অ্যান্ড চিপ্স খেল সকলে। এখানে এটা খুব জনপ্রিয় ডিশ। অনেকটা ফিশ ফ্রাইয়ের মতো, সঙ্গে মোটা লম্বা মুচমুচে ভাজা আলু আর সস। রজতাভদের বিলটা কৌশিকই দিল। হোটেলে ফিরে নিজের ভোলামনকে নিজেই দুষছিল সে। সানন্দা বলল, ‘এতো চিন্তা করো না। ছেলে বৌমা আছে তো। ওরা ঠিক ম্যানেজ করে দেবে। আর তো মাত্র দু’দিন। আমি ঘরে ফিরে ওদের টাকাটা দিয়ে দেব।’

দু’দিন কেটে গেল নিমেষের মতোই। এর ভিতর কত কিছু দেখে ফেলল রজতাভ, পিকাডিলি, বাকিংহাম রাজবাড়ি, মাদাম তুশো, অ্যালবার্ট হল। বাজেট কাটিংয়ে অবশ্য অ্যালবার্ট হলে গানের কনসার্টটা মিস করতে হল। ফিরতি প্লেন যেদিন, সেদিন রজতাভর একটু আফশোস হল বটে। লন্ডনফেরত কোনও মেমেন্টো নেওয়া হল না তার। বোনাই সতীনাথের নাতনির জন্য অন্তত একটা ফ্রিজম্যাগনেট নেবে ভেবেছিল সে, অথবি অফিস কলিগ শুভ্রজিতের জন্য একটা চাবির রিঙ। দাম অল্পই। কিন্তু কৌশিকের কাছে হাত পাততে পারেনি সে।

কীভাবে নেবে। সে যে এখন কপর্দকশূন্য। ঠিক যেমন চাকরির আগে বেকার অবস্থায় ছিল। শেষ দু’দিন কৌশিক কেমন একটু গম্ভীর হয়ে গেছে। বৌমাও তেমন কথা বলছে না। এয়ারপোর্টে এসে অবশ্য এমন একটা ঘটনা ঘটল যার জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিল না। কিছু একটা ঘটেছে আন্দাজ করে কৌশিকের কাছে যেতেই কৌশিক বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কিছু না।’ মিস্টার ঘোষকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ইজরায়েল ইরানের যুদ্ধের জেরে ঘরফিরতি সমস্ত বিমান বাতিল হয়ে গেছে। দু’দিন পরে ফ্লাইট। লাউঞ্জে স্বল্পমূল্যে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে এরা। কিন্তু খাবারদাবারের খরচ নিজেদের। দূর থেকে রজতাভ দেখল কৌশিক উত্তেজিত হয়ে রুমাকে কিছু বলছে। বৌমা মাঝেমাঝে তাকাচ্ছে তার দিকে। রজতাভর একটা গুণ আছে। তার শ্রবণশক্তি প্রখর। সে খানিকটা শুনতে পেল তার বৌমা আর ছেলের কথোপকথন। বৌমা বলছে, ‘তোমার বাবা ইরেসপন্সিবলের মতো কার্ডটা না হারালে এটা হতো?’
—রুমা, জানোই তো আমার বাবার অসুখটা…
—অসুখ না ছাই। সব ইচ্ছে করে করা।
—এরকম বলবে না।
—টেল মি। কী বলব। তোমার আমার যা সেভিংস ছিল, আমরা এখানে লাগিয়ে দিয়েছি। আমাদের ক্রেডিট লিমিট শেষ হয়ে গেছে। এই দু’দিনের খাবারের খরচ কীভাবে হবে…

রজতাভ মুখ নীচু করে বসে রইল। সারাজীবন উপোস করে চললেও কখনও মুখ নীচু করেনি সে। বেয়াই-বেয়ানরা তাদের আত্মীয়স্বজনদের জন্য অনেক মার্কেটিং করেছে। রজতাভর ইচ্ছে ছিল লন্ডন থেকে সুনন্দাকে একটা গাউন কিনে দেয়। বেয়ানদের কাছে অবশ্য টাকা চায়নি রজতাভ। সবকিছু তার ভুলোমনের জন্য হল। আটচল্লিশ ঘণ্টা কীভাবে কাটবে এখন?
—বাবা চলো।
—কোথায়?
—পাশেই লাউঞ্জ। তোমরা কী খাবে বলবে। ছোটখাটো কিছু খেয়ে নাও। এখানে খাবাদাবারের আগুন দাম।
রাতে কিছুই খেল না রজতাভ। সানন্দাও। তাদের না খাওয়ার অভ্যাস আছে। তখন কৌশিক খুব ছোট। একবার রজতাভদের অফিসে খুব গণ্ডগোল হরতাল হলো। মাইনে আটকে গেল সবার। মাইনের অঙ্ক খুব বেশি কিছু ছিল না যে অনেক সঞ্চয় করা যাবে। তার ওপর সে মাসেই কৌশিকের স্কুলে সেশন ফি দেবার কথা। সেই বছর পরপর তিনদিন রজতাভ শুধুই জল আর চা খেয়ে কাটিয়েছিল। সানন্দাকেও বুঝতে দেয়নি। সকালে বেরিয়ে যেত অফিসে। রাতে এসে বলত অফিস-ক্যান্টিনে খেয়ে নিয়েছে।

দু’দিন কেটে যেতে যেন দু’বছর সময় লাগল। এর ভিতর রজতাভ কতো কিছু দেখল। বেয়ানরা চুপিচুপি শপিং করছে। চুপিচুপি তাদের নজর এড়িয়ে খেয়ে আসছে অন্য লাউঞ্জ থেকে। কৌশিক স্যান্ডউইচ এনেছিল দুইবার। সানন্দা একটুকরো খেল। কিন্তু সে খেল না। বলল, ‘খিদে নেই রে’। মিস্টার ঘোষ একবার বললেন, ‘আপনারা তো কিছু খাচ্ছেন না। চলুন। আমরা নিয়ে যাচ্ছি। পয়সার জন্য ভাববেন না। ওসব হিসেব দেশে ফিরে হবে।’ রজতাভ দেখল মিস্টার ঘোষের কথার ভিতরেও লণ্ডনের কিউআর কোড জ্বলজ্বল করছে। সানন্দা বলল, ‘না না, ও এরকম করে মাঝেমাঝে। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং।’
—গুড গুড। তাহলে বারণ করব না। ফিটনেস আগে।

শেষমেশ আবুধাবি হয়ে আবার অভাবের দেশে ফিরে এল রজতাভ। কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে লাগেজ হাতে নিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল রজতাভ আর সানন্দা। ঘোষেদের সঙ্গে শুভেচ্ছা, বিদায়পর্ব সারা হয়ে গিয়েছে আগেই। বৌমা বলল, ‘বাবা, আমাদের সঙ্গে চলুন। আমরা গাড়ি বলে রেখেছি।’ রজতাভ হেসে বলল, ‘না বৌমা। আমরা উবেরে চলে যাব।’
—কিন্তু…
রজতাভ হেসে বলল, ‘আছে। আমার দেশে তো ফোরেক্স কার্ড লাগে না। যা আছে হয়ে যাবে।’

ওদেরকে বিদায় জানিয়ে লাগেজ নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল দু’জন। কৌশিক আর রুমা নিউটাউনে নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকে। বিয়ের পর থেকেই রজতাভদের সঙ্গে তারা থাকেনি। এতে অবশ্য ওদের ওপর কোনও অভিযোগ নেই তাদের। আজকাল ছেলে-বৌমা আলাদা থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এই বিদেশ সফরের আগে এনিয়ে কোনও জটিলতা তৈরি হয়নি কখনও। অবশ্য কৌশিক আর রুমা, দু’জনেরই ইচ্ছে বিদেশে সেটল্ করবে। রজতাভরা থাকে বেহালা। নিজের অভাগা শহরকে আবার নতুন চোখে দেখছিল সে। শহরের মানুষগুলোর কতো অভাব, তবু মানুষগুলোর গায়ে কোনও কিউআর কোড নেই। অভাব মানুষকে দর্শন শেখায়। জীবনের দর্শন। অনেকটা পঞ্জুড়ির মতো। এই লন্ডন সফর শেষে সেই পঞ্জুড়ির আধারেই জীবনের পাশাখেলায় রজতাভ পেল দুই জুড়ি আর এক পোয়া। এও কি একটা মেমেন্টো নয়?