তখন বেড়াতে যাব

কাল্পনিক চিত্র

কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায়

সারাদিনের যত কথা রাতের খাবার টেবিলে। ঝুলনের কাল শেষ পরীক্ষা। সেটা খুব চাপের নয়। অন্যদিন যেমন রাতের খাওয়ার পরে সে আবার বই নিয়ে বসে, আজ তেমন দরকার নেই।

মাছের কাঁটা বেছে খাওয়া একটা কঠিন কাজ ঝুলনের কাছে। মা সেটাই দিয়েছে। ল্যাজার মাছ ঠিক মতো খাওয়ার জন্য যথেষ্ট মনোযোগ দিতে হয়, তাই তার খাবার থালা থেকে চোখ সরাচ্ছিল না। এইসময় বাবা বলল, ‘ঝুলনের পরীক্ষার পরে ভাবছি কয়েকদিনের জন্য ঘুরে আসব।’
‘কোথায়?’ মা জানতে চাইল।
‘পুরুলিয়া।’
ঝুলন বলল, ‘আমি যাব না।’


বাবা বলল, ‘তোমাকে নিয়ে কখনো পুরুলিয়া যাইনি। এখন ভালো সময়, সবে শীতটা চলে যাচ্ছে বসন্তের শুরুতে এইসময় ওখানকার লালমাটির পথ শিমূল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার রঙে যেন সেজে ওঠে। অযোধ্যা পাহাড়, জয়চণ্ডী পাহাড়, বাঘমুণ্ডী সব জায়গায় ঘুরতে যাব আমরা। দেখবে সব যেন ফুলে সাজানো। গেলে তোমার ভালো লাগবে।’
‘তোমাদের সঙ্গে গেলে ভালো লাগবে না। আর তোমরা গেলে তো দল বেঁধে যাবে। আমার ওই দল একদম ভালো লাগে না।’

‘আমাদের সঙ্গে গেলে ভালো লাগে না, একথা তো কোনোদিন বলিসনি! আজ হঠাৎ করে কী হল!’
‘হঠাৎ করে হয়নি মা। অনেকদিন থেকেই হয়েছে। তাই আমি ঠিক করেছি তোমাদের সঙ্গে আর কোথাও যাবো না। আর তোমাদের বন্ধু যারা আছে তারা থাকলে তো আরও যাবোই না।’
‘মানে কী! যত অদ্ভুত সব কথা।’
‘আমার কথা অদ্ভুত মনে হলে, আমাকে নিও না। তোমরা যাও।’
‘সেটা কী করে হয়?’
বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও কী বলতে চাইছে তা একটু শোন। এত রেগে গেলে হয়? তোমার বন্ধুদের না হয় আমি কিছু বলতে পারবো না। তা বলিও না। ঝুলন যখন কিছু বলতে চাইছে, সেটা তো শোনো।’

ঝুলন বলল, ‘তোমাদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে দেখেছি গাড়িতে তুমি মোবাইল খুলে অফিসের কাজে ডুবে থেকেছো। মা মোবাইলের দিকে চোখ রেখে স্কুলের পরীক্ষার খাতার নম্বরগুলি দেখছে। আমি তখন কী করব? আমিও বাধ্য হয়ে মোবাইল নিয়ে সবাইকে মেসেজ করেছি। ততক্ষণে কত কিছু ঘটে গেছে জানো?’
‘কি ঘটেছে?’ মা জানতে চাইল।
‘জানলার বাইরে মাইলের পর মাইল রাস্তা, কত দোকান, বাজার, লোকজন ছবির মতো চোখের সামনে থেকে দূরে চলে গেছে আমরা কেউ সেদিকে তাকিয়েও দেখিনি।’
‘তাতে কী হল!’

‘কত দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল। যা আর কখনো ফিরে আসবে না।’
‘সে না হয় আবার যখন ওই পথ দিয়ে যাওয়া হবে তখন দেখে নেওয়া যাবে।’
‘যে দৃশ্যগুলি চলে গেল তা কি আর কোনোদিন ফিরে আসবে মা? বাবার অফিসের কাজ তোমার স্কুলের খাতার নম্বর দেখা, এসব তো বাড়ি বসেও করা যেত।’
‘আর কী?’
‘আরও আছে। বলাটা কি ঠিক হবে?’
‘বল। বলতে তো আর কিছু বাকি রাখছিস না।’

‘সেবার হোটেলে গীজারটা খারাপ কেন, এই নিয়ে তুমি বেয়ারাদের ডেকে যা ইচ্ছে তাই বললে। অতটা না বললেও পারতে। দেখলে দশমিনিটের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেল। তারপর খেয়ে দেয়ে তুমি ঘুমালে। সন্ধ্যায় আমরা যখন বেরোলাম লোকজন জানাল রাতে কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। ফিরতে দেরি হলে ডিনার পাওয়া যাবে না। সেদিন কি হল? দিনটি বেকার। তুমি আর বাবা মোবাইল নিয়ে রইলে, আর আমি বেড়াতে গিয়ে মন খারাপ করে হোটেলের ব্যালকনিতে। এটা কি বেড়ানো হল।’
বাবা বলল, ‘আর আমাদের বন্ধুদের নিয়ে তোমার কী সমস্যা?’

‘কেন, তোমাদের চোখে পড়ে না? সারাক্ষণ তাদের রুমটা ভালো না। বেয়ারাগুলি অপদার্থ, তারা ঠিক মতো সার্ভিস দিতে পারে না। মাংসটা ভালো সেদ্ধ হয়নি। চাটনিতে মিষ্টি ছিল না। সারাদিন ওরা খিটিরমিটির করে। ওরা আকাশের চাঁদ দেখে না। পাহাড় দেখে না। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে কথা বলে না। ভালো শাড়ির জন্য সারাক্ষণ দোকান খোঁজে। কিনে লোকজনকে ডেকে ডেকে দেখাতে হবে।’
অবাক হয়ে ঝুলনের দিকে তাকিয়ে ছিল মা। বলল, ‘কী সব বলছিস?’

‘ঠিকই বলছি মা। বেড়াতে গেলে মনটাকে তেমন তৈরি করে যেতে হয়। সারাবছর যে মন নিয়ে কাটাই সেই মন নিয়ে বেড়াতে গেলে চলে? দল বেঁধে গেলেও দেখেছি কেউ একরকম মন নিয়ে যায় না। আমি ছোট, তাই আমাকে পাত্তা না দিয়ে আমার সামনেই একজন অন্যজনের নিন্দা করে। তাদের কথা শুনলে মনে হয় যেন ভিতরে অনেক ঈর্ষা, হিংসা লুকিয়ে রেখেছে। বেড়াতে গেলে আমরা যদি পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল দেখে তাদের মতো বড় মনের না হতে শিখি, তবে ঘরে বসে থাকাই তো ভালো। যেদিন তেমন হবে তখন বেড়াতে যাবো।’

‘যাক এতদিনে আমাদের শাসন করার মতো কাউকে পেলাম। আমাদের ফোনগুলি তোমার কাছে জমা রাখব।’
‘তা কেন? মোবাইল খুব প্রয়োজনের। তোমাদের কাছেই থাকবে। শুধু ব্যবহারের সময় ভাববে কোথায় কোন কাজ করা উচিত। যদি পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তোল, একদিন বাড়িতে বসে সেই ছবি দেখলে পাহাড় তোমার কাছে ধরা দেবে। অনেক মনখারাপের দিনে বেড়ানোর দিনটির কথা মনে পড়বে। তখন ভালো লাগবে।’
‘তাই হবে। আমরা তবে পরশু সকালে বেরিয়ে পড়ছি।’
ঝুলন মাকে জড়িয়ে ধরতেই মা হেসে ফেলল।