পুরস্কার

কাল্পনিক চিত্র

গৌতম দত্ত

আজ স্কুলে রেজাল্ট দেওয়া হবে। নির্ধারিত সময়ের অনেকটা আগেই শিউলি স্কুলচত্বরে হাজির হয়েছে। সাধারণত স্কুলে সবার প্রথমে হাজির হয় রাকেশ, সুকুরুল্লা, কিংবা জিয়ানের মতো ডানপিটে খেলা-পাগল ছেলেরা। আজ তারাও উপস্থিত হয়নি। হতে পারে রেজাল্ট নিয়ে তাদেরও খানিক উৎকণ্ঠা রয়েছে। শিউলি স্কুল লাগোয়া মাঠে হেঁটে হেঁটে চরকিপাক দেয় আর হাতের কর গুনে মনে মনে হিসেব কষে, রথের মেলার পরের দিন মাঠ পরিষ্কারের জন্য একদিন, শ্রাবণ মাসের শেষ মঙ্গলবারের বৃষ্টিতে পুকুর ভেসে ঘরে জল উঠলে দু’দিন, জব্বারদের আলু খেতে আলু টোকাতে গিয়ে একদিন— মোট ছয় কী সাতদিন ওর চলতি বছরে স্কুল কামাই হয়েছে। তবুও শিউলির হিসেব বলছে ওটা আজকে ওর হাতেই উঠবে।

শিউলি মাঠের দক্ষিণদিকে কৃষ্ণচূড়া গাছটির দিকে তাকায়। অজস্র লাল-লাল ফুলের থোকা। গাছের ফাঁক দিয়ে আলোর কিরণ উঁকি দিচ্ছে। হেডমাস্টারমশাই রতনবাবু মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলে উঠলেন, এই শিক্ষাবর্ষে চতুর্থ শ্রেণিতে বিদ্যালয়ে সবথেকে বেশি দিন উপস্থিতি দিয়ে পুরস্কার জিতে নিচ্ছে শিউলি বড়াল। এরপর তিনি শিউলির হাতে সোনার মতো চকচকে ট্রফিটা তুলে দিচ্ছেন। উফ, দৃশ্যটা ভাবলেই সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে শিউলির! এমন ঘটনা কি সত্যি ঘটতে পারে? মুহূর্তটা মাথার মধ্যে এলেই শিউলির বুকের রক্ত ছলকে ওঠে। আচ্ছা শিউলির নাম না বলে রতনবাবু যদি সোহিনী সরকারের নাম ঘোষণা করেন, তাহলে কী হবে? এই ভাবনাটা এলেই শিউলির মুখটা বাসি ফুলের মত শুকিয়ে যায়।


সোহিনী ক্লাসে প্রত্যেকবার ফার্স্ট হয়। তার জন্য আলাদা করে পুরস্কারও পায়। শিউলি কিন্তু সোহিনী হতে চায়নি। ও জানে, সোহিনী হওয়া মোটেই সহজ নয়। সোহিনীর ফর্সা ধবধবে সাদা জামায় এক ছিটে নোংরার দাগ লাগে না কখনো। গোলাপ ফুলের পাপড়ির মতো সুন্দর হাতের লেখায় কঠিন কঠিন অঙ্কগুলো কী অনায়াসে ও করে ফেলে! শিউলির মনে হিংসে হয়। কিন্তু টিফিনবেলায় ছোট্ট কৌটোয় খেজুর কিংবা আমসত্ত্ব আনলে শিউলিকেও ভাগ দেয় সোহিনী। তখন সোহিনীর উপর রাগ করেও থাকা যায় না। তবে রুমাদিদিভাই যখন সোহিনীকে আদর করে গাল টিপে দিতে দিতে বলে, ‘রসগোল্লা একটা!’ তখন গোটা ক্লাস হেসে উঠলেও শিউলি হাসতে পারে না। একটা প্রজাপতি একদল অভিমান নিয়ে ওর বুকের মধ্যে ডানা ঝাপটায়। প্রজাপতিটা কেন এমন করে শিউলি জানে না।

শিউলিও চেষ্টা করেছিল। স্কুলে রুমাদিদিভাইয়ের করিয়ে দেওয়া বাংলা ছড়া, ইংরেজি রাইমস রথের মেলায় কেনা ছয় ইঞ্চি আয়নার সামনে বারংবার বলে বলে মুখস্থ করেছে। শুধু বশে আনতে পারেনি অঙ্কের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ চিহ্নগুলোকে। খালি এদিক ওদিক পালিয়ে যায়। কিছুতেই হাতের নাগালে আসে না। বিশেষ করে বিয়োগটি ভারি দুষ্টু, খালি শিউলির বাবার ঝুলিয়ে রাখা প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে পড়ে।

পি পিপ পি পিপ— ওই তো হেড মাস্টারমশাই রতনবাবু স্কুটি নিয়ে হাজির। গেট খুলছেন। সব ছেলেমেয়েরা গেটের সামনে ভিড় করে। বাচ্চাদের পিছনে গার্জিয়ানের দল। রেজাল্ট বলে কথা, অনেকেরই বাবা-মা এসেছে। ওইতো রুমাদিদিভাই আসছেন ছাতা মাথায় দিয়ে। দিদিভাইয়ের হাসি হাসি মুখ। শিউলি যা ভেবেছিল তাই, সোহিনীকে দেখে হাসছেন রুমাদিদিভাই।

একটা কথা তো বলাই হয়নি, শিউলির একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। ও গাছেদের সঙ্গে, ফুলের সঙ্গে কথা বলতে পারে। এই যেমন ফুলের বাগানে সদ্য প্রস্ফুটিত সাদা গোলাপটি হাত নেড়ে বলল, শিউলি টেনশন কোরো না, সব ভালো হবে। আবার শিউলি যখন জিজ্ঞাসা করল, আজকে মিড-ডে-মিলে পায়েস হবে কি? তখন হলুদ গাঁদাফুলে ভরা গাছটি দুলে উঠল। তবুও শিউলির মুখে হাসি ফুটল না। ওর সারা মুখে চিন্তা আর চিন্তা। কী হবে একটু পরে?

হেডমাস্টারমশাই রতনবাবু মাইকে ঘোষণা করলেন, চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা হলঘরে চলে এসো। ওখানে তোমাদের রেজাল্ট ও পুরস্কার দেওয়া হবে। দুরু দুরু বুকে সোহিনীর পাশে গিয়ে বসে শিউলি। সোহিনী বলে, অল দ্য বেস্ট। শিউলি খালি হাসে। শিউলির প্রথম অঙ্ক মিলে যায়। সোহিনী এবারেও পরীক্ষায় ফার্স্ট। কিন্তু দ্বিতীয় অঙ্ক মেলে না। এই শিক্ষাবর্ষে চতুর্থ শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশিদিন উপস্থিত হয়ে পুরস্কার জিতে নিল সন্দীপ বড়ুয়া। শিউলির এই ঘোষণা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না! ওর সারা শরীর অবশ হয়ে আসে। মুখ থেকে রা কাটে না। চুপ করে বেঞ্চের এক কোনায় সিঁটিয়ে যায়। শুধু প্রজাপতিটা বুকের মধ্যে ডানা ঝাপটাতে থাকে।

হঠাৎ রুমাদিদিভাই মাইক্রোফোন নিজের হাতে তুলে নেয়, ‘একটি ঘোষণা, আমরা এই বছর একটি বিশেষ পুরস্কার একজনকে দিতে চাই। যার জন্য আমাদের আনন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এই বছর জেলা থেকে নির্মল বিদ্যালয়ের পুরস্কার জিতেছে। সেই শিক্ষার্থী আমাদের বিদ্যালয়ের স্যার-ম্যাডামদের সঙ্গে নিজের হাতে ফুলের গাছ লাগিয়ে, জল-মাটি দিয়ে সুন্দর একটি পরিবেশ গড়ে তুলেছে।’ সবার মুখে তখন বিস্ময়। কে সেই শিক্ষার্থী? দিদিমণিই ঘোষণা করলেন, ‘আর সেই শিক্ষার্থীর নাম হল শিউলি বড়াল।’ নাম শোনামাত্র এক ছুটে ঘর থেকে পালিয়ে যায় শিউলি। সোজা চলে আসে বাগানে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে বাগান জুড়ে, আর শিউলির চোখ দিয়ে ঝরছে মুক্তো। মাচা থেকে নিচু হয়ে কুমড়ো গাছের লতানো কাণ্ড ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল শিউলি।