বৃষ্টির প্রত্যাশায়

কাল্পনিক চিত্র

বর্ণালী ভৌমিক দে

ভাদ্রের কাঠফাটা রোদ্দুর যখন চারদিক চৌচির করে দিচ্ছে তখন হিজল গাছটার নিচে ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা। রোজ বিকেলে খেলতে এসে ফুটিফাটা মাঠ থেকে শালুক তুলে নিয়ে যায় বাচ্চাগুলো। জলের স্রোত থিতিয়ে গেলে যে শাপলা ফুটেছিল সেগুলো দিয়ে গেছে শালুক। তিথি মাঠের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘জানিস ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টি আসে।’ ওমনি উৎফুল্ল হয়ে উঠে বাবিন বলে উঠলো, ‘চল আমারও দিই। ওই শুকিয়ে যাওয়া বিলটায় একটু জল আছে ওইখানে কতো ব্যাঙ। ধরে নিয়ে এলেই হয়।’

এরপরই শুরু হলো পরিকল্পনা। কীভাবে হবে, কী খাওয়া দাওয়া হবে, সব মিলিয়ে হৈ হৈ ব্যাপার। বাবিনদের বড়ো উঠোনের মাঝখান সাজিয়ে চারটি কলাগাছ পুঁতে বিয়ের মণ্ডপ তৈরি হয়ে গেলো। তিথির নেতৃত্বে বিলে গিয়ে ধরে আনা হলো দুটি বেশ বড়সড় ব্যাঙ। গীতা ভাঙা বালতি জোগাড় করে জলে পুরে ফেললো ওদের। বাবিন ঘোষণা করলো হাত তুলে, ‘বরের নাম কিন্তু কেলে আর বউটির নাম শ্যামলী।’ বুঝতে কারো বাকি রইলো না, খুদে শরীরের রং অনুসারেই নামকরণ। বাবিনের ঠাকুমার তত্ত্বাবধানে একদিকে মাটির উনুন জ্বালিয়ে শুরু হয়ে গেলো গরম গরম খিচুড়ি আর বেগুন ভাজার প্রস্তুতি। ঠাকুমা অতি উৎসাহে নির্দেশ দিলেন, ‘আমার ঘরের পেছনের গাছ থেকে কয়েকটা টমেটো নিয়ে আয় রে। হালকা করে টমেটোর চাটনি হোক শেষ পাতে।’ ছুটলো গীতা। বাটি ভরে নিয়ে এলো লাল লাল টমেটো। এবার তো বর-কনেকে আনতে হয়। বাবিন মহা উৎসাহে বালতিতে হাত ঢুকিয়ে বাইরে নিয়ে এলো বর কেলেকে। তারপর সাদা ছেঁড়া কাপড়ে কপালে চন্দন লেপে কেলে রীতিমতো বিয়ের জন্য রেডি। কেলেকে তিথির হাতে রেখে বউকে বের করে আনা হলো। লাল শাড়ি কপালে সিদুর রীতিমতো বউ তখন শ্যাওলা মাখা শ্যামলী। দুটি ছোটো ছোটো কাঠের খণ্ড জোগাড় করে বসানো হলো বর-বউকে। তিথি আর গীতা ধরে থাকলো কেলে আর শ্যামলীকে। বাবিন পুঁথি ঘেঁটে আগেই বিয়ের মন্ত্র বের করে রেখেছিল। এবার জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ শুরু হলো। সব ঠিকমতোই চলছিল কিন্তু গোল পাকালো শ্যামলী। গীতার হাত আলগা পেয়েই হঠাৎ লাফ। বাবিন মন্ত্র পাঠ থামিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ধরো ধরো। পালিয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ধরো, কিছুতেই যেন উঠোন পেরিয়ে পালাতে না পারে।’


পেছনে ছুটলো গীতা, তারও পেছনে দু-তিন জন। কিছুতেই নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। শাড়ি খুলে পড়ে থাকলো উঠোনে। একমাথা সিদুর নিয়ে শ্যামলী তখন মুক্তির আনন্দে পাগলপারা। অবশেষে বাবিন পেছন থেকে লাফ দিয়ে ছোঁ মেরে তুলে নিলো শ্যামলীকে। ঠাকুমা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘বাঁধ দুটিকে। না হলে আবার পালিয়ে যাবে কিন্তু।’ ওদের এক পা টেনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হলো কলা গাছের সঙ্গে। এবার নির্বিঘ্নে বিয়ের কাজ চলতে লাগলো। লাফালাফি করলেও আর পালাতে পারছে না ব্যাঙ দু’টি। অন্যদিকে তখন রান্না চলছে পুরোদমে। মুগ ডালের হলুদ খিচুড়ি ফুটছে টগবগ করে। ধীরে ধীরে সন্ধে নেমে এলো গ্রামের এই উঠোন ঘিরে। চাপ চাপ অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো বাঁশঝাড়ের গা বেয়ে। দূরের মাঠে তখন একটানা চলেছে শেয়ালের ডাক। ছোটো একটা লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। খিচুড়ি নামতেই বেগুন ভাজার আওয়াজে জিভে জল সবার। অবশেষে

রান্না-বান্না শেষে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো খাবারের ওপর। সারা দিনের এতো দৌড়ঝাঁপ শেষে পেটে যে এখন ছুঁচো লাফাচ্ছে সবার। আগে থেকেই কলাপাতা কেটে রাখা হয়েছিল। পাতার সবুজ শরীরে হলুদ ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি। খেতে শুরু করলো সবাই ঠাকুমার তীক্ষ্ণ নজরের সামনে। সবাই যখন খেতে ব্যস্ত তখন কেলে আর শ্যামলী বসে আছে চুপটি করে। খাওয়া শেষে বাবিন বললো, ‘এবার কি ওদের ছেড়ে দিয়ে আসা হবে?’ বাবিনের মা ওদের কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন অনেকক্ষণ। এবার বলে উঠলেন, ‘ওদের বালতিতে রেখে দে। সারা রাত বেশি জলে যাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করবে আর ওতেই বৃষ্টি নামবে ঢেলে।’ সব গুছিয়ে সবাই অনেক রাতে দোর আটকে শুয়ে পড়লো। বাবিনেরও চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো আলগোছে। রাতে স্বপ্ন দেখলো বাবিন, আকাশে মেঘ করে এসেছে। বাঁশঝাড়ের ওপর খেলে যাচ্ছে দমকা হাওয়া। তীব্র আলো আর মেঘের গর্জন সঙ্গী করে বৃষ্টি এলো। চরাচর ভিজে যাচ্ছে যার জলে। মাটি শুষে নিচ্ছে প্রতিটি ফোঁটা। খালটা জলে ভরে যাচ্ছে তিল তিল করে। আর সেই জলে আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছে দুটি ব্যাঙ কেলে আর শ্যামলী। ধুয়ে যাচ্ছে সিঁদুর-চন্দন। খালের পাড়ের সবুজ কচু পাতায় জমে ফোঁটা জল। শ্যামলী পাতার ওপরে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে গেলো জলে চিৎপটাং হয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বাবিনের ঘুম গেলো ভেঙে। ঘুমঘোরও কেটে গেলো মেঘের গর্জনে। স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আনন্দের প্রত্যাশায় বাবিনের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। তখনও বৃষ্টি শুরু হওয়ার আনন্দে ডাকছে কেলে আর শ্যামলী।