চন্দ্রাণী বসু
আহমেদাবাদের প্রথম সূর্যের কিরণ এসে পড়ল ঘুমন্ত বাদশাহের চোখের উপর। চোখ খুলেই তিনি অভ্যাসবশত আল্লার দোয়া নিলেন। কয়েকদিন ধরেই অনুভব করছিলেন, আল্লার পয়গম আসার সময় হয়ে গেছে। দীর্ঘ অসুস্থতায় শয্যা থেকে উঠতে বেশ যন্ত্রণা হয় সারা শরীর জুড়ে। মনের যন্ত্রণা হয়তো আরও বেশি। শয্যা ছেড়ে উঠে বসতেই ছুটে এল খানসামা। জিনাত-উন-নিসার নির্দেশে খানসামা আর কাঞ্জরীরা তটস্থ থাকে এখন বাদশাহের সেবায়। এও যেন এক নজরবন্দি, নিরুপায় দশা মনে হয়। হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে ধীরে ধীরে নিজেই উঠে এলেন মহল সংলগ্ন ঝরোখাতে। বসন্তের ভোরের হাওয়ায় এক অনাবিল প্রশান্তি এনে দিল।
যদিও এ প্রশান্তির স্থায়িত্ব মুহূর্তমাত্র। ধ্বংসের কোলাহল তার চারপাশে ঘিরে রয়েছে। মারাঠা শক্তির দুর্দমনীয় মনোভাব তাঁকে অস্থির করে তোলে সবসময়। কিন্তু নিরুপায় তিনি। অশীতিপর মানুষের জীবনে অশান্তির কালো ছায়া থাকে, কিন্তু সমাধান থাকে না। অস্থির মননে চিন্তার পরিব্যাপ্তি তাঁকে ক্রমশ দুর্বিষহ জালে জড়িয়ে নেয়। কী বলে মনে রাখবে তাঁকে ইতিহাস? পিতৃহন্তাকারী? ভ্রাতৃহন্তাকারী? পুত্রহন্তাকারী? হিন্দু-বিদ্বেষী? এত গুনাহ্ কি আল্লা ক্ষমা করবেন? নিত্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এক মানুষ তিনি। সংগীত, নৃত্য, কাব্যকে তিনি স্থান দেননি কোথাও। সুখের অনুভূতিগুলিকে হত্যা করেছেন নিজ হাতে। সমগ্র সাম্রাজ্যে তাঁর ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি কি আদৌ এই সুলতানাতের উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য?
নিজেই দু-হাত দিয়ে দুই কান চেপে ধরলেন। এত প্রশ্নের ঝঙ্কারে চোখ বুজে এল। মাথা এলিয়ে দিলেন মখমলি কুরশির গায়ে। আবার দখিন বাতাসের ছোঁয়া লাগল মুখে।
আহ! শব্দটি বেরিয়ে এল মুখ থেকে। কত বসন্ত আগে যেন এই দখিনা বাতাসকে শেষ ভালো লেগেছিল, স্মৃতির ঘেরাটোপে কত কথারা নীরবে দাফন হয়ে আছে তাঁর বুকের মধ্যে। কোনওদিন কি কেউ জানতে পারবে— আলমগীরও প্রেমিক ছিল! আলমগীরের জীবনেও সঙ্গীত ছিল! কাব্য ছিল!… কী আশ্চর্য! সব নিঃশেষ করে নিয়ে চলে গেল সে।
১৬৫৩ সাল। জয়নাবাদে খান-এ-জামাম মীর খলিফের আহুখানা। তাপ্তি নদীর শীতল হাওয়া বইছে আহুখানার চারপাশে, বসন্তের কোকিল ডেকে চলেছে একটানা, অথচ সেখানে খালাজান মালিকা বানুর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন শাহাজাদা আলমগীর। ধীরে ধীরে চোখ মেলে শাহাজাদা দেখলেন চারপাশে কৌতূহলী পুরনারীদের অন্তত দশ জোড়া চোখ তাঁর দিকে নিবদ্ধ। নিজের মুখ-চোখ এবং শরীরের কিছু অংশও জলে ভেজা। অতি উদ্বিগ্ন খালাজান জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে তোমার শাহাজাদা? মূর্ছা গিয়েছিলে তুমি। চারঘন্টা ধরে আমরা তোমার জ্ঞান ফেরাতে অক্ষম ছিলাম। আমি কী জবাব দেব তোমার পিতা শাহেনশাহ শাহজাহানকে?’
ঔরঙ্গজেব উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জিহ্বায় কী ভীষণ আড়ষ্টতা! তিনি যেন জিহ্বা নাড়াতেই অক্ষম। এদিকে খালাজানকে উশখো-খুশকো চুলে, অসম্বৃত বেশে, পাদুকাবিহীন ধুলোমাখা অবস্থায় দেখে তিনি অনুভব করতে পারলেন খালাজান তাঁর শরীর নিয়ে অতীব চিন্তিত এবং তা নিয়ে বিলাপ করেই চলেছেন।
কিন্তু কী করে শাহাজাদা বোঝাবেন মনের কথা খালাজানকে। এ যে কোনও শরীরের অসুখ নয়! এ যে মনের অসুখ! এ যে মুগ্ধতার চরম আবেশ। দু’টি ঠোঁট নাড়িয়ে বলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু খালাজানের তা বোধগম্য হল না।
শাহজাদা আলমগীরকে নিয়ে যাওয়া হল বিশ্রাম কক্ষে। তাঁকে সুস্থ করে তোলবার জন্য নিজেই সমস্ত ভার নিলেন মালিকা বানু বেগম।
মধ্যরাতে আলমগীর কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন। চারিদিক মৌন। ঝাড়ের নিভু আলোয় এক মোহময় পরিবেশ চারদিকে। কিন্তু যে নারীর আঁখি তিনি দেখছেন তা যেন জগতের সবচেয়ে মোহময়। সেই ঘোর থেকে তিনি কিছুতেই বিস্মৃত হতে পারছেন না। ক্ষীণকণ্ঠে ডাকলেন, ‘খালাজান…’
মালিকা বানু বেগম খুশিতে চঞ্চল হয়ে উঠলেন। শাহাজাদার কণ্ঠে আওয়াজ ফিরেছে। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ধীরে ধীরে আলমগীরের কেশরাশির মধ্যে অঙ্গুলিচালনা করে জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে তোমার শাহাজাদা? পূর্বে এমন কখনও ঘটেছিল বুঝি?’
—‘এ অসুখ তো শরীরের নয়, মনের।’
ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর এল।
—‘মনের? তোমার মনের কষ্ট কোথায় যদি জানতে পারি নিজের প্রাণ দিয়েও সারাবার চেষ্টা করব, আলমগীর।’
—‘আমার অসুখের কথা যদি তোমায় বলি, তাহলে কি তুমি সত্যিই আমার কষ্ট দূর করতে পারবে?’
—‘পারব। তুমি বলেই দেখো। আমি পূর্বেই তোমায় বলেছি তোমার যন্ত্রণা দূর করতে আমি আমার জীবন বাজি রাখতেও দ্বিধা করব না।’
—‘আজ সকালে আমি একজনকে দেখেছি। খানজামানের হারেমের মেয়ে। বাগিচার নিকটেই সে গান গাইছিল। হঠাৎই সে সুর আমার কানে প্রবেশ করে।’
—‘জানি। শাহাজাদা সঙ্গীত পছন্দ করেন না বলে হারেমের সকল বাঁদীদের নির্দেশ দেওয়া ছিল, যে আজ যেন কেউ গানের কলি না ধরে। নিষেধ সে শোনেনি গান গেয়ে ফেলেছে। তার নাম হীরাবাঈ।’
—‘হ্যাঁ। আমি সেই গানের কলি অনুসরণ করি। আমার আগ্রহ জাগে কার কণ্ঠে এ মদিরা মাখানো সুরের প্রস্রবণ। আম্রকুঞ্জে সেই
হুর-পরী সদৃশ তরুণীকে খুঁজে পাই। আমার উপস্থিতি তাঁর নজরে আসেনি। তিনি আপন মনে নিজের সঙ্গীত জগতে আবিষ্ট ছিলেন। তাঁর মুখমণ্ডলের লাবণ্য, সরলতা, শরীরের লালিমা, বেতস লতার মত বিভঙ্গে আমি মুগ্ধ। তাঁর সুরমা আঁকা দৃষ্টির সৌন্দর্যের আঘাতেই আমি মূর্ছা গিয়েছিলাম। তাঁকে ছাড়া আমি জীবিত থাকতে অপারগ খালাজান, তাঁকেই আমার চাই।’
—‘এ কী কথা শাহাজাদা! এ কী সাংঘাতিক দাবি তোমার!’
আতঙ্কে মুহূর্তে মূর্ছা গেলেন মালিকাবানু। সে অবশ্য মুহূর্তমাত্র। পুনরায় উঠে বসলেন। কিন্তু আতঙ্ক তাঁর সমস্ত শরীরে। নীরব পাথরের মত স্থির তিনি।
—‘ও তাহলে তুমিও অনর্থক এতক্ষণ আমার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার ভান করলে? তুমি যদি কোনও উত্তরই না দাও তাহলে আর আমাকে সুস্থ করবে কী করে?’
আলমগীরের কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ল।
—‘না শাহাজাদা, আমি নীরব আতঙ্কে। হীরাবাঈ খানজামানের হারেমের বাঁদী। আমি নিজের প্রাণ দেওয়ার কথা তোমায় বলেছিলাম। কিন্তু তুমি তো খানজামানকে চেনো। তিনি জঘন্য রক্তপিপাসু মানুষ। অত্যন্ত নিষ্ঠুর। বাদশাহকেই যিনি মানেন না তিনি কি তোমাকে মানবেন? আমি যদি তাঁকে তোমার মনের কথা জানাই, তাহলে প্রথমেই তিনি হীরাবাঈকে কাতিল করবেন। তারপর হয়তো আমাকেও। তবুও আমি তোমার সুখের জন্য এই অনুরোধ নিয়ে তাঁর কাছে যেতে পারি, কিন্তু ওই অসহায় বাঁদির অকারণে প্রাণ যাবে। তোমারও কাজ হবে উদ্ধার হবে না।’
কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন শাহাজাদা আলমগীর। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘ওই নারী ব্যতীত আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। আমায় অন্য পথ অবলম্বন করতেই হবে।’
অর্ধরজনী পার হয়ে গিয়েছিল। বাকি সময়টুকু তিনি একটি অবয়বই দেখে গেলেন— সেই সারল্যে ভরা অথচ মোহময়ী রূপ। ভোরের অপেক্ষায় রইলেন শাহাজাদা আলমগীর। আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিলেন বুরহানপুরে নিজ মহলে।
তাঁর অবর্তমানে সেখানে দক্ষিণের শাসনের দায়িত্ব ছিল মুর্শিদ কুলি খাঁ-এর। আলমগীরের অত্যন্ত বিশ্বস্ত দেওয়ান তিনি। দ্রুত ডেকে পাঠালেন তাঁকে। খবর শোনা মাত্রই হাজির হলেন তিনি।
—‘আদেশ করুন, শাহাজাদা। এত দ্রুত ফরমান কিসের জন্য? কোনও বিপদ?’
—‘হ্যাঁ, বিপদই বলতে পারেন, আবার তা নয়ও।’
—‘সবিস্তারে বর্ণনা করুন শাহাজাদা। আমি উদ্বিগ্ন।’
—‘কাশ্মীরি হিন্দু নারী হীরাবাঈ বর্তমানে খানজামানের হারেমে আছে। তার লাবণ্যে তার লালিত্যে তাঁর দেহভঙ্গিমাতে আমি মুগ্ধ। আমি তাকে আমার করে চাই। তাঁকে ছাড়া এ জীবন মূল্যহীন।’
—‘আদেশ করুন, শাহাজাদা। আমি খানজামানকে যথাস্থানে পাঠিয়ে দিতে পারি। তারপর কেউ যদি আমার মাথাটা কেটেও নেয় তাহলেও আপনার উদ্দেশ্য সফল হবে। আমি আপনার জন্য জীবন দিতে পারি।’
—‘দেওয়ানজী, আমি জানি আপনি একাজ করতেই পারেন। আপনার আনুগত্যে কোনও ছিদ্র নেই। কিন্তু এ কাজে আমার খালাজান তাঁর শোহরকে হারাবেন। তা আমি কখনই চাই না।’
—‘তাহলে কী উপায় হবে? খানজামান নিশ্চয় রাজি হবেন না।’
—‘পথ কঠিন বলেই তো আপনার সঙ্গে আলোচনা। আপনার বিবেচনায় সম্পূর্ণ আস্থা আছে আমার। অন্য পথ অবলম্বন করুন। আপনি জয়নাবাদে গমন করুন।’
শাহাজাদা আলমগীরের আদেশ অমান্য করবেন এমন স্পর্ধা কার? পরদিনই মুর্শিদ খাঁ পৌঁছলেন জয়নাবাদ। শাহাজাদা আলমগীরের প্রস্তাব পৌঁছে দিলেন খানজামানের নিকট।
এ হেন প্রস্তাবে খানজামাম সাহেব কিছু সময় চাইলেন এবং শাহাজাদাকে সেলাম জানিয়ে বললেন, ‘এই প্রস্তাবের উত্তর স্বয়ং মালিকাবানু শাহাজাদাকে পৌঁছে দেবেন।’
এই ঘটনার কিয়ৎক্ষণ পরেই মালিকাবানুর অন্দরমহলে পৌঁছলেন খানজামাম। মালিকাবানু কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘এই অসময়ে তাঁর হারেমে প্রবেশ কেন?’
—‘শাহাজাদা আলমগীর যে প্রস্তাব তোমাকে দিয়েছিল, তা আমায় জানাওনি কেন, বেগম সাহেবা?’
নীরব রইলেন মালিকা বানু। আবার বলতে শুরু করলেন খানজামাম, ‘আমার এ প্রস্তাবে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু দিলরাস বানু অন্তঃসত্ত্বা। তাই সে না হোক, শাহাজাদের সুন্দরী উপপত্নী ছত্ত্বরবাঈকে হীরাবাঈ-এর বদলে আমার চাই।’
—‘এ কী করে সম্ভব। আমি শাহাজাদার খালাজান। আমি এ প্রস্তাব কেমন করে তাঁকে পৌঁছব!’
—‘বেশ! তাহলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।’
নিরুপায় মালিকাবানু সংবাদ নিয়ে পৌঁছলেন বুরহানপুর। কিন্তু এ সংবাদে উল্লসিত হয়ে উঠলেন শাহাজাদা। কোনও সময় নষ্ট না করে ছত্ত্বরবাঈকে পাঠিয়ে দিলেন জয়নাবাদে। কাছে পেলেন তাঁর হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা হীরাবাঈকে।
কঠিন হৃদয় আলমগীর হীরাবাঈ-এর সম্মুখে এক আদন্ত প্রেমিক। যে সুরা, নৃত্য, গীত তাঁর জীবন থেকে দূরে ছিল তাই তিনি প্রশ্রয় দিলেন হীরাবাঈ-এর খুশির জন্য। সুরাপানের অনুমতি দিলেন কেবলমাত্র হীরাবাঈকে।
সুরাপানরত হীরাবাঈ-এর কোলে মাথা রেখে জানতে চাইলেন, ‘কেন তুমি সুরায় আসক্ত প্রিয়ে? ছেড়ে দাও এই সর্বনেশে নেশা। কিসের দুঃখ তোমার?’
হীরাবাঈ হেসে উঠে বললেন, ‘সকলেরই কোনও না কোনও নেশা আছে, শাহাজাদা। পেয়ালা ভরে শরাব না পেলে বাঁচব কী করে?’
—‘আমি কি তবে মৃত? আমার তো কোনও নেশা নেই। অবশ্য আমার নেশা তুমি। শুধুই তুমি।’
—‘না, শাহাজাদা আলমগীর, এ আপনার ক্ষণিকের মোহ। দিল্লির তখত-এ বসবার স্বপ্নই আপনার সবচেয়ে বড় নেশা।’
—‘ভুল বললে, সিংহাসনের ওপরে আমার কোনও লোভ নেই। তবে দারা শুকোকে আমি সিংহাসনে বসতে দেব না। সে কাফের।’
—‘এ সর্বৈব মিথ্যে, কাউকেই আপনি সিংহাসনে বসতে দিতে চান না। আপনি ক্ষমতা চান।’
আশ্চর্য হয়ে যান, যুবরাজ আলমগীর। কীভাবে মনের কথা বলে দেয় হীরাবাঈ। এভাবে আর কেউ তাঁকে কখনও বুঝে উঠতে পারেনি, কোনওদিনও না।
মৃদুস্বরে আবেগ মিশিয়ে আলমগীর তাঁকে বললেন, ‘অন্তত আমাকে তুমি পড়তে পারো। তোমার মন আয়নার মতো স্বচ্ছ।’
কিন্তু হীরাবাঈয়ের হাসিতেও বিষণ্ণতার আভাস।
শাহজাদা ব্যাকুল হলেন, ‘বলো, বলো তুমি কী চাও, হীরাবাঈ।’
—‘আপনি তো না চাইতেই আমাকে সব কিছু দিয়েছেন। আর আমি কী চাইব?’
—‘তুমি কি সত্যিই আমায় ভালোবাসো?’
—‘আপনি আমার জীবনের চেয়েও প্রিয়। কিন্তু আপনি কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসেন? আপনার কত বেগম, সন্তান, ভগিনী। তাঁদের মাঝে আমার স্থান কতটুকু?’
—‘ভালোবাসি, হীরা। আমি তোমাকেই ভালোবাসি।’
—‘প্রমাণ দিতে পারবেন?’
—‘বলো কী প্রমাণ চাও?’
—‘এত সহজভাবে বলবেন না, শাহাজাদা। কথা দেওয়ার পূর্বে সময় নিন।’
—‘সময়ের কোনও প্রয়োজন নেই। আমায় ভাবতে হবে না। তোমাকে দিতে পারি না এমন কিছুই নেই আমার।’
—‘বেশ। তবে এই পানপাত্রের সুরা আমার এঁটো। তাকে আপনি পান করুন।’
মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেলেন শাহাজাদা আলমগীর। নাহ্! তিনি ভালোবাসায় হার স্বীকার কিছুতেই করবেন না। তাঁর প্রেমে সামান্য অবিশ্বাস তিনি হতে দেবেন না। হাসিমুখে তিনি হীরার হাত থেকে পেয়ালা নিয়ে পান করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু পেয়ালা সেই মুহূর্তে ছিনিয়ে নিলেন হীরাবাঈ।
—‘না শাহাজাদা, এ আমার প্রতি আপনার ভালোবাসার পরীক্ষা ছিল শুধুমাত্র। আপনি নিজের প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করুন, অপবিত্র হন, এ কখনও হীরাবাঈ হতে দেবে না। আপনি নিশ্চিত থাকুন।’
—‘তাহলে তুমি এ অপবিত্র জিনিস কেন পান করো?’
—‘আমার যন্ত্রণা ভোলার জন্য গরলের প্রয়োজন। অমৃত কোথায় পাব শাহাজাদা?’
—‘কীসের দুঃখ তোমার? আমি তোমায় খাশ বেগম করে মহলে নিয়ে যেতে চাই।’
—‘আমি তো চাই না।’
—‘সে কী হীরা! বেগম হওয়ার জন্য তামাম দুনিয়ার নারীরা আমার পদানত হয় আর তুমি কেন চাও না? আমি দিল্লির তখত্-এর আগামী বাদশা!’
—‘না শাহজাদা, আমার সে ইচ্ছা নেই। আমি আপনাকে ভালোবেসেই সুখী। বেগম হয়ে আমি আপনাকে কোনও অন্যায় করতে দেব না।’
—‘তার অর্থ?’
—‘ক্ষমা করবেন, শাহজাদা। হত্যা, ষড়যন্ত্র করে ন্যায় নীতি বিসর্জন দিয়ে দিল্লির মসনদে আপনাকে আমি দেখতে চাই না। আপনি কাউকে বঞ্চিত করে বাদশাহ হতে পারবেন না। আর তাছাড়া…’
—‘তাছাড়া?’
—‘আমাদের সম্পর্ক বাদশাহ শাহজাহান, আপনার পিতা, মেনে নেবেন না।’
—‘কী বলছ তুমি? এ সংবাদ তুমি কী করে জানলে?’
—‘আপনাকে ভালোবাসি, শাহাজাদা। আপনার মনের খবর যেমন রাখি তেমনই বহির্জগতেরও।’
অবাক হয়ে যায় শাহাজাদা আলমগীর। এ জেনানা কি যাদু জানে? এভাবে তাকে ভিতরে ও বাহিরে ক্রমশ ঘিরে ফেলছে নিজের যাদুগুণে। না-বলা সমস্ত শব্দেরা ধরা দেয় হীরার আঁচলে কী সহজেই অথচ দাবিহীন এক শান্তির আশ্রয় ছায়া দিয়ে চলে প্রতি মুহূর্তে। তিনি সাম্রাজ্য, ষড়যন্ত্র, কূটনীতি সব কিছু থেকে দূরে সরে গিয়ে এক প্রশান্তির হাতছানি পান এই হীরার কোলে। এখানে এলেই যেন শুনতে পান মসজিদে আল্লার দোয়া। আর কোথাও এত শান্তি নেই। কিন্তু যে সংবাদ হীরা শুনেছে তাও তো ভীষণ সত্যি। আসলে তাঁর বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আগ্রায় পিতার কাছে দারাশুকো নালিশ জানিয়েছে শাহাজাদা আলমগীর মিথ্যাচারী ধার্মিক ও ভণ্ড বলে। সে আকবরের আইন অমান্য করে অন্যের হারেমে প্রবেশ করেছে। এখন রাজ্যপাঠ ছেড়ে নৃত্য, সুরে মগ্ন… মিথ্যা অপবাদে এও বলা হয়েছে শাহাজাদা সুরাপানেও আসক্ত।
কিন্তু হায় মন! কীভাবে আলমগীর এই ভালোবাসা অগ্রাহ্য করবে? অপবাদ যেন তাঁকে আজকাল স্পর্শও করে না। হীরার আঁচলে যে শান্তি তিনি খুঁজে পেয়েছেন সে যে অমৃত সমান।
—‘জানো হীরা, আজকাল সকলে বলছে শাহাজাদা আলমগীর বদলে গেছে।’
—‘না, জাঁহাপনা, আপনি এতটুকু বদলাননি। এসব মানুষের অপবাদ।’
—‘হয়তো তাই। সত্যি হীরাবাঈ বিশ্বাস করো, মাঝে মাঝে তোমার মত আমিও স্বপ্ন দেখি, সবাই সুখে আছে। কোথাও বিদ্বেষ কিংবা হানাহানি নেই… তুমি আমি অনেক দূরে সামান্য ফকিরের মতো দিন কাটাচ্ছি।’
—‘আমি কিন্তু ফকির হওয়ার জন্য আপনাকে সিংহাসনের যুদ্ধ থেকে দূরে নিয়ে যেতে চাইনি। নিজের স্বার্থের কথাই ভেবেছি। আপনার প্রাণ সংশয় আছে যুদ্ধে। সে যে আমার হারাবার ভয়। ভীষণ ভয়, শাহাজাদা।’
—‘তোমার মত এভাবে কেউ কখনও ভাবেনি হীরা। আমার বেগমেরা নয়, পিতা, ভগীনিরাও নয়। কী হল হীরা তোমার চোখে জল কেন? কেন এত ক্লান্তি, বিষণ্ণতা এ পবিত্র মুখে।’
—‘শাহাজাদা, আমার তবিয়ৎ কয়েকদিন যাবৎ ভালো নেই। বড় দুর্বলতা ঘিরে আছে।’
—‘সে কী। এত সুরাপানের আসক্তি তোমার শরীরকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আমি এখুনি তাবিবকে নির্দেশ দিচ্ছি। তিনি তোমায় দ্রুত সুস্থ করে তুলবেন।’
—‘আপনি আমার কাছে থাকুন, শাহাজাদা। হাকিম, তাবিবের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কোনও রাজরোগ হয়তো আমায় ঘিরে ধরেছে। দিন বোধহয় ফুরিয়ে এল।’
—‘না! না! এ কথা বলো না হীরা। তুমি ছাড়া আমি এক দিশাহীন পথিক। আমার চারপাশে অন্ধকার। আমি ষড়যন্ত্রকারী, হত্যাকারী, নরকের কীট।’
চমকে উঠলেন বৃদ্ধ আলমগীর। কতক্ষণ এভাবে বসে আছেন ঝরোখাতে? হীরাবাঈ-এর কথা আজ তাঁর এভাবে মনে পড়ছে কেন? তবে কি তাঁর কাছে যাওয়ার সময় হয়ে এল? তিনি ধরে রাখতে পারেননি হীরাবাঈকে, অকালে চলে গিয়েছিল তাঁর কাছ থেকে বহুদূরে, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল সাধক, প্রেমিক আলমগীরকে, যে আলমগীরকে সে চেয়েছিল। তখন শাহজাদা হয়েও তিনি দরিদ্রের মতো নিজের দিন গুজরান করতেন। কোরান নকল করে, টুপি সেলাই করে যা আয় করতেন, সেটা দিয়েই নিজের খরচ চালাতেন। মাটির মানুষ সেই আলমগীর মাটিতেই মিশে গিয়েছিলেন হীরাবাঈ এর সঙ্গে।
আজ তিনি ভারতের মসনদের শাহনশাহ ঔরঙ্গজেব।
নিজেই বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমার জীবন থেকে হীরাবাঈকে কেড়ে নিয়েছিলেন কোনও মহৎ উদ্দেশ্যেই। সে থাকলে আমি কোনও অপরাধ, কোনও অন্যায়, কোনও অবিচার করতে পারতাম না। এমনকী সেদিন সিংহাসনের দাবিও আমি ছাড়তে রাজি হয়েছিলাম। এ সবই ছিল সেই মহীয়সী নারীর ইচ্ছা। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা যে তা ছিল না, আজ বুঝতে পারছি। সেইজন্যই তাঁকে হয়তো অকালে চলে যেতে হল। আমার জীবন থেকে চিরকালের মত নিয়ে গেল, সুর, কাব্য, সুরা।
দিন ফুরিয়েছে। যত পাপ ছিল তার বিচার আল্লার হাতে। সময় হয়েছে হীরার কাছে ফেরার।
পুরাতন বন্ধু আকিল খাঁ-র বলা সেই পঙ্ক্তিগুলি আওড়াতে লাগলেন বৃদ্ধ শাহেনশাহ—
‘প্রেমকে কত সহজ মনে হয়েছিল একদিন,
কিন্তু কী কঠিন আজ সে,
কী কঠিন এই বিচ্ছেদ বেদনা,
কিন্তু কী মধুর শান্তি তাকে দিয়েছে।’
বেলা বাড়ছে। তাঁকে মহলের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত খানসামা। তাপও বাড়ছে। এতটাই সে তাপ শরীর ভেদ করে মনের সব অনুভূতিগুলোকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। জ্বালা করছে, পুড়ে যাওয়ার জ্বালা। অসহ্য সে যন্ত্রণা। চোখ দিয়ে বের হয়ে নোনাজল গাল বেয়ে নীচের দিকে ধাবমান। এখনও বসে থাকলে শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, সময় এল ফিরে যাওয়ার। উঠে দাঁড়ালেন তিনি নিজেই। তারপর অশীতিপর বৃদ্ধ আলমগীর ধীরে ধীরে হেঁটে গেলেন মহলের ভিতরে যাওয়ার দরজার দিকে।