গড়খাই

কাল্পনিক চিত্র

অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়

‘এই জায়গাটা ভালো করে দেখুন ফুলকাকু। সাহেবদের আমলে এখানে একটা পরিখা ছিল। গঙ্গার জলে পরিখাটা ভরা থাকত সবসময়।’

একটু ঝুঁকে পরিখাটাকে ভালো করে দেখলেন অম্বরীশবাবু। এখন এক ফোঁটা জল নেই সেখানে। শুকনো পাতায় ভরে আছে জায়গাটা। কে বলবে শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে ফোর্ট উইলিয়ামকে বাঁচানোর জন্য সাহেবরা এই গড়খাই-টা তৈরি করেছিল! এখন অবশ্য সাহেবদের দেওয়া নামটা পালটে দেওয়া হয়েছে। কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে থাকা এই বিশাল দুর্গটাকে পর্যটকরা এখন বিজয় দুর্গ নামেই চেনে।


অম্বরীশবাবুর অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল একবার ফোর্ট উইলিয়াম ঘুরে দেখবেন। কিন্তু দুর্গের ভেতর সেনাবাহিনীর লোক ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। অম্বরীশবাবুর ভাইঝি ডলির বিয়ে হয়েছে আর্মি-অফিসারের সঙ্গে। এতদিন ওরা দিল্লিতে ছিল। এখন জামাইয়ের ট্রান্সফার হয়েছে। ডলি কাকার মনের কথা জানত। তাই আজ কাকাকে ফোর্ট উইলিয়াম দেখাতে এনেছে। ডলি ছোটবেলা থেকেই খুব কম কথা বলে। আজও দুএকটা হুঁ, হ্যাঁ ছাড়া আর কিছুই বলেনি। যা কথা বলার সব জামাই শ্রীকান্তই বলেছে।
‘চলুন ফুলকাকু, এবার বাকিটা ঘুরিয়ে দেখাই আপনাকে।’

ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ভিকট্রি কমপ্লেক্সের কাছে চলে এসেছে। ভিকট্রি কমপ্লেক্সের ভেতরের রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্নভোজন সেরে বাইরে এসে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনজনে। শ্রীকান্ত বলে না দিলে অম্বরীশবাবু বুঝতেই পারতেন না ভিকট্রি কমপ্লেক্সকে ঘিরে থাকা ওই জায়গাটা আসলে একটা গড়খাই।

শ্রীকান্ত দরজা খুলে দিতেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতরে গুছিয়ে বসে পড়লেন অম্বরীশবাবু। পাশে বসল ভাইঝি ডলি। শ্রীকান্ত বসল সামনের সিটে। গাড়ি চলতে শুরু করল বড় বড় গাছের মাঝখানে থাকা চওড়া রাস্তা ধরে। শ্রীকান্ত বলল ‘বোমার হাত থেকে এই ফোর্টটাকে বাঁচানোর জন্য এখানে এমনভাবে গাছ লাগানো হয়েছিল যাতে ওপর থেকে মানে যুদ্ধবিমান থেকে দেখলে জায়গাটাকে জঙ্গল বলে মনে হয়।’

অ্যালবার্ট এক্কা অডিটোরিয়াম আর ইস্টার্ন কমান্ডের বিশাল প্রাসাদের সামনে দিয়ে ঘুরে গাড়িটা কমান্ড লাইব্রেরির সামনে এসে থামল। লাইব্রেরির সামনেই রয়েছে একটা বিশাল কামান। অম্বরীশবাবুর অবশ্য কামান দেখার ব্যাপারে অতটাও আগ্রহ নেই। যে জিনিসে মানুষের মৃত্যু হয় সেটা দেখে কী লাভ! মিছিমিছি মন খারাপ হবে।

অম্বরীশবাবু লাইব্রেরিটা ঘুরে দেখার জন্য এগিয়ে গেলেন। কিন্তু লাইব্রেরির দরজা তালা বন্ধ। বোধহয় রবিবার বলেই। মন খারাপ হয়ে গেল অম্বরীশবাবুর। আসলে উনি হলেন বইয়ের পোকা। সেই ছোটবেলা থেকেই একটা ভালো বই পেলে আর কিছুই চান না। ওঁর ছোটবেলা কেটেছে মফস্বলে। সেখানে ওঁদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটা লাইব্রেরি ছিল। বান্ধব পাঠাগার। চারপাশে সবুজ ঘাসের ভেতর একটা সাদা রঙের বাড়ি। বাড়ি ঠিক নয়, বইয়ের আলমারিতে ভরা বিশাল একখানা ঘর আর তার সামনে গ্রিল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা বারান্দা।

বই পড়ার আগ্রহ দেখে অম্বরীশবাবুর বাবা একদিন ওঁকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে লাইব্রেরির কার্ড করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন কতই বা বয়স ওঁর! এই বছর সাতেক। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তেন। বাবাকে সাইকেল বার করতে দেখে সেদিনও ছুট্টে চলে গিয়েছিলেন বাবার কাছে। তবে সেদিন আর বেড়াতে নয়, বাবা ওঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন বান্ধব পাঠাগারে। নাম-ধাম সব লিখে নিয়ে মোটা কাচের চশমা পরা টাক মাথা লাইব্রেরিয়ান, সবাই যাঁকে মাস্টারমশাই বলে ডাকত, একটা গোলাপি কার্ড দিয়ে বলেছিলেন ‘যতবার বই পালটাতে আসবে ততবার বইয়ের সঙ্গে এই কার্ডটাও নিয়ে আসবে।’

‘আসুন কাকু। কামানের পাশে দাঁড়ান। আপনার একটা ফটো তুলে দিই।’ শ্রীকান্তর গলা পেয়ে সম্বিত ফিরল অম্বরীশবাবুর। উনি হাসিমুখে কামানের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তবে মুখে হাসি থাকলেও অম্বরীশবাবুর মনের ভেতর একটা খচখচানি রয়েই গেল।

কাজের সূত্রে উনি এখন কলকাতায় থাকেন। প্রায় বছর কুড়ি হয়ে গেল ওই অঞ্চলে রয়েছেন। ওখানেও একটা লাইব্রেরি আছে। প্রথম প্রথম যখন সন্ধের দিকে লাইব্রেরিতে যেতেন, তখন দেখতেন লাইব্রেরিটা গমগম করছে। অনেকেই ওঁর মতো বই পালটাতে এসে লাইব্রেরিতে বসে গল্প জুড়েছে। কিন্তু এখন আর কেউ তেমন যায় না লাইব্রেরিতে। কমবয়সী ছেলে-মেয়েদের কাউকেই দেখা যায় না ওখানে। শুধু অম্বরীশবাবুর মতো
দু-একজন যান নিয়মিত।

‘চলুন কাকু, এবার ফেরা যাক। ফটোগুলো আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দেবো।’ মোবাইল ফোনটা পকেটে পুরে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল শ্রীকান্ত। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অম্বরীশবাবুর। এখন বেশ কিছু মানুষ অবসর সময়ে বই পড়ার জায়গায় মোবাইল ফোনে ওয়েব-সিরিজ দেখে কাটাচ্ছে।

গাড়ি করে যেতে যেতে দুর্গের ভেতরে থাকা গড়খাই-টাকে আবার একবার দেখতে পেলেন অম্বরীশবাবু। মোবাইল ফোনের ওই ওয়েব-সিরিজগুলো ঠিক এই গড়খাই-টার মতো পাঠক আর বইয়ের মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি করেছে। তবে এই ব্যবধান চিরস্থায়ী নয়। ওই গড়খাইয়ের জলের মতোই ওয়েব-সিরিজের আকর্ষণও একদিন কমে আসবে। মানুষ আবার অবসর যাপনের জন্য বই পড়া শুরু করবে। ছোট ছোট লাইব্রেরিগুলো আবার গমগম করবে পাঠকের ভিড়ে।