বটু

কাল্পনিক চিত্র

বিশ্বনাথ প্রামাণিক

মায়ের সম্মতির অপেক্ষা না করেই দৌড় লাগায় বটু। রান্নাঘরের কাজ ফেলে সুমনা চিৎকার করে, এই এই… দাঁড়া বলছি, বেয়াদপ ছেলে…অমন করে এই সকালবেলা কোথায় ছুটলি? তোর বাপ আসুক আজ… তারপর মজা টের পাবি…

ছুটন্ত ঘোড়ার হঠাৎ লাগামে টান পড়লে যেভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, সেভাবে ঘুরে দাঁড়ায় বছর পনেরোর বটু। মাথা ঝাঁকিয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে এক নিঃশ্বাসে সে বলে চলে— মা, আজ আমডাল করবে তো? তবে যাই, একছুটে… আমাদের বুড়োপুকুরের গাছ থেকে ক’টা আম পেড়ে নিয়ে আসি।


আজ পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। কর্মব্যস্ত মানুষের আনন্দে যেন মাটিতে পা পড়ে না। সেই ভোর থেকে নিজেদের ডাঙা-বাড়িতে, চাষের জমিতে, খড়ের আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দেওয়া, লোকের নিমগাছের কচিপাতা আর ফুল সংগ্রহ— গোটা সরদার পাড়ায় যেন উৎসবের ধুম পড়ে যায়।

মাটির এক চিলতে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে, নিমের ডাল আর পাতা থেকে সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলগুলো, আঙুল দিয়ে খুঁটে খুঁটে বেছে, আলাদা করতে করতে, সুমনা চিৎকার করে ওঠে —সবে গায়ে নিম-হলুদ মাখিয়ে দিয়েছি, এখনও গা তেলে জবজব করছে, গাছে উঠিসনে বাপ, পড়ে যাবি যে!

বটু সে কথা কানে তুললে তো! ছোট্‌কার ছেলে বুলুর হাত ধরে, একদৌড়ে তাদের পুকুরপাড়ের সেই বড় আম গাছটার নীচে এসে দাঁড়ায়।

আজ কত কাজ তার! বছরের এই একটা দিনের জন্য সেও যেন সারাবছর অপেক্ষা করে থাকে। কত কী রান্না হবে তাদের —নিমফুল ভাজা, পাঁচমিশালি সবজির শুক্তো, ডাল, আলুভাজা, পটলভাজা, মাছের ঝোল… মাছের কথায় মনে পড়ে, আজ যে বাবুদের পুকুরগুলোনো হবে…

সে বলে— এই বুলু, ওপাড়ায় মাছ ধরতে যাবি? বুলু সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই সেও মনে মনে ঠিক করে নেয়, বাবা বাজার থেকে ফিরলেই, বাবার সঙ্গে জাল নিয়ে মাছ ধরতে বেরবে।

রতনদের পাড়ায়, বাবুদের পুকুরে সাতপাড়ার লোক এক হয়ে জাল দিয়ে মাছ ধরবে— যার যত্তো খুশি। কেউ বারণ করার নেই।

সারাবছর মাছ খাওয়ার পর, পড়ে থাকা অবশিষ্ট মাছ, নববর্ষের দিনে ফি-বছর বাবুরা পাড়ার লোকেদের ধরার অনুমতি দেয়। তবে যে যতো ধরে, তার থেকে একটা করে বড়মাছ বড়বাড়িতে দিয়ে আসতে হয়। তা হোক, গরিব কাঙালগুলো মাছের আনন্দে উন্মত্ত হয়ে লাফিয়ে পড়ে পুকুরে। সেও যাবে।

বাবাটা যে কী করে না! এখনো বাজার থেকে ফিরলো না! সে তাড়াতাড়ি কয়েকটা বড় আম পেড়ে নিয়ে তরতরিয়ে নেমে আসে। কয়েকটা বুলুকে দেয়— যা, জেঠিমাকে দিবি। কাঁচা খাসনি যেন। যা টক না, দাঁত শিইলে যাবে। ভাত খেতে পারবিনি। আম-ডাল করবি।

বটু এক দৌড়ে মায়ের কাছে আসে, মা জালটা দাও। সবাই মাছ ধরতে নেমে পড়েছে যে…
—কোথায়?
—সে কি তুমি জানো না! আজ ওপাড়ায় বাবুদের পুকুরগুলোনো হবে যে…
উৎকন্ঠিত সুমনা বলে, তোর বাপ আসুক, তারপর যাবি।
—কিন্তু ততক্ষণে সব মাছ ধরে নেবে মা…
বাপটা যে কেন এত দেরি করে কে জানে! তার আর তর সইছিল না। সব মাছ উঠে গেলে, তারা আর গিয়ে কী ধরবে?

সে উৎকণ্ঠায় অস্থির হয়ে ওঠে। আর যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পায়, বড় বড় সব মাছ— রুই, কাতলা, বোয়াল, শোল… পাড়ার লোকে জাল ফেলে হাড়ি ভর্তি করে ধরে নিচ্ছে।

চুপি চুপি ঘরে ঢুকে, কখন যে ছেলেটা জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, টের পায় না সুমনা। তারপর একদৌড়ে পুকুরপাড়ে। কত কত মাছ ধরছে সবাই। পুকুরের জল-কাদায় মাখামাখি। পুকুর ভর্তি কালো কালো মাথা, হাতে জাল নিয়ে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ভেসে বেড়াচ্ছে। হইহুল্লা, চিৎকার-চেঁচামেচিতে সরগরম হয়ে উঠেছে পুকুরপাড়। বাবুর বাড়ির লোকেরা তাদের ছাদে বসে এসব মজা দেখে।

কিন্তু আশ্চর্যের আশ্চর্য। পুকুরের পশ্চিম দিকটায়— যেখানে সে-বছর রাস্তা মেরামতের জন্য চৌকো কেটে মাটি তুলে নিয়েছিল, ঠিক বাঁশ বাগানের নীচটায়, সেখানে কাউকে নামতে দেখা যায় না। ওখানে গভীরতা অনেক, একটা গোটা বাঁশের তিনভাগ নাকি জলে ডুবে যায়। লোকে বলে, এটাই বাবুদের মাছ লুকিয়ে রাখার ফাঁদ। সব মাছ তাড়া খেয়ে ওই গভীরে এসে লুকায়।

বটু চুপি চুপি সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। ওই তো একটা বড় কাতলা মাছ, কেমন মুখ উঁচু করে খাবি খাচ্ছে! জাল হাতে বাঁশগাছের ঠিক নিচে উবু হয়ে বসে বটু। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে— শিকারী বাঘের মতো। লোভে আর লালসায় তার চোখ বিড়ালের মতো জ্বলজ্বল করছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাসে বুকের ওঠানামার ধুকপুকুনি স্পষ্ট শুনতে পায় সে।

একপলকে পুকুরের হালচাল বুঝে নিয়ে, মাছটা লেজ ঘুরিয়ে যখন জলের নিচে মুখ লুকাতে যাবে, ঠিক তখনই সে লাফিয়ে পড়ে।

কালো ও অস্বচ্ছ জলের অতলে মাছটাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে থাকে বটু। গভীরে আরো গভীরে, যেন একেবারে সমুদ্রের তলায়। আর অস্বচ্ছ কালো জলের গভীরে, সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায়, চারিদিকে রাশি রাশি মাছেদের ছানা, নিঃসংকোচে পরমানন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে। আনন্দে তার চোখ চকচক করে ওঠে…
সহসা হাতের জাল ফেলে দিয়ে, সেও তাদের পিছনে পিছনে ভেসে যেতে থাকে— পুকুর, খাল, নদী বেয়ে একেবারে সমুদ্দুরে…