প্রহরশেষের রাঙা আলোয়

কাল্পনিক চিত্র

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

১০.
অলমিতি

নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল


প্রখর রোদ্দুরে পুড়ে যাচ্ছে শহরের বাড়িঘরদোর, পথ৷ ঝাঁ-ঝাঁ করছে জানলার বাইরের পৃথিবী৷ ইজেলের উপর ঝুঁকে পড়ে একটা ছবিতে রং বোলাচ্ছিল অলমিতি, সেসময় রবীন্দ্রসংগীতের সুরে বেজে উঠল মোবাইল৷ অলমিতি চোখ রেখে দেখল, সৌম্য৷

মোবাইল অন করে বলল, বল—
—কী করছিস এখন?
অলমিতি গলার স্বর নরম করে বলল, আমার যা কাজ তাই করছি৷ ছবিতে রং বোলাচ্ছি৷
—কী রং ?
অলমিতি গলার স্বরে কৌতুক মিশিয়ে বলল, শিল্পীদের কি কোনও বিশেষ একটা রং নিয়ে থাকলে চলে! যখন যে রং প্রয়োজন, সেই রং দিচ্ছি৷
সৌম্য একটু থেমে বলল, আমি একটা রং নিয়ে ফেঁসে গেছি৷
—তুই ছবি আঁকছিস নাকি?
—ছবি আঁকব কেন, আমার যা কাজ সেই লেখার মধ্যে একটা বিশেষ রং নিয়ে ভাবনা করেই যাচ্ছি৷ তুই একবার আসবি আমার ঘরে?
—এখন এই আগুনে–দুপুরে একদম পুড়ে যাব যে!
—আমার জন্য একটু না-হয় পুড়লি, তোর যা আগুনে–রং, রোদে পুড়লেও সোনার বরণ একটুও টসকে যাবে না। না হয় একটা সাথী–ট্যাক্সি নিয়ে চলে আয়৷

অলমিতি থাকে চালিয়া রোলিং মিলের একটু ভিতরে৷ সেখান থেকে সৌম্যর অশোকনগর কলোনির বাড়ির দূরত্ব হয়তো এক কিলোমিটারের একটু বেশি৷ সন্ধের পর প্রায়ই অলমিতি হাঁটতে হাঁটতে সৌম্যর বাড়িতে গিয়ে দু’দণ্ড আড্ডা দিয়ে আসে৷ কিন্তু এই রৌদ্রে যাওয়াটা—
সৌম্য বলল, যা ভাড়া উঠবে আমি না-হয় দিয়ে দেব৷

অলমিতির মুখ কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে গেল৷ তারা দু’জনে একসঙ্গে বাংলায় অনার্স পড়েছিল৷ সৌম্য এমএ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ পেয়ে একটু থিতু৷ অন্তত চার বছরের জন্য মাসে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা বরাদ্দ৷ অলমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল না৷ তার ছোটোবেলা থেকে ছবি আঁকার শখ৷ হঠাৎ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল আর্ট কলেজে৷ আর্ট কলেজের পাঠ শেষ করে শুরু করেছে নতুন ধাঁচের ছবি আঁকতে৷ এখন তার দরকার ছবিগুলো কোনও প্রদর্শনীতে দেওয়া৷ একটা–দুটো ছবি যদি বিক্রি হয়—
সৌম্য বলেছিল, ছবি আঁকার লাইনে নাম করা খুব মুশকিল৷ নাম না করলে ছবি বিক্রি হবে না৷
অলমিতি বলে, হ্যাঁ, একটু সময় লাগবে৷ তবে একবার নাম হলে টাকার কথা ভাবতে হবে না৷

এত সব ভাবনার ফুরসতে মাকে বলল, মা, সৌম্য ডাকছে কেন যেন, এখনই ফিরে আসব৷ সবুজ ম্যাক্সিটা বদলে একটা মাখন রঙের চুড়িদার পরে বেরিয়ে পড়ল৷ মাথার উপর একটু টুকটুকে লাল ছাতা৷ মাথা ও মুখে জড়িয়ে নিল একটা কালো ফুটফুট সাদা ওড়না৷ শুধু চোখদুটো বাইরে৷ ছ’নম্বরের রাস্তা না–ধরে হাঁটতে থাকে দু–নম্বর অশোকনগরের ভিতরের একটা সরু রাস্তা বরাবর ৷ ছাতা মাথায় থাকলে কী হবে, রাস্তা থেকে গরম হলকা উঠে ঝলসে দিচ্ছে শরীর৷

পাড়ার ভিতরের রাস্তা শেষ হয়ে ছ’নম্বর রুটের রাস্তাটা পার হয়ে ওপারে আবার অশোকনগর৷ এটা এক নম্বর অশোকনগর৷ বাবার কাছে শুনেছে দুটো অশোকনগরেই আগে ছোটো–ছোটো বেড়ার বাড়ি, টিনের বাড়ি ছিল৷ এখন সব দোতলা–তিনতলা বাড়ি৷ চারতলা ফ্ল্যাটবাড়িই কি কম।

আরও একটু এগোতে সৌম্যদের ফ্যাকাসে হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি৷ একতলায় থাকে ওর বাবা–মা, দোতালায় একটি মাত্র ঘর সেটি সৌম্যর৷ ছাতা বন্ধ করে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দরজা ঠেলল অলমিতি, বলল, একদম ঝলসে গেছি৷

সৌম্য টেবিলে বসে মুখ নীচু করে কী যেন লিখছিল। তার একপাশে রাখা মোবাইলে বাজছিল, ‘নীল দিগন্তে ওই…’, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে এক ঝলক দেখে বলল, তাতে তোর রং একটুও বাদামি হয়নি৷ বোস এখানে৷
টেবিলের অন্য পাশে আর একটা চেয়ার, অলমিতি বসতেই বলল, তুই রঙের কারবারি বলে তোর পরামর্শ নিতে ডাকলাম৷ গানটা তোর শোনা নিশ্চয়ই৷
বলে মোবাইলের গানটা আবার গোড়া থেকে চালিয়ে দিল:
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল,
বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল৷৷

—এই দু’কলি শুনলেই মনে হয় গীতিকার বলছেন বসন্তের ফুলগুলোর কথা৷ বসন্তসেনার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নীল দিগন্তে যারা ফুলের আগুন লাগিয়ে দেয়, সেই পলাশ–শিমুলের কথা৷ কিন্তু গানটা যেই অন্তরায় পৌঁছোল, ভুল ভাঙল গানের শ্রোতার:
আকাশের লাগে ধাঁধা রবির আলো ওই কি বাঁধা৷
বুঝি ধরার কাছে আপনাকে সে মাগল,
সর্ষেক্ষেতে ফুল হয়ে তাই জাগল৷৷
—গীতিকার হঠাৎ সর্ষেফুলের অনুষঙ্গ এনে ঘুলিয়ে দিলেন শ্রোতার ভাবনা৷ বসন্তকালের সঙ্গে সর্ষেফুলের রং এনে একটা নতুন ছবি উপহার দিলেন পাঠক ও শ্রোতাকে৷

অলমিতি বলল, সেই জন্যেই উনি রবীন্দ্রনাথ৷ যা কেউ ভাবেনি, অনুমানও করেনি, রবীন্দ্রনাথ সেরকম চিত্রকল্প উপহার দেন আমাদের৷
তখন গানের সঞ্চারী বাজছে:
নীল দিগন্তে মোর বেদনখানি লাগল,
অনেক কালের মনের কথা জাগল৷৷

—মিতি, নীল দিগন্তে বসন্তের এই সৌন্দর্য পুরোনো দিনের বেদনা হয়ে দেখা দিল কবির মনে৷ এই গানটায় আমার গবেষণার একটা ভালো পয়েন্ট পেয়েছি৷ সকাালে গানটা শোনার পর মনের ভিতরে রিমরিম করছে একটা অদ্ভুত উল্লাস, তাই আনন্দটা তোর সঙ্গে ভাগ করে নেব বলে তোকে কষ্ট দিলাম এখন৷ এই শেষ কলিগুলো শোন:
এল আমার হারিয়ে–যাওয়া কোন ফাগুনের পাগল হাওয়া৷
বুঝি এই ফাগুনে আপনাকে সে মাগল,
সর্ষেক্ষেতে ঢেউ হয়ে তাই জাগল৷৷

—দ্যাখ মিতি, বসন্তকালে ফোটে পলাশ, ফোটে শিমুল, ফোটে অশোক–কৃষ্ণচূড়া৷ সেগুলোতে লাল বা গেরুয়া–লালের প্লাবন৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ বাাসন্তিক সৌন্দর্যের শোভা প্রকাশ করতে সর্ষেফুলের সমাগম ঘটালেন এই গানটায়৷ সঙ্গে সঙ্গে জার্মানির একজন শিল্পী নোল্‌সের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাদৃশ্য পেয়ে গেলাম৷

অলমিতি লক্ষ করছিল সৌম্যের অভিব্যক্তিতে নতুন আবিষ্কারের উচ্ছ্বাস৷ তার গবেষণার বিষয়টি একেবারে অভিনব৷ ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি ও গানে রঙের ব্যবহার’— এরকম একটি নতুন বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করে পড়ে যাচ্ছে বইয়ের পর বই৷ নোল্‌সের কথা আগে শোনেনি অলমিতি৷

—জার্মান–শিল্পী নোল্‌স খুব ঘুরতেন অভিজ্ঞতা বাড়াতে৷ নর্থ সি–র একটি দ্বীপের ফার্ম হাউসে কাটাতেন গ্রীষ্মকালে৷ তারপর ডেনিস সীমানার কাছে একটি বাড়ি কিনে সেখানেই কাটালেন বাকি জীবন৷ সেখানে যে–পরিবেশে থাকলেন, সেখানে মাইলের পর মাইল শূন্য প্রান্তর৷ বাড়ির বাগানে দাঁড়ালে, চারদিকে হাঁটলে অনুভব করা যায় অসীম শান্তি ও অপার সৌন্দর্য৷ অনেকটা শান্তিনিকেতনের মতো পরিবেশ৷ হয়তো তাই হলুদ ও হলুদ–সোনালি রঙের প্রতি দু’জনেরই আকর্ষণ৷
অলমিতি উৎসাহিত হয়ে বলল, দারুণ তো!

—দুটো পরিবেশই খোলামেলা জায়গায় বলে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের যে–রং, সেই রং প্রতিফলিত হয়েছে তাঁদের ছবিতে৷ হলুদ রং দিয়ে যথাযথ আঁকা যায় সূর্যাস্তের আকাশকে৷ ইউরোপের খেতখামারের রঙে, পাকা ফসলের রঙে, ফুল ধরেছে এমন রেপসিডের খেতেও যে–হলুদ রংটা চোখে পড়ে তা চোখ–ধাঁধানো উজ্জ্বল রঙের৷ ভ্যান গখের ছবিতেও এই হলুদ রঙের ছড়ছড়ি৷

সৌম্যর এই নতুন আবিষ্কার, তার উল্লাস বেশ উপভোগ করছিল অলমিতি৷ সৌম্যর কৃতিত্ব যেন তারও কৃতিত্ব৷
—তুইও তোর ছবিতে এই রংটা ব্যবহার করতে পারিস৷ রবীন্দ্রনাথের ছবি যত স্টাডি করছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি৷ একজন বিশ্বখ্যাত কবি অল্প বয়স থেকে সাহিত্যের এত রকম ধারায় লিখে গেছেন, কিন্তু ছবি আঁকব–আঁকব বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ‘না ছবি আঁকা আমার হল না’, তখন তিনি লিখছেন ‘চিত্রা’র কবিতাগুলি, বয়স চৌত্রিশ বছর, সেই তিনিই ছবি আঁকতে শুরু করলেন সাতষট্টি বছর বয়সে৷

অলমিতিকে আগেও একদিন এই কথাগুলো বলেছিল সৌম্য, আবারও বলছে৷ বোধ হয় তার গবেষণার বিষয় নিয়ে নিজের মনে বলে চলেছে, অলমিতি একজন উপলক্ষ্যমাত্র৷
অলমিতি বলল, সত্যিই খুব আশ্চর্য ব্যাপার৷

—তোর নিশ্চয় মনে পড়ছে ‘পূরবী’র কবিতাগুলি যখন লিখছেন, কবিতাগুলি সংশোধন করার সময় কাটাকাুটি করছেন খুব৷ সেই কাটাকুটি আকার পাচ্ছে এক ধরনের ছবির, তার নাম দিয়েছিলেন ডুড্‌ল৷ সেগুলির সৃষ্টি আর্জেন্টিনায় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাড়িতে থাকাকালীন৷ তখন উনিশশো চব্বিশ সাল৷ নিশ্চয় ডুড‌্ল নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল তখনকার আর্জেন্টিনার সংস্কৃতি জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর৷ সেই আলোচনা নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথের মনে শিকড় চারিয়েছিল, তবে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন দেশে ফেরার চার বছর পরে৷

অলমিতি চুপচাপ শুনছিল সৌম্যর বক্তৃতা৷ সে খুব বাধ্য শ্রোতা, তাই সৌম্য তার থিসিসের বিদ্যা অলমিতিকে বলে এক ধরনের তৃপ্তি পায়৷
হঠাৎ কী মনে হতে বক্তৃতা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোর স্যারের কী খবর? বলেছিলি তোর ছবি একজিবিশনে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন।
অলমিতি ইতস্তত করে বলল, বলেছিলেন তো!
—তুই একটা বড়ো খুঁটি পেয়েছিস৷ দ্যাখ, হয়তো তোর কপাল খুলে যেতে পারে৷
অলমিতির বুকের ভিতর ধক করে একটা শব্দ হয়৷
সেই মুহূর্তে মোবাইলে রিং হতে অলমিতি দেখে নিল ফুটে উঠেছে চিত্রজিৎ স্যারের নাম৷ একটু নার্ভাস হয়ে পড়ল, ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতে রিং থেমে গেল একসময়৷
সৌম্য বিস্মিত হয়ে বলল, কী হল, ধরলি না? কার ফোন?
—স্যারের ফোন৷
—ধরলি না কেন? কোনও সমস্যা হয়েছে?
অলমিতি বুঝে উঠতে পারল না সৌম্যর কাছে বিষয়টা কীভাবে ম্যানেজ করবে৷ বলল, না, তেমন কিছু নয়৷ উনি প্রদর্শনীর জন্য পাঁচ–ছটা ল্যান্ডস্কেপ আঁকতে বলেছিলেন৷ এখনও আঁকা শেষ হয়নি৷ উনি শুনলে বকবেন বলে ফোনটা ধরলাম না৷
সৌম্য হেসে বলল, আমি ভাবলাম তোর সঙ্গে কোনও বিষয় নিয়ে গোলমাল হয়েছে। শিল্পীরা একটু গোলমেলে মানুষ হয় কিনা।
অলমিতির বুকের ভিতর আবার ধকধক৷ বলল, বেলা অনেক হয়েছে৷ বাইরে রোদ দেখেছিস এখন আস্ত ফিরতে পারলে হয়।
সৌম্য ব্যস্ত হয়ে বলল, একটা সাথী ডেকে দেব?
অলমিতি হেসে বলল, তোর খুব টাকা হয়েছে, তাই না? আমি এটুকু পথ হেঁটেই যাব৷

বাইরে এসে ছাতা মাথায় দিয়ে পুড়তে পুড়তে চলল অলমিতি৷ এখন এক কিলোমিটার পথ তিন কিলোমিটার মনে হবে৷ কী ভয়ংকর তাপ বাইরে। সেই মুহূর্তে আবার মোবাইলে রিং, একবুক কাঁপ নিয়ে দেখল স্যারের ফোন৷ নাহ, ফোন না–ধরা খুব খারাপ দেখায়৷ ধরতেই ওপাশে শুনল, খুব ব্যস্ত?
—না স্যার৷ ওয়াশরুমে ছিলাম৷ বলুন—
—খুব জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা আছে তোমার সঙ্গে৷ আগামীকাল সন্ধের পর আসতে পারবে?
গা–ঝলসানো রোদের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে অলমিতি বুঝে উঠতে পারল না কী করবে, কোনও ক্রমে বলল, যাব, স্যার—

(ক্রমশ)

অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়