তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
১১.
চিত্রজিৎ
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সে দিন ভরা সাঁঝে
সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছে যোধপুর পার্কের অপেক্ষাকৃত নির্জন পটভূমিতে৷ রাস্তায়, প্রতি বাড়িতে, ফ্ল্যাটগুলিতে জ্বলে উঠছে আলো৷ মাঝেমধ্যে মোবাইলের পর্দায় চোখ রাখছিল চিত্রজিৎ৷ অলমিতির প্রতীক্ষায় চুরমুর হচ্ছিল, অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল ঘরের মেঝেয়৷ মাঝেমধ্যে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে চোখ রাখছিল৷ রাস্তার দুপাশে উঁচু ফুটপাথ, মধ্যে ডিভাইডার, বেশ ঝাঁ–চকচকে পিচপথ৷ লোকজন যাতায়াত করছে, মাঝেমধ্যে গাড়ি আর বাইক৷ চৈত্রের প্রথমদিক, দুপাশের গাছপালা থেকে শুরু হয়ে গেছে পাতা ঝরার শোকবার্তা৷ ঝরা পাতারা কিছু পড়ে আছে মনমরা হয়ে, কিছু অসহায় উড়ছে হাওয়ায়৷
সন্ধের পরও বাতাসে গরম হলকা৷ মাথার উপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানও ঘুলিয়ে দিচ্ছে গুমোট৷ এসি চালাবে কি চালাবে না ভেবে দ্বিধাগ্রস্ত৷ এমন সময় মোবাইলে রাকেশ মিত্রর নাম৷
ভুরুতে একটা মস্ত কোঁচ ফেলে অন করতে শুনল, কিছু ভাবলেন মি. চৌধুরী?
চিত্রজিৎ বুঝে উঠতে পারছিল না কী উত্তর দেবে৷ বলল, আমাকে একটা দিন সময় দিন, রাকেশবাবু৷
––আরও একটা দিন! ওদিকে মুম্বাই থেকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে যে––
––ওদের বলুন, ছবি আঁকতেও তো সময় লাগবে৷
––তা নিশ্চয় লাগবে৷ কিন্তু আপনি কনফার্ম না করলে ওদের সঙ্গে চূড়ান্ত কথাবার্তা করব কীভাবে? আপনাকে কুড়িটা ছবি আঁকতে হবে৷ তার জন্য ওরা আপনাকে চল্লিশ লাখ টাকা দেবে৷
টাকার অঙ্ক শুনে আরও অস্থির বোধ করল চিত্রজিৎ৷ তার এতকালের ছবি বিক্রি করে যা টাকা পেয়েছে, তার চেয়েও বেশি টাকা শুনে খুবই উত্তেজিত৷ সুরঞ্জনা অনেকদিন ধরেই বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে গানের জগতে৷ ইদানীং আরও সুনাম হয়েছে তমোনাশের সঙ্গে জুটি বেেঁধে৷ কত টাকা পাচ্ছে তা অবশ্য তাকে বলে না ইদানীং৷ তুলনায় চিত্রজিৎ নিষ্প্রভ, এত বছর এঁকেও সেই সুনাম পায়নি যা তার সমকালীন অনেক শিল্পী পেয়েছে।
তবে ন্যুড সিরিজের ছবি এঁকে টাকা উপার্জন করতে সে কখনও চায়নি৷ সুরঞ্জনা যদি শোনে তার অর্থ উপার্জনের পথ এরকম––
তবে চিত্রজিৎ এখন আর সুরঞ্জনার মতামতের তোয়াক্কা করছে না৷
––ঠিক আছে, রাকেশবাবু, কাল সকালে আমি বলব আপনাকে৷
––ঠিক আছে, মি. চৌধুরী৷
ওপাশের সংযোগ বন্ধ হয়ে যেতে চিত্রজিৎ চেয়ারে বসল উত্তেজনা প্রশমিত করতে৷ সন্ধে পেরিয়ে রাত্রির সামান্য পদচারণা বাইরের পৃথিবীতে৷ অলমিতি বলেছিল সন্ধের পর আসবে৷ এর পর কি আর আসবে! নিশ্চয় তার মনে চলছে একশো দ্বিধার পায়চারি।
টেবিলের উপর রাখা একটা আর্টের বই খুলে মনোনিবেশ করল তার পৃষ্ঠায়৷ আগের দিনও পড়েছিল ইতালির চিত্রকলার এক কিংবদন্তীপ্রতিম শিল্পী আমেদো মদিগ্লিয়ানির কাহিনি৷ খুব অস্থির মস্তিষ্ক এই শিল্পী তাঁর জীবনকে নিয়ে জুয়ো খেলেছিলেন৷ ছোটো থেকেই তাঁর ধারাবাহিক অসুস্থতা৷ সুস্থ হওয়ার পর ছবির জগতে প্রবেশ৷ আকৃষ্ট হলেন ইতালীয় ইমপ্রেশনিস্টদের আঁকায়৷ কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গড়লেন একটি শিল্পীগোষ্ঠী৷
তাঁর বেশিরভাগ ছবিই ন্যুড শরীরের৷ শায়িত বা উপবিষ্ট বা দাঁড়ানো অবস্থায় এক–একটি ছবি৷ অনেক মডেল ব্যবহার করেছেন ছবি আঁকতে৷ মডেলদের চোখ বেশ আয়ত, ধারালো নাক, চিবুকের ডৌল চমৎকার৷ ঠোঁটের অভিব্যক্তি এমনই যেন কিছ বলতে চাইছে পাতলা দুটি ঠোঁট৷ শরীর মেদহীন৷ তাঁর মডেল হতেন নিজের প্রেমিকা বা কোনও অনুরাগিনী৷
বইয়ের পৃষ্ঠায় মনোনিবেশের মধ্যেই হঠাৎ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অলমিতি৷
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে ভিতরে চলে এল৷ চিত্রজিৎ লক্ষ করলেন কীরকম হাঁপাচ্ছে অলমিতি, যা অন্যদিনের তুলনায় ব্যতিক্রমী৷
––বোসো––
অলমিতির পরনে হালকা সবুজ রঙের চুড়িদার৷ কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ৷
চিত্রজিৎ বলল, গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় সাতদিনের একটি প্রদর্শনী হচ্ছে, একেবারে নতুন শিল্পীদের ছবি থাকবে৷ সবার পাঁচটা করে ছবি৷ আমি তোমার নাম রেখেছি সেখানে৷
অলমিতি চুপ করে থাকে৷
––তোমাকে বলেছিলাম সাত–আটটা ছবি এঁকে রাখতে৷ ছবি তৈরি?
অলমিতি ঘাড় নাড়ে, হ্যাঁ, স্যার৷
––তোমার একটা ছোটো বায়োডেটা দেবে আমাকে৷ ওরা একটা ফোল্ডার বানাচ্ছে, তাতে ছাপাবে৷ সঙ্গে একটা পাসপোর্ট–সাইজের ছবি৷
অলমিতি বলল, পাসপোর্ট ছবি তোলা নেই স্যার৷ স্টুডিওতে গিয়ে তুলতে হবে৷
অলমিতির গলার স্বর কেমন ফ্যাঁসফেসে লাগছে৷ খুব ভয় পেয়ে গেলে যেমনটি হয়৷
চিত্রজিৎ তা লক্ষ করে বলল, এ ধরনের ফোল্ডারের জন্য মোবাইলে তোলা ছবিই যথেষ্ট৷ নেই সেরকম ছবি?
অলমিতি মনে করার চেষ্টা করে বলল, আছে, স্যার৷
––যদি না থাকে তো কোনও বন্ধুকে নিয়ে তুলিয়ে নিও৷ আর ছবিটা পাঠাতে হবে মেলে৷ ওয়াটস আ্যপে পাঠানো ছবির প্রিন্ট তেমন ভালো আসে না৷ আমি তোমাকে মেল নম্বর দিয়ে দেব৷
ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ পাশের ঘর থেকে ভেসে এল সুরঞ্জনার গান:
মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সে দিন ভরা সাঁঝে,
যেতে যেতে দুয়ার হতে কী ভেবে ফিরালে মুখখানি––
কী কথা ছিল যে মনে৷৷
গানটি কানে আসতে বেশ থমকে গেল চিত্রজিৎ৷ হঠৎ এই গানটা কেন গাইছে সুরঞ্জনা।
গানটা চিত্রজিতেরও খুব পছন্দ৷ কিন্তু এই সন্ধেবেলায় চিত্রজিৎ আর অলমিতি দুজনেই যখন একটি দ্বিধার মধ্যে বিরাজ করছে, তখন সুুরঞ্জনাও—
সুরঞ্জনা কি তাদের কথা শুনতে পাচ্ছে! রবীন্দ্রগানে প্রেমিক তার প্রেমিকাকে একরাশ দ্বিধার মধ্যে রেখে চলে গেল, যেতে যেতে দরজার কাছে হঠাৎ কী মনে হতে পিছন ফিরে তাকাল একবার৷ তার মনে কিছু হয়তো ছিল বলার।
চিত্রজিৎ চোখ রাখল অলমিতির চোখের দিকে৷ অলমিতির চোখেও কি সেই দ্বিধা!
চিত্রজিৎ উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিল যাতে গানটা কানে না আসে৷
না কি তাদের কথোপকথন যেন শোনা না যায়।
তাকে দরজা বন্ধ করতে দেখে অলমিতি আরও টেনশনে পড়ে গেল৷
কিন্তু বন্ধ দরজা ভেদ করে সুরঞ্জনার গান ঘুরে বেড়াচ্ছে চিত্রজিতের ঘরের সর্বত্র:
তুমি সে কি হেসে গেলে আঁখিকোণে––
আমি বসে বসে ভাবি নিয়ে কম্পিত হূদয়খানি
তুমি আছ দূর ভুবনে৷৷
প্রেমিক কি থমকে দাঁড়ানোর ফুরসতে এককুচি হাসি উপহার দিয়ে গেল প্রেমিকাকে?
চিত্রজিৎ ভাবছিল কী করে অলমিতির কাছে আরও একবার প্রস্তাবটা দেবে।
অলমিতি যদি ফিরিয়ে দেয় তার প্রস্তাব।
সুরঞ্জনার গান তখন চিত্রজিতের মনের ভিতর ঘূর্ণি তুলছে। ইমনকল্যাণ রাগের এই গানের মধ্যে একটা করুণ আর্তি নিহিত৷
আকাশে উড়িছে বকপাঁতি,
বেদনা আমার তারি সাথি৷
চিত্রজিতের মনের ভিতর গানের কলিদুটো ঝড় তুলছে৷ জানলা দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখতে দেখতে আবিষ্কার করতে চাইছিল সেই বকের দল, যারা তার মনের অস্থিরতা বহন করে উড়ে চলেছে অনির্দেশ্যের দিকে৷
––অলমিতি, তুমি কী ভাবছ তা আমি জানি, কিন্তু ভালো করে বাঁচতে হলে টাকাটাও একটা ফ্যাক্টর৷
অলমিতি বুঝতে চাইছিল চিত্রজিতের কথার অর্থ৷ বড়ো বড়ো শ্বাস নিচ্ছিল৷
ঘরের দেওয়াল ভেদ করে তখন প্রবেশ করছে গানের শেষ কয়েকটি কলি:
বারেক তোমায় শুধাবারে চাই বিদায়কালে কী বল নাই,
সে কি রয়ে গেল গো সিক্ত যুথীর গন্ধবেদনে৷৷
তুমি বিদায়কালে যেতে যেতে থমকে গিয়ে কী ঠিক বলতে চেয়েছিলে সেই না–বলা কথা, হয়তো মিশে গেছে সিক্ত জুঁইফুলের গন্ধের সঙ্গে৷
––অলমিতি, তোমাকে তো বলেছিলাম, এক জন আর্টডিলার আমাকে একটা বড়ো অফার দিয়েছে৷ অনেক টাকার অফার৷ কুড়িটা ছবি এঁকে দিতে হবে৷ তুমি যদি সাহায্য করো তা হলে কাল সকাল
আর্ট–ডিলারকে নিশ্চিত করতে পারি৷
অলমিতি বেশ হাঁপাচ্ছে তখন৷
––তুমি রাজি হলে তোমাকে এখনই দু’লাখ টাকা দিয়ে দেব৷ কাজ শেষ হলে আরও দু’লাখ৷
অলমিতি বুঝে উঠতে পারছিল না স্যার কী বলছেন। অস্পষ্ট গলায় বলল, কীসের টাকা?
––তুমি মডেল হলে এই টাকাটা তোমাকে আমি দেব।
অলমিতির বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন, টাকার অঙ্কটা তার কাছে অনেকটাই৷ তার বাবা একটি প্রাথমিক বিদালয়ের শিক্ষক৷ থাকেন পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত এলাকায়৷ মাসে দুবার কলকাতায় আসেন৷ তারা তিন বোন, বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে, যদিও বিয়েটা তেমন ভালো ঘরে হয়নি৷ মেজদি গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর আর পড়েনি৷ তার জন্য ছেলে দেখাদেখি চলছে৷ কিন্তু তার বাবা বারবার বলছেন, ‘বিয়ের খরচ কী করে মেটাব৷’ অলমিতি এমন একটি পেশা বেছে নিয়েছে যেখানে অর্থোপর্জানও ঘোর অনিশ্চিত৷ ছবি বিক্রির বাজার তৈরি করা এক দুরূহ ব্যাপার৷
এরকম এক দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে এই পরিমাণ অর্থের প্রলোভন কি প্রত্যাখ্যান করতে পারবে! আবার এও মনে হচ্ছে যে–তরুণী বেছে নিয়েছে চিত্রশিল্পীর অভিজাত জীবন, সে কি সামান্য মডেল হয়ে উপার্জনে সায় দিতে পারবে।
অলমিতি হঠাৎ আর্তনাদের স্বরে বলল, স্যার, সবাই তো আমার মুখ চিনে ফেলবে।
চিত্রজিৎ লক্ষ করছিল অলমিতির অভিব্যক্তি, বলল, এই ছবি টাঙানো হবে মুম্বাইয়ের এক ফাইভ স্টার হোটেলে, সেখানে কি তোমার পরিচিত কেউ যাবে কোনও দিন।
––স্যার, তবু যদি কোনও দিন––
––ঠিক আছে, আমি একজন শিল্পী৷ ছবিতে শরীর থাকবে তোমার, কিন্তু তুলির টানে মুখের গড়ন দেব বদলে৷ তোমার পঞ্চমীর চাঁদের মতো কপাল, তা করে দেব অষ্টমীর চাঁদ৷ তোমার পাতলা ঠোঁটে এক পোঁচ রং দিলেই তা একটু পুরু হয়ে যাবে, মনে হবে অন্য এক নারী৷ ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট তিল বসিয়ে দিলেই সেই মুখ আর অলমিতির থাকবে না, তখন সে অন্য কেউ৷ তুমি সেই ছবির সামনে দাঁড়লে আর নিজেকেই চিনতে পারবে না৷
অলমিতির শরীরের কাঁপ একটু থামে৷ সে তখনও মেপে চলেছে চিত্রজিৎকে৷ ভাবার চেষ্টা করছে কতখানি ঝুঁকি নিচ্ছে এই কাজে৷ প্রতি মুহূর্তে তার মনে ভেসে উঠছে সৌম্যর মুখ৷ সারাক্ষণ ভেবে চলেছে যদি সৌম্য ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে তার এই মডেল হওয়ার ঘটনা, তা হলে সে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে কে জানে।
চিত্রজিৎ আবার বলল, তুমি প্রতিটি ছবি দেখবে, দেখে নিজেকে চিনতে চেষ্টা করবে৷ যদি কোনও ছবি দেখে মনে হয় সেই মুখটা তোমার, তা হলে তখনই বাতিল করে দেব ছবিটা৷ কী, রাজি?
অলমিতি সুস্থির হওয়ার চেষ্টা করছে৷
––তা হলে আজই শুরু করে দিই কাজটা৷ চারটে সিটিং–এ হয়ে যাবে আশা করি৷
––স্যার, ম্যাম তো পাশের ঘরেই থাকেন৷ তিনি বুঝতে পারবেন না?
––সুরঞ্জনা অনেকদিন হল আর আমার ঘরে ঢোকে না৷ আমাদের মধ্যে আর সেই সম্পর্ক নেই৷ তবে ছবি আঁকার সময় দরজা বন্ধ করে দেব৷ অন্য সময় যখন আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাব, দরজায় তালা দিয়ে যাব৷
অলমিতি কিছুক্ষণ দোলাচলে থেকে খুলতে শুরু করে দিল তার পোশাক৷
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়