তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
২০.
সচকিতা
এসেছি প্রিয়তম, ক্ষমো মোরে ক্ষমো
রবীন্দ্রসদনের প্রবেশপথের ঠিক আগেই বিশাল একটা হোর্ডিং লাগিয়েছে সচকিতা৷
রবীন্দ্রনাথের ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের নবতম রূপায়ণ৷ তিনটি প্রধান নৃত্যধারার সম্মিলন৷ বজ্রসেনের নৃত্য, ভারতনাট্যম ও কথাকলি৷ উত্তীয়র নৃত্য কথকের আদর্শে, শ্যামার নৃত্য প্রচলিত মণিপুরী ভঙ্গিতে৷ বজ্রসেনের গানে তমোনাশ গুপ্ত, শ্যামার গানে সচকিতা রায়চৌধুরি ও উত্তীয়র গানে বিচিত্র লাহা৷ সেই সঙ্গে নৃত্যশিল্পীদের নাম৷ তার নীচে দুটি বিশাল ছবি, একটি তমোনাশ গুপ্তর, অন্যটি সচকিতা রায়চৌধুরির৷ তার নীচে ছোটো করে বিচিত্র লাহার৷
সচকিতার বহুদিন ধরে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার দিন এই নৃত্যনাট্যের রূপায়ণে৷ তমোনাশ গুপ্তর পাশে এতোদিন সুরঞ্জনা বসুর ছবি থাকত হোর্ডিংয়ে৷ দৃশ্যটা সচকিতার বুকের ভিতর ঈর্ষার পিন খোঁচা দিত বরাবর৷ এবার সেই ছবির ইতি ঘটিয়ে তমোনাশের পাশে সচকিতার ছবি৷ নিশ্চয় কলকাতার রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রিয় শ্রোতাদের ভ্রূযুগলে পড়বে ঈষৎ কুঞ্চন৷ কে এই সচকিতা, তা নিয়ে আলোচনা চলবে কিছু কিছু মহলে৷
সচকিতা জানে, এই অনুষ্ঠানের সাফল্যের উপর নির্ভর করছে তার খ্যাতিও৷
সেই কারণে গত কয়েকদিন তার প্রবল পরিশ্রম গিয়েছে নৃত্যনাট্য ঠিকঠাক প্রস্তুত করতে৷ যেমন, নাচের দলকে তালিম দিতে হয়েছে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে, সেই সঙ্গে তৈরি করেছে নিজের গান, আবার তমোনাশ গুপ্তর ফ্ল্যাটে গিয়েছে তাঁর গলায় তুলে দিতে বজ্রসেনের গান৷
তমোনাশ গুপ্তর ফ্ল্যাটে যাওয়ার আকর্ষণই ছিল তার যাবতীয় উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু৷ এমন একজন দীর্ঘদেহী সুদর্শন মানুষের সামনে বসে থাকা, তার সঙ্গে গানের মহলা দেওয়া— প্রতিটি মুহূর্ত ছিল তার উৎসাহের মূল আকর্ষণ৷
সেদিন রবীন্দ্রসদনের প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ৷ সচকিতার গানের স্কুলের খ্যাতি টেনে এনেছে বহু দর্শক৷ রত্নদীপদার হাতযশও কম নয়৷
গায়কদের আসনে তখন তমোনাশের পাশেই বসে সচকিতা, সহসা অনুভব করল তমোনাশের বাঁ-হাতের মুঠোয় তার ডান হাত৷ কী আশ্চর্য ভীষণ গরম তমোনাশের হাত৷ তমোনাশদা কি এই মুহূর্তগুলো উপভোগ করছে?
গ্রিনরুমে তখন নানাবয়সি বহু নৃত্যশিল্পী সাজগোজ করে প্রস্তুত৷ তৃতীয় বেলের পর পর্দা উঠতে সচকিতার বুকের ভিতর মৃদু কাঁপন৷ তার সহকারী চন্দ্রিমা রায় নৃত্যশিল্পীদের উদ্দেশে শেষ মুহূর্তের নির্দেশনায় ব্যস্ত৷ প্রথম দৃশ্যে বজ্রসেন ও তার বন্ধু মঞ্চে অবতীর্ণ, আর মিশ্র (বাউল) রাগে বন্ধুর কণ্ঠে গাইছে এক তরুণ শিল্পী রাহুল সান্যাল :
তুমি ইন্দ্রমণির হার
এনেছ সুবর্ণদ্বীপ থেকে—
রাজমহিষীর কানে যে তার খবর দিয়েছে কে৷
তার নৃত্য সমাপন হলে শুরু মঞ্চে বজ্রসেনরূপী মিমো পালের নৃত্য, আর মঞ্চের এ কোণে উপবিষ্ট তমোনাশের কণ্ঠে গান:
না না না বন্ধু,
আমি অনেক করেছি বেচাকেনা
অনেক হয়েছে লেনাদেনা—
না না না,
দম বন্ধ করে তমোনাশের গান শুনছিল সচকিতা৷ প্রথম গানেই বেজে উঠল তার মন্দ্র কণ্ঠস্বর৷ স্তব্ধ হয়ে শুনছে দর্শক-শ্রোতারা৷ তমোনাশের উপর আজ তার বাজি৷ তার গান ভালোমন্দ হওয়ার উপর নির্ভর করছে সচকিতার জীবনের অনেক কিছু৷
রাজবাড়িতে সেই ইন্দ্রমণির হার বিক্রি করে বন্ধু বাঁচাতে চাইছে বজ্রসেনকে৷ কিন্তু নগরকোটাল খবর পেয়ে লাফিয়ে এসেছে, বজ্রসেনের পেটিকায় কী আছে তা জানতে চায়৷ বজ্রসেন বলছে:
এই পেটিকা আমার বুকের পাঁজর যে রে—
সাবধান সাবধান তুমি ছুঁয়ো না৷ ছুঁয়ো না এরে৷
বজ্রসেন পালিয়ে গেল কোটালের নজর এড়িয়ে৷ কোটালও বলছে, ‘ভালো ভালো তুমি দেখব পালাও কোথা/ মশানে তোমার শূল হয়েছে পোঁতা—’
মঞ্চের নৃত্যশৈলী দেখছে দর্শকরা৷ শুনছে গায়ক-গায়িকার গান৷
পরের দৃশ্যে শ্যামার ঘরে বসে গান গাইছে সখীরা, তখনই প্রবেশ উত্তীয়ের৷ তার ইমন কল্যাণ রাগে গান:
‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী/ গহন স্বপন সঞ্চারিণী’
শ্যামার প্রেমে পাগল এক তরুণ উত্তীয়৷ শ্যামার কোনও মোহ নেই তার প্রতি৷ সখীরা তাকে উদ্বুব্ধ করছে মিশ্র ভৈরবী রাগে গান গেয়ে:
জীবনের পরম লগন কোরো না হেলা, হে গরবিনী।
কিন্তু শ্যামা খুঁজে ফিরছে তার যোগ্য কোনও প্রেমিক৷ মিশ্র খাম্বাজ রাগে গাইছে সচকিতা:
ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই/ যারে আমি আপনারে সঁপিতে চাই—
গানের সঙ্গে মঞ্চে তখন অভিনয় হচ্ছে৷ স্বপ্নে বিভোর শ্যামার রতি আকাঙ্ক্ষা৷ নৃত্যশিল্পীর নাচের ভঙ্গিমার সঙ্গে সচকিতার কণ্ঠে গান:
…এসো মম সার্থক স্বপ্ন৷ কর মম যৌবন সুন্দর৷
সেই মুহূর্তে কোটাল তাড়া করেছে বজ্রসেনকে৷ ‘ধর চোর ওই চোর, ওই চোর৷’
বজ্রসেন বলছে ‘নই আমি নই চোর, নই চোর নই চোর৷’
ঠিক এমনই মুহূর্তে শ্যামার নজর পড়ল বজ্রসেনের দিকে, অমনি মাথা ঘুরে গেল তার, সচকিতা ইমনকল্যাণ রাগে গাইল:
আহা মরি মরি, মহেন্দ্রনিন্দিতকান্তি উন্নতদর্শন / কারে বন্দি করে আনে/ চোরের মতন কঠিন শৃঙ্খলে৷ শীঘ্র যা লো সহচরী, যা লো যা লো––৷
শ্যামা তখন রূপবান যুবক বজ্রসেনের শরীরী সৌন্দর্যে কামার্ত৷ তুলনায় উত্তীয় তার কাছে বালকমাত্র৷ উত্তীয়র প্রেমে কোনওদিনই সাড়া দেয়নি সে৷
কোটাল তখন বজ্রসেনকে বেঁধে নিয়ে চলে গেল, শ্যামার কাছে সেই দৃশ্য হৃদয়বিদারক৷ হাহাকার করে উঠল সচকিতার কণ্ঠ :
রাজার প্রহরী ওরা অন্যায় অপবাদে
নিরীহের প্রাণ বধিবে বলে কারাগারে বাঁধে৷…
ঠিক তখন প্রবেশ উত্তীয়ের, সে ন্যায় অন্যায় জানে না, শুধু শ্যামাকেই জানে৷ শ্যামার সুখের জন্য সে প্রেমের চরম মূল্য দিতেও রাজি৷ শ্যামা তখন বজ্রসেনের প্রেমে এতই উন্মত্ত যে, উত্তীয়কে সে প্রেম দিতে পারবে, তার বিনিময়ে সে যদি বজ্রসেনের চুরির অপবাদ তুলে নেয় নিজের কাঁধে৷ তাতেই রাজি হয়ে উত্তীয় বলল প্রহরীকে: ‘প্রহরী, ওগো প্রহরী, লহো লহো লহো মোরে বাঁধি৷’
প্রহরী তখন উত্তীয়কে বেঁধে নিয়ে বলল, ‘তুমিই করেছ তবে চুরি৷’
উত্তীয়কে বেঁধে নিয়ে যাওয়র মুহূর্তে শ্যামার বোধোদয় হল, গাইল :
‘থাম রে, থাম রে তোরা, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে—
দোষী ও যে নয় নয়, মিথ্যা মিথ্যা সবই, / আমার ছলনা ও যে—’
কিন্তু ততক্ষণে উত্তীয়কে হত্যা করেছে প্রহরীরা৷
মঞ্চে হত্যার দৃশ্যে ঝনাৎ করে শব্দ হতেই শরীর শিরশির করে উঠল দর্শক-শ্রোতাদের৷ সচকিতা অনুভব করল তার হাত চেপে ধরেছে তমোনাশ৷ সে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু উপলব্ধি করছে নৃত্যনাট্যের ভয়ংকরতম দৃশ্যটি৷
পর্দা পড়ে গেল, কিছুক্ষণ ঘোর স্তব্ধতা৷ শুরু হল তৃতীয় দৃশ্য৷ বজ্রসেনের সঙ্গে শ্যামার বার্তা বিনিময়৷ শ্যামা গাইছে :
‘হে বিদেশী, এসো এসো৷ হে আমার প্রিয়,…’
বজ্রসেন তখন মুক্তির আনন্দে মাতোয়ারা, সেই উল্লাসে গাইছে :
‘এ কী আনন্দ, আহা—’
শ্যামার ভিতর তখন উথল দিচ্ছে অনুশোচনা :
‘বোলো না, বোলো না, বোলো না৷
আমি দয়াময়ী৷ মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা৷ বোলো না৷’
বজ্রসেন বলছে: জেনো প্রেম চিরঋণী আপনারে হরষে, / জেনো প্রিয়ে৷
তখন বজ্রসেন আনেন্দ উত্তাল৷ গাইছে :
‘প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে
বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও৷’
এই গানটির মুহূর্তে তমেনাশ বেশ জোরে চেপে ধরল সচকিতার হাত৷ প্রবল উল্লাস তার কণ্ঠে৷ পর্দা পড়ে যাওয়ার পরও হাত ছাড়ল না৷ প্রেক্ষাগৃহে তখন তুমুল হাততালি৷
চতুর্থ দৃশ্যে বদলে গেল আবহাওয়া৷ বজ্রসেন জানে না কীভাবে ঘুচল তার বন্দিদশা, পেয়েছে মুক্তি৷ শ্যামাকে নিয়ে তার মনে অসীম আনন্দ৷ দু’জনে একসঙ্গে গাইছে : ‘হৃদয়ে বসন্ত বনে যে মাধুরী বিকশিল / সেই প্রেম সেই মালিকার রূপ নিল, রূপ নিল /এই ফুলহারে প্রেয়সী তোমারে বরণ করি’ বজ্রসনের মনে তখন বিপুল কৌতূহল: ‘কহ কহো মোরে প্রিয়ে, / আমাক করেছ মুক্ত কী সম্পদ দিয়ে৷’
শ্যামা বলতে চাইছিল না, কিন্তু এই অপরাধ মনকে পীড়া দিচ্ছিল, তাই স্বীকার করল অকপটে৷ বলল : ‘তোমা লাগি যা করেছি/ কঠিন সে কাজ,/ আরো সুকঠিন আজ তোমারে সে কথা বলা৷
সেই কাহিনি শুনে বজ্রসেন স্তব্ধ: ‘কাঁদিতে হবে রে, রে পাপিষ্ঠা’
শ্যামা : ‘ক্ষমা করো নাথ, ক্ষমা করো’
বজ্রসেন : ‘এ জন্মের লাগি তোর পাপমূল্যে কেনা / মহপাপভাগী/ এ জীবন করিলি ধিক্কৃত’৷
শ্যামা : ‘তুমি যদি না করো দয়া / সবে না, সবে না সবে না’৷
বজ্রসেন শ্যামাকে আঘাত দিয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়ার পর আবার তাকেই পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে গায়, ‘এসো এসো প্রিয়ে/ মরণ লোক হতে নূতন প্রাণ নিয়ে৷’
বিষাদের কুহেলিকা সরিয়ে যেখানে নতুন প্রাণের মন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে নব্য যৌবন সুখের আশায় কাতর শ্যামার উচ্ছ্বাসকে সচকিতা অসাধারণভাবে ধরেছে তার কণ্ঠে৷
ঠিক তারপরেই যেন শ্যামা ফিরে আসে ছায়ার মতো, ‘এসেছি প্রিয়তম, ক্ষমো মোর ক্ষমো’— প্রেম, অনুতাপ, বেদনা, হাহাকার, ক্লান্তি সব একাকার৷
ঠিক সেই মুহূর্তে আবার চরমে ওঠে বজ্রসেনের প্রতিবাদ ও নীতিবোধের সংঘাত, ‘কেন এলি, কেন এলি’ গানে যেমন উথলে ওঠে নাটকীয়
ঘাত–প্রতিঘাত, তেমনই আকার নিতে থাকে নাচের মুদ্রা৷
একজনের কণ্ঠে বজ্রগম্ভীর স্বরের নাটকীয়তা, অন্যজনের কণ্ঠে বিষাদ৷
আবার বজ্রসেন যখন বলছে, ‘তবু ছাড়িবি না মোরে’, তখন শ্যামার অসহায় কণ্ঠ, ‘ছাড়িব না ছাড়িব না৷’ সচকিতার আকুতি ঝঁকিয়ে দিল শ্রোতা-দর্শকদের৷
বজ্রসেন : ‘ক্ষমিতে পারিলাম না যে / ক্ষমো হে মম দীনতা
পাপীজনশরণ প্রভু৷’
শেষ কলি গাওয়ার রেশ এমন নিবিড় হয়ে ছড়িয়ে গেল সারা প্রেক্ষাগৃহে যে, সবাই বহুক্ষণ নির্বাক৷ তার কিছুক্ষণ পর প্রবল হাততালি বুঝিয়ে দিল সফল হয়েছে সচকিতার এতদিনের পরিশ্রম, আর আকাঙ্ক্ষা৷ পর্দা পড়ে যেতে কতজন দর্শক যে এলেন গ্রিনরুমে, প্রকাশ করলেন তাঁদের উচ্ছ্বাস, প্রশংসা, ভালো-লাগা! রত্নদীপবাবু ছুটে এলেন, একবার সচকিতাকে, একবার তমোনাশকে বললেন আজকের সাফল্যের কথা৷
তমোনাশের মুখে তখন বিস্তৃত হাসি৷
সেদিন শোয়ের পর সচকিতা নিজেই তমোনাশকে পৌঁছে দিতে এল তার ফ্ল্যাটে৷
তমোনাশ বারবার বলল, সচকিতা, তুমি আমাকে নবজীবন দিলে৷
ঘরে ঢুকে সচকিতা প্রকাশ করল তার উচ্ছ্বাস, সজোরে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তমো, আমি এতদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম তোমার মতো একজন পুরুষের জন্য৷
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়