পার্কের পাশের বাড়ি

কাল্পনিক চিত্র

হেমন্ত জানা

পার্কটার একটা নাম আছে। তবে সে নামে কেউ চেনে বলে মনে হয় না। সেটা উদ্বোধনী ফলকেই রয়ে গেছে—ঊষা উদ্যান। সেটা ধুলো–কাদায় ঢাকা। সেদিকে কেউ আর তাকায় না। মুখে মুখে ফেরে প্রজাপতি পার্ক। পার্কের এমন নাম সময় বিশেষে হয়ে ওঠে। অনেক জায়গাতেই দেখা যায় উদ্যানের আদি নাম বদলে গিয়ে প্রজাপতি নামটা জুড়ে বসেছে। এতে পার্কের কোনও হাত থাকে না, জোড়ায় জোড়ায় তরুণ–তরুণী ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলে তল্লাটের মানুষই নামটা দিয়ে থাকে। ঊষা উদ্যানের সঙ্গে প্রজাপতি নামটা এভাবেই এসে থাকবে নিশ্চয়।

ঘিঞ্জি শহরের বুকে পার্ক চত্বরটাই একটু খোলামেলা। ঢুকলে বুক ভরে বাতাস নেওয়া যায়। সকালে এলাকার বয়স্করা প্রাতর্ভ্রমণে আসেন। তাঁরা বেরোতে না বেরোতে পার্ক চলে যায় তরুণ–তরুণীদের দখলে। এরা বেশির ভাগই কলেজ পড়ুয়া। এই সবে নামে আছে জেনে খানিক দূর থেকে গল্প করতে প্রেমিক–প্রেমিকারা চলে আসে। পার্কের একটা চেয়ারও ফাঁকা থাকে না। অনেকের আবার চেয়ারেও জায়গা হয় না, তারা মাটিতেই বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ সময় আর এই তল্লাটের মানুষ পার্কে ঢোকে না। না ঢুকে তারা শুধু সমাজটা গেল গেল করে বেড়ায়। কাউন্সিলর থেকে নানা দপ্তরে চিঠি–চাপাটি করে তারা। তবে এই তল্লাটের উঠতি ছেলেদের মৃদু মদত আছে। আর আছে বলেই পার্কে বসে দু–দন্ড শান্তিতে প্রেম করা যায়।


পার্কের চারপাশে স্থানীয় মানুষের বাড়িঘর। তাদের অনেকের ব্যাপারটা চোখ–সয়া হয়ে গেছে। এই পার্কেরই এক পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকে রথীন আর চন্দ্রা। দু–জনেই চাকরি করে। সকালেই বেড়িয়ে যায়, সন্ধেয় আসে। দু–পয়সা একটু বেশি রোজগারের জন্য ছুটির দিনেও দু–জনে কাজে বেরিয়ে যায়। পার্ক নিয়ে অনেক কিছুই তারা শুনেছে, কিন্তু তার এত কাছে থেকেও চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়নি এখনও। তা ওরা ভাড়া এসেছে বছর খানেক হতে গেল। নতুন যখন ভাড়ায় এল, এতসব খোঁজখবর নেওয়ার সুযোগ হয়নি। বর্ধমান থেকে এসে এই শহরের বুকে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার ছিল, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেখে ফোনে কথা হল। ভাড়াটা তুলনামূলকভাবে কম। পিছনে পার্ক, খোলামেলা দেখে চন্দ্রারও ভাল লাগল। বাড়িটা ভাড়া নিয়ে নিল। ওপর তলায় বাড়িওয়ালা থাকে, নীচে তারা। অফিসে কলিগরা যখন জানতে চাইলেন, ‘কোথায় আছেন?’‌‌ রথীন পার্কের নাম বলতেই সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন। ঠাট্টা করে বলেন, ‘বাঃ ভাল জায়গায় আছেন তাহলে। জানালার পর্দা তুললেই তো…।’‌ চন্দ্রাকেও তার অফিসে এমন তামাসা করে কলিগরা। তাই দু–জনেরই এই নিয়ে তীব্র কৌতূহল। কিন্তু কারও আর সেসব দেখার সুযোগ হয় না।

রবিরার রথীনের ছুটি। চন্দ্রার নির্দিষ্ট কোনও ছুটির দিন নেই। কাজ করলে টাকা। তাই ছুটি নিতে চায় না। ভোরে উঠে চন্দ্রা রান্না সেরে নেয়। ভাত তরকারি সঙ্গে নিয়ে দু–জনে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে। অফিস করে সন্ধেয় ঢোকে পার্কের পাশে ভাড়া বাড়িতে। তখন পার্কটা বন্ধ হয়ে যায়। আলো জ্বলে। প্রহরীটা লাঠি হাতে এমাথা–সেমাথা করে বেড়ায়। শোয়ার আগে রথীন একটা সিগারেট টানতে টানতে জানালার পর্দা সরিয়ে পার্কটা দেখে। কলিগদের বলা দৃশ্যগুলো কল্পনা করে। শরীরটা তেতে ওঠে। অফিস–ক্লান্ত চন্দ্রা তখন বিছানায়। রথীন শুয়েই চন্দ্রাকে কাছে টেনে নেয়। পার্কের একটা পর একটা কল্পিত দৃশ্য মনে এনে চন্দ্রাকে অনেকক্ষণ আদর করে। চন্দ্রা তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। নতুন একটা করে আনন্দের সকাল আসে তাদের কাছে।

প্রেম করে বিয়ে। রথীনের পাশের পাড়ার মেয়ে চন্দ্রা। প্রেমটা একেবারের ছোটবেলা থেকে। রথীনের থেকে বছর পাঁচেকের ছোট হবে চন্দ্রা। গ্রামে এপাড়া–ওপাড়া যাতায়াতের চল। রথীন ডেঁপো ছেলেদের দলে পড়ত। পাড়ার উঠতি মেয়েদের পিছনে লাগত। চন্দ্রা সবে ডাগর হচ্ছে। পাড়ার ছেলেদের মুখ ধরা হয়ে উঠছে। রথীনের নজর গেল। রথীনের নজর গেলে সেদিকে আর অন্য কারও তাকানোর সাহস ছিল না। স্কুল থেকে ফিরে চন্দ্রাদের বাড়ির পাশেই খেলতে যেত রথীন। চন্দ্রাদের বাড়ির দিকে ইচ্ছে করে বল ছুড়ত। চন্দ্রার মায়ের ভয়ে কেউ বাড়িতে ঢুকতে সাহস পেত না। ডাকাবুকো রথীন ঢুকে যেত চন্দ্রাদের বাড়িতে। চন্দ্রার মা গালমন্দ করত। চন্দ্রা মাকে বুঝিয়ে বলটা কুড়িয়ে রথীনের হাতে তুলে দিত। রথীন সেই সুযোগে চন্দ্রার হাতের ছোঁয়া নেওয়ার চেষ্টা করত। হাতে হাত রাখতে রাখতে প্রেম হয়ে গেল। একদিন মা ছিল না, বল কুড়োতে গিয়ে চন্দ্রাকে ধরে চুমো খেয়ে ছিল রথীন। দেখে ছিল পাড়ার আরেক ডেঁপো ছেলে কমল। সে কথাটা চাউর করে দিল। ওদের প্রেমটা জানাজানি হয়ে গেল। চন্দ্রার মায়ের তীব্র আপত্তি ছিল। চাষা বাবার মতামতের খুব একটা জোর ছিল। মায়ের কথার ওপর কথা বলার উপায় ছিল না গোবেচারা চন্দ্রার বাবার। লুকিয়ে–চুরিয়ে বছর পাঁচেক প্রেম চলেছিল। রথীন উচ্চমাধ্যমিকের পর আইটিআই ট্রেনিং নিয়ে ছোটখাটো কাজে ঢুকে পড়ে। চন্দ্রার মাধ্যমিকটা দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল, দুই দাদাকে ডিঙিয়ে একদিন বিয়ে করে ফেলল রথীন। বাড়িতে জায়গা হল না। বর্ধমান শহরে ঘরভাড়া নিয়ে থাকত।

সংসারে খুব কষ্ট গেল। একজনের চাকরিতে ঘর ভাড়া মিটিয়ে ভালভাবে সংসার চলত না। রথীন কলকাতায় কাজ দেখছিল। ভাল ইলেট্রিকের কাজ জানে সে। একটা কোম্পানিতে সুযোগ হল। চন্দ্রাকে কোথায় রেখে যাবে!‌ চন্দ্রা বলল, ‘আমার জন্যও একটা কাজ দেখ। একটা কাপড়ের দোকানে সেলসম্যানের কাজ জুটল। দু–জনেই চলে এল শহরে। মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার। চন্দ্রা মোবাইল ঘেঁটে পার্কের পাশের বাড়িটার সন্ধান পেয়েছিল। ভাড়া বর্ধমানের দ্বিগুণ। আবার কলকাতা শহরে সেই তুলনায় কম। সংসার চালাতে দু–জনেই উদয়াস্ত্র পরিশ্রম করে। এতদিন বিয়ে হয়েছে সাহস করে তৃতীয়জনকে আনতে পারেনি। রথীন চাইলেও চন্দ্রা সায় নেই তাতে। বলে, ‘আরও কিছুদিন যাক। এবাজারে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে অনেক খরচ। দু–পয়সা না জমালে তখন তোমার অনেক কষ্ট হবে।’‌ রথীন বলে, ‘বছর সাতেক তো হয়ে গেল। অনেক দেরি হয়ে গেছে চন্দ্রা, এরপর হয়তো আমরা বাবা–মা হতেই পারব না।’‌ চন্দ্রা বলে, ‘এমন অলুক্ষণে কথা বল না তো, আমার এখনও ঢেড় বয়স আছে।’‌

দিন গড়িয়ে যায়। পার্কে একটা করে নতুন প্রেমের জন্ম হয়, আবার কত প্রেম হারিয়ে যায়। একের প্রেমিকা অন্যকে কেড়ে নেয়। কত মান–অভিমানের পর আবার ভাঙা প্রেম জোড়া লাগে। কত কী ঘটে যায় তাদের বাড়ির পাশের পার্কে, টের পায় না রথীন–চন্দ্রা। শুধু চন্দ্রাকে আদরের মুহূর্তে রথীন পার্কের কল্পিত দৃশ্য রাতে ভাবে। আবার মনে মনে এটাও ভাবে ছেলেমেয়ে হলে এখানে থাকা যাবে না। নতুন ভাড়া বাড়ি দেখতে হবে। ছেলেমেয়েদের আর কত আড়াল করে রাখবে। জানালার পর্দা সরালেই পার্কের কীর্তি–কলাপ দেখতে পাবে তারা। যা সব চলে শুনি!‌

দেখতে দেখতে পার্কের পাশের বাড়িতে আরও একটা বছর গড়িয়ে যায় রথীন–চন্দ্রার। আচমকা চন্দ্রার রোজগার বাড়ে। কাপড়ের দোকানের মালিকের ছেলেই বাড়িয়ে দিয়েছে। বাবাকে সরিয়ে এখন সে–ই দোকানে থাকে। আগে দোকানে পা মাড়াত না। একদিন বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে এসে নজরে পড়ে চন্দ্রাকে। তারপর ঘনঘন দোকানে আসা। বাবাকে বিশ্রাম নিতে বলে ব্যবসা নিজের হাতে নেয়। বাবা ভাবে ছেলের এতদিনে ব্যবসায় মতি হল বুঝি। চন্দ্রা বোঝে অনেক পরে। নানা কাজের বাহানায় চন্দ্রাকে দোকানে আটকে রাখে মালিকের ছেলে রাজ। বলেছে, ‘যত ঘণ্টা বেশি থাকবে ওভার টাইম পাবে।’‌ ওভার টাইমের টাকাটা বেশ লোভনীয়। দু–পয়সা বেশি পাওয়ার লোভে চন্দ্রা থেকে যায়। বাড়ি ফিরতে রাত হয়। কোনওদিন রাত দশটাও বেজে যায়। মালিকের ছেলে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে যায়। রথীনের ভাল লাগে না। তারপর এখন ক্লান্ত চন্দ্রা আর আদরে অভিলাষী নয়, তা রথীনের সন্দেহ আরও ঘন হয় তাতে, তাল কাটে সংসারে।

চন্দ্রা বুঝতে পারে রাজের নজর পড়েছে তার ওপর। তবুও সে দু–পয়সা বেশি রোজগারের লোভে কাজ করে। রথীন ‌ওই দোকানের কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে।‌ চন্দ্রা বলে, ‘আর কিছুদিন আমাকে সময় দাও। দুর্গাপুজো আসছে, এ সময় হঠাৎ কাপড়ের দোকানের কাজ ছাড়া যায় না।’‌ রথীন সেই সময় দিতে চায় না, চন্দ্রাকে কাজে যেতে মানা করেছে। চন্দ্রার জেদ কাজ ছাড়বে না। এবার দু–জনের সম্পর্কে আড়াআড়ি চিড় ধরে। চন্দ্রা বাড়ি ফিরলেই দু–জনের ঝগড়া হয়। তবুও চন্দ্রা আর কিছুদিন ধৈর্য ধরতে চাইছে। এবার সে সংসারে আরেকজনকে আনবে। তার জন্যই সে এতদিন দোকানের মালিকের ছেলের নজর পড়েছে বুঝতে পেরেও দু–পয়সা বেশি রোজগারের আশায় কাজটা ছাড়তে পারেনি। ওই টাকা সে আলাদা করে জমিয়ে রেখেছে। আগামীদিনে যে আসবে তার জন্য তোলা আছে। রথীনকে বুঝতে দেয়নি। রথীন সেটা বুঝবেও না। চন্দ্রার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চায় না সে। বলে, ‘তুমি আর বাড়ি এসো না, ওই রাজের সঙ্গেই থেকে যাও।’‌ চন্দ্রা ভেবেই রেখেছে পুজোর পরই ছেড়ে দেবে। পুজোর আগে কাজ ছাড়াটা অমানবিক।

চিন্তায় চিন্তায় রথীনের মানসিক ভারসাম্য বিকল হয়ে আসে। এখন সে নিজের মনেই উদ্ভট বকে। রেগে গেলে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। চন্দ্রা ঘরে পা দিলেই তার রাগটা সপ্তমে চড়ে। রথীনের পাগলের লক্ষণ আরও স্পষ্ট হয়। আর কাজে যায় না বাড়িতেই থাকে। জানালার পর্দা সরিয়ে তাকিয়ে থাকে পার্কের দিকে। দেখতে থাকে কীভাবে রোজ নতুন নতুন প্রেমের জন্ম হচ্ছে। কত নতুন নতুন ছেলেমেয়ে পার্কে আসছে। বসে কাঁধে মাথা রেখে গল্প করছে। কত দূরের সম্পর্ক কীভাবে নিবিড় হয়ে উঠছে। আবার

দু–জনে অভিমান করে দূরে সরে যাচ্ছে, ফের কাছে আসছে। যে দৃশ্য সে রাতে কল্পনা করে এই ক’‌দিন সে এমন একটাও দেখেনি। ভুল ভাঙে রথীনের। তার নিজের প্রেমের কথা মনে পড়ে। ছোটবেলার প্রেম। চন্দ্রাকে একবার দেখার জন্য কত অছিলা করেছে। বল ওদের বাড়িতে ইচ্ছে করে ফেলে দিয়ে খুঁজতে ঢোকা। ওর মা–বাবা কখন থাকে না জেনে, সেই সময় বাড়ির পিছনে গিয়ে অপেক্ষা করা। এমনভাবে লুকিয়ে কত গল্প। এমনভাবেই একদিন এদিক–ওদিক তাকিয়ে কেউ নেই দেখে চন্দ্রার গালে চুমো খাওয়া। ওই ছেলেমেয়েগুলোও তো এর চেয়ে বেশি কিছু করে না। কত বছর আগের সেই প্রেমের সঙ্গে আজকের তো কোনও তফাৎ নেই।

সেদিন চন্দ্রা কাজে জবাব দিয়ে বাড়ি ফেরে। পরদিন রথীনকে নিয়ে সাইক্রিয়াট্রিসের কাছে যাবে। ডাক্তারের খোঁজ নিয়ে এসেছে। সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরল চন্দ্রা। দেখল রথীন জানালার ধারে বসে। আজ তাকে দেখে চিৎকার করে উঠে কোনও খারাপ কথা বলল না রথীন। চন্দ্রা আশ্চর্য হল। ধীরে ধীরে চন্দ্রার কাছে আসে রথীন। চোখ ছলছল করছে। ধরা গলায় বলে, ‘আমাকে ক্ষমা করো চন্দ্রা। অনেক খারাপ কথা বলেছি। আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।’‌ চন্দ্রা বলে, ‘আমি কাজটা ছেড়ে দিয়েছি। আজ ওদের জানিয়ে দিলাম।‌ ওভারটাইম করে ফিরতে রাত হচ্ছিল, তাতেই তোমার সন্দেহ। জানো, ওভারটাইম করছিলাম আমাদের সংসারের আরেকজনকে আনার জন্য। তার জন্য দু–পয়সা জমাচ্ছিলাম। না হলে এই শহরের বুকে তাকে মানুষ করব কী করে। ওভারটাইম করে যে দু–পয়সা বেশি রোজগার করেছি, সেটা আলাদা করে জমিয়ে রেখেছি।’‌ রথীন ডুগরে উঠে বলে, ‘এ জন্য তোমাকে অনেক খারাপ কথা বলেছি, আমাকে ক্ষমা করো চন্দ্রা।’

সন্ধে হয়ে আসে। প্রেমিক–প্রেমিকারা হাত ধরাধরি করে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। রথীন–চন্দ্রা হাতে হাত রেখে দেখতে থাকে। পার্কের আলোগুলো একে একে জ্বলে ওঠে।