আমরা বন্ধু ক’জন

কাল্পনিক চিত্র

নিয়তি রায়চৌধুরি

আবার সেই এক ব্যাপার। আবার ধোঁয়াশা— একই প্রশ্ন। বিস্ময়। বার বার ছুঁয়ে দেখা— এবং গভীর বিশ্বাসে সেই মুহূর্তে মেনে নেয়া, —তুই তো ঠিকই আছিস অনু, দিব্যি আছিস! অনেকটাই নিশ্চিত আছিস। পারাপারের ভয়ঙ্কর চিন্তা তোর আর নেই। সেটা চুকে গেছে। যা নিয়ে আমরা সুগার প্রেশার ইউরিক অ্যাসিড কি হার্টের হাই অ্যালার্টে তটস্থ। কবে কী হয়। কত ভোগা দিয়ে যে শরীরের সেই গোলাকার বায়বীয় অক্টোপ্লাজম-টি হুস হয়ে যাবে, ভাবতেই ভয়ে মরি।

কথাটা শুনে চল্লিশের অনুমিতা এমন হাসল, যাতে তেমন গর্ব ফুটল না। ম্লান মুখে বলল, আমারও কেমন যেন লাগে। তোকে শরণ্যাকে বা পল্লবীকেই বল— তার মানে পল্লবী যেন না ভাবে ওকে মটু বলে বলছি,— আসলে, বয়স তো আর রোগা মোটায় কম বেশি হয় না! বয়স বয়সই। আমি তোদের থেকে অনেকটা নেমে থাকি— ভাবি, তোরা কি আমার শাশুড়ি বা বড় মামী গোছের! কেমন যেন গুরু-গুরু ভাব! বলেই সে কি হাসি অনুর।
আমরা তিন বন্ধু পল্লবী, শরণ্যা আর আমি অদিতি ওর কাঁধে পিঠে গালে হাত বোলাই— ছুঁয়ে ছেনে নাড়িয়েও যেন সাধ মেটে না, বলি, তা-ই যদি হয়, সেও বড় পরিতাপের, তাই না? এক শহরে এক স্কুলে কলেজে পড়তে পড়তে, সময় মতো বিয়ে হয়ে গিয়ে যে যার জায়গায় সেট আপ করে হঠাৎই মধ্য যৌবনে একজন থমকে গেল। এটা কী হল অনু!


অনু বলল, কী আর করা যাবে। ও ব্যাপারে তো কারো জারিজুরি খাটে না ভাই! আমি চাল ধুচ্ছি কি ডাল বাঁটছি— টিপ পরছি কি টিভি দেখছি বা পাড়ার কারো মরা নিয়ে ভাবছি যে, মৃত্যু ব্যাপারটা এয়াবসার্ড— ধুস–স–। যে মরে সে মরুক আমি মরছি না। রাতে আমার ফ্রিজে চিংড়ি রাঁধা আছে— ছেলেটা মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করল। ওর বাবা আহ্লাদে আমাকে একখানা অর্নামেন্ট দেব বলে ফেলেছে। তো এত সব কড়কড়ে সাধ আনন্দের পরত ভেঙে— না–না–। তবু—। তবু সেই ঝুলন্ত বঁড়শি আমাকে ঠিক সময়ে গেঁথে নিতে তো ভুলল না। আমি তো রোজকার মতো একটি মাত্র ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমোতে যাব ভেবেছিলাম। অতগুলো দরকারই হত না, যদি না সাউথ থেকে আসত সেই ফোন—।

পল্লবী বসেছিল ছাদের চেয়ারে পাশে আমি। একটু কোঁথ পেড়ে এধার ওধার হল। বরাবরের ওবেসিটি ইদানিং আরও ভারী করেছে দেহ। বলল, দ্যাখ আমার বয়স সেভেনটি ক্রস করল। সাত বছরের উইডো আমি। তোদের এসব কবেকার ব্যাপার তার ঠিক নেই। তবে কিনা, বয়স যত বাড়ে, সময় যত খাটো হয়ে আসে, বর্তমানের তুলনায় অতীতটাই ম্যাগনেটের মতো টানে বেশি। আমি তো আজকের কথা কাল ভুলে যাই, অথচ দশ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে হাতির পিঠে চড়ে কাশীমবাজারের রাজবাড়ি দেখা-টি জ্বলজ্বল হয়ে আছে।

এরপর পল্লবী আর আমি শরণ্যার একটা কথায় জোর হেসে উঠলাম। শরণ্যা বলছে, বেশ সুন্দর ফাঁকা ছাদ— তাও আবার পাঁচতলা। খুব ঘুড়ি ওড়াতে ইচ্ছে করছে— সেইসব পেটকাটি–চাঁদিয়াল—। আমি বললাম, তা আর করবে না কেন, সৈদাবাদের গঙ্গাধারে বিষ্ণুর সঙ্গে ঘুড়িই ওড়াতে যে বাবা—।

পল্লবী বলল, শেষ পর্যন্ত লাটাই গেল সুতপনের হাতে। বিষ্ণুই হল ভোকাটা। শরণ্যা ফোঁস করে উঠল, —সুতপনের কথা ভেবে বিষ্ণু স্যাক্রিফায়িস করেছে। বিষ্ণু ইচ্ছা করলে আমাকে পৃথিবীর বাইরে নিয়ে চলে যেতে পারত। সে আমাকে কথা দিয়েছিল। শরণ্যার চিৎকারে একটা সুন্দর ভোর ভোঁকাট্টা হয়ে গেল। সকাল মানেই স্বপ্নছেঁড়া দিন। দিনের কটকটে রোদ্দুর। ওঠো হাঁটো ছোটো—। অবশ্য এ বয়সে ওঠার সঙ্গে ছোটার সম্পর্ক নেই। আমি উঠে সদানন্দর জন্য এক কাপ চাও করে দিতে পারি না। অথচ সদানন্দ আমার থেকে দশ বছরের বড়। দিব্যি শীত গ্রীষ্মে মর্নিং ওয়াক করে। রান্নার মেয়ে আসার আগে নিজেই বার দুয়েক চা করে খায়। আমাকেও দেয়। দুবাইবাসী মেয়ের ফোন ধরে ঘর্ঘরে গলায়, এই যে মামণি, তোমার জন্যই বসে আছি। সবদিক দিয়ে ওদিকের আবহাওয়া কেমন? অ্যাঁ, কী বলছো?

আমি থাকি আমার মতো ওষুধ আর্থ্রাইটিস, মেয়ে জামাইয়ের খোঁজ খবর আর সদানন্দর সঙ্গে খিটিমিটি নিয়ে। আর আছে ঘুমের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে হাসি মস্করা, দেখা সাক্ষাৎ, হ্যাঁ সে এক বিরাট পাওনা বটে। তবে সেটা চাইলেই তো পাওয়া যায় না! তার জন্য আমার ভেতরের যে হাজার কোটি নিউরোনের উদ্যেগ, তার অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে এই নিউরনও তো মরছে রোজই— কত আর আশা করা যায়।

গত কয়েক বছর আগেও শরণ্যা পল্লবীকে নিয়ে এত সিটিং দিইনি। হয়ত সময়টা প্রশস্ত ছিল না। নিজের বৃত্তটুকুই একমাত্র যক্ষের ধন মনে হত। মেয়ের সদ্য বিয়ে হলেও সদানন্দ রিটায়ার করেনি। সবুজ হলুদ সিল্কগুলো ঝকমক করতো চারদিকে। বাপের বাড়ির ফোন এল তো হেঁশেল চুলোয়। তবে কিনা অনুমিতার ফোন কখনও পাব না জেনেই বোধহয় সেই নাইনটিন নাইনটি থেকে ওকে আমি মনের মধ্যেই রাখতাম। ভুলবার চেষ্টা করিনি। আজ অনুর কিছু অমীমাংসিত কথার টানে অন্যদের টানি।

সেদিন পল্লবী পুনে থেকে ফোন করে বলল, ডিসেম্বরে একবার কলকাতা যেতে পারি। ছেলের শ্বশুরবাড়ির তরফে একটা অকেশন আছে। প্লেনেই যাব। দিন তিনেক থাকলে একদিন লেক গার্ডেন্সে। শরণ্যাকে একবার দেখার ইচ্ছা থাকলেও ও তো শুনলাম দুর্গাপুরে সে সময় থাকবে না। শুনেই আমি, কবে ডিসেম্বর তার ঠিক নেই, ঘর গুছোতে শুরু করলাম। ভেবে রাখলাম ওই রাতটা আমি আর পল্লবী এক সঙ্গে শুয়ে গল্প করে কাটাব। সেদিন নো স্লিপিং পিল। তো দুপুরে একটু গা গড়িয়ে, টিভিটা খুলে মনে পড়ল, গত কালের এক সিরিয়ালে দুই বর্ষীয়সী বন্ধুর ফোনালাপে ওইরকম একটা কথা বোধহয় শুনেছিলাম। পল্লবী কি আদৌ ফোন করেছিল!
মনে করতে পারলাম না। তবু মনগড়া একটি স্তোকেই কেমন সহজেই রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। চতুর্দিক বাস্তবানুগ করে এল আমার বন্ধুরা। অবশ্যই মধ্যমণি অনুমিতা।

গোটাকতক গদি আঁটা চেয়ার একত্র করে বসি সবাই। অনুমিতা বসে না। তফাৎ থেকে বলে, এই বেশ আছি। তোদের মুখগুলো দেখতে পাচ্ছি বেশ। আমি মেনকাকে কফি করতে বলি।
অনু বলে, আমি ওসব এখন খাই না।
—কী খাস?
একটু ভেবে বলল, কী আর খাব!
পল্লবী বলল, অথচ বরুনের সঙ্গে বসে ঢাউস মগে কী কফিই না খেতিস! বলতেই বোধহয় মনে পড়ল, অনু, তুই যাওয়ার পর বরুণ আর আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখে না।
—কী করে রাখবে। বরুণ তো ছেলের কাছে বস্টনে থাকে। এখানে আনোয়ার শা রোডে ছেলে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে। সেখানে ওরা কদাচিৎ আসে। আমি বললাম, ওমা তাই! ঋষিণকে তুই বোধহয় টুয়েলভ পর্যন্ত দেখেছিলি। বিয়ে হয়েছে? বৌ কেমন?
—দারুণ। চোখ ধাঁধিয়ে যায়!
শরণ্যা বলল, আহা-রে! তুই শুধু দেখতে পেলি না।
—পেলাম না তো বলছি কীকরে!

অনুর ঝাঁজ দেখে আমরা সমঝে গেলাম। বললাম, হয়ত পাস। সবই দেখতে পাস। বরং বেশি পাস। কেননা তোর সর্বত্রগামিতার কোনো সীমা নেই তো! তবু এমন একটা জাগতিক আবডাল, যা আমরা বুঝতে পারি না। কেউ তো আর ঘুরে এসে কখনও বলেনি যে, জায়গাটা কী রকম। কান্তকবি যেমন বলেছেন, যবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব তোমার রসাল নন্দনে—। তার মানে অনুমান হয়, নন্দনটি যথেষ্ট রসাল, নাকি রে?
হাসছে অনুমিতা। কীসের অবিশ্বাস্যতায় কে জানে।
আমি বললাম, হ্যাঁরে অনু, সত্যি?
অনু ঠোঁটে আঙুল চাপল, —চুপ! স্পিকটি নট! এ ব্যাপারে আর একটি কথা নয়। আজ পর্যন্ত কারো বলার নজির নেই—।
—তাহলে বল, তুই চলে গেলি কেন?
সে একবার শরণ্যার দিকে তাকাল। শরণ্যা মাটির দিকে। আমি আর পল্লবী তাদের ঘাঁটাবার জোর পেলাম না।
এক সময় জেনেছিলাম, বিষ্ণুর প্রবল ঘনিষ্ঠতা অনুকে হ্যাটা দিয়েছিল। দেখতে মিষ্টি, স্বভাবে সুন্দর, বয়স যখন সকলেরই— একে তো ফাগুন মাস—
—দারুণ সময়—। তবে কেন হ্যাটা?

শরণ্যার যখন সুতপনের সঙ্গে বিয়ে হয়েই গেল, অনুমিতা অনূঢ়া। কী অসুবিধা ছিল বিষ্ণুর! কিন্তু বিষ্ণু সব ছেড়েছুড়ে চলে গেল সাউথে। অনু দু-দুবার অ্যাটেম্পট নিয়েছিল দড়িতে আর রেললাইনে। দু’বারই ধরা পড়ে, পাকড়াও হয় কারো না কারো হাতে। এরপর আর বাড়ির দেখে দেয়া পাত্র বরুণের পিঁড়িতে বসা ছাড়া উপায় ছিল না।

ব্যস হয়ে গেল! গল্পের নটে গাছ তো এখানেই মুড়োবার কথা। তা না হয়ে বিবাহিত ব্যবস্থিত জীবনের প্রায় কুড়ি বছর পর আর কি কোনো প্রেম থাকে। আমরা বললাম, শরণ্যা, তুই বা কি রে। বিষ্ণু তোর জন্যে হন্যে হল আর তুই গিয়ে উঠলি সুতপনের পিঁড়িতে!
শরণ্যা গলা নামিয়ে বলল, যদি বলি সেটা অনুকেই সুযোগ করে দিতে!
—বিশ্বাস হয় না।
—সেটা তোদের ব্যাপার।
নরেন মিত্রের একনিষ্ঠ পাঠক পল্লবী বলল, সবচেয়ে দূর আর দুর্গম হল বন্ধুজনের অন্তরদেশ। কী করে বুঝব বল।
শরণ্যা বলল, আমি জানতাম অনু ওকে ভালবাসে। আমি থাকলে ওকে পাবে না। বিষ্ণু বলেছিল সে আমাকেই পেতে চায়।
—তবে যে বললি বিষ্ণু স্যাক্রিফায়িস করেছে সুতপনের জন্য?
শরণ্যা বলল, সুতপন ওর বন্ধু। একই চাওয়া যদি ওরও থাকে, তাহলে কি সেটাই মনে হয় না!
আমরা বললাম, আর তোর?
শরণ্যা বলল, ওসব ফিলিংস আর এখন মনে নেই।
—উট যেমন মহাসুখে বাবলার কাঁটা চিবোয় আর গাল বেয়ে রক্ত ঝরে, মধ্যবয়সে সংসারে আমাদের তখন সেই দশা। কাঁটাও চিবোই, রক্তও গড়ায়, মজাও বেশ। অনু কি সেই উপলব্ধির বাইরে ছিল! কম বয়সের ব্যর্থতা মাঝবয়সে হীনমন্যতা আনল! প্রেম তাহলে কর্পূর নয়, লকারের গয়না ওর কাছে! যোগাযোগ ছিল নাকি বিষ্ণুর সঙ্গে! আর বিষ্ণুর শরণ্যা-প্রেম? সেটা?
আমরা কাঁটা চিবনো ফেলে সেসব আর ভাবিনি তখন। ভেবে উথাল–পাতাল হয়েছি সেই একবার, যখন খবর পাই অনু ওর তিনবারের লাস্ট অ্যাটেম্পটে সফল হয়েছে। ঘুমের বড়ি।
পল্লবী বলল, ওই যে বললাম, সবচেয়ে দূর আর দুর্গম হল বন্ধুজনের অন্তরদেশ!

এরপর বিপুল উৎসাহে অনুকে জড়িয়ে আমরা গালে গাল ঠেকালাম। সময়ের অনেক সিঁড়ি ভেঙে নীচের সেই চল্লিশে নেমে এসে বললাম, অনু, এই তো তুই দিব্যি রক্তমাংসের অনুমিতা, তাহলে? তা হলে তুই—।
—এরপর অনু আমার কাছে এক মাঝরাতের ঝিমধরা আচ্ছন্নতায় একা এল। আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, শোন অদিতি, যেটা বলা হয়নি, কাউকে বলিস না— বিষ্ণু আমাকেই ভালবাসত। কিন্তু আমার আগে শরণ্যাকে কথা দিয়েছিল বলে শরণ্যার চোখে ছোট হতে চায়নি। ও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। সবচেয়ে মারাত্মক যে কথাটা, ও চেয়েছিল জীবনটা ফের জুড়তে। সেই তাড়না ওর ইদানিং বেড়েছিল। তুই বল অদিতি, তা কি আর হয়! বয়স যে চল্লিশ!
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, সে কী বলছিস?
অনু কাতর গলায় বলল, আর একবার জন্ম নিতে সাধ হয়— কেন জানিস!
জীবনটা শুধরে নেবার জন্য।

মধ্যরাতের ঘুম ভাঙায় আমার আর বলা হয় না, তা হয় না অনু! সময় আর কখনও আমাদের এক জায়গায় আনবে না। অনুকে আনুপূর্বিক জানার তাগিদে আমার যে স্বপ্ন দেখা, আমি হঠাৎই প্রবল কেঁদে উঠে বুঝে গেলাম, অনু আর আসবে না—। কখনও না।