প্রহরশেষের রাঙা আলোয়

কাল্পনিক চিত্র

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

৯.
তমোনাশ

আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে––


এখন শেষদুপুর৷ বিকেল ছুঁই–ছুঁই৷ বিকেলের আলো নিবে গেলে আসবেন সুরঞ্জনাদি৷ তমোনাশ ভাবতে পারছে না এই নিয়ে দ্বিতীয়বার বিখ্যাত গায়িকা তার কাছে আসছেন গানের তালিম দিতে৷

সুমিতাভ উদ্যোগী হয়ে সুরঞ্জনাদির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার পর থেকে তার জীবন বয়ে চলেছে এক অন্য খাতে৷

খাটের উপর বসে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করছিল তমোনাশ— সুরঞ্জনাদি, জন্ম থেকে আমার বসবাস এক বিপুল অন্ধকারের পৃথিবীতে৷ প্রায় সারাদিন একাই থাকতে হত৷ বাড়ির কাজ সামলে, স্কুলের কাজ সেরে মা কতটুকু আর সময় দিতে পাারতেন, নিজের সঙ্গে কথা বলতাম৷ শুধু ঠোঁটদুটো নড়ত৷ হাতদুটোও বোধহয় ওঠানামা করত আমার অজানিতে৷ মা বলত, ‘কী বলছিস বিড়বিড় করে’। বলতাম, ‘আমার ভিতরে বহু কথা জমে ওঠে৷ না বলতে পারলে হাঁপ ধরে যায়৷’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলত মা৷ তারপর প্রথমে সুমিতাভ, তারপর তুমি— একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে আমার জীবন৷ তুমি আসার পর দেখতে পাচ্ছি ফিকে হয়ে যাচ্ছে অন্ধকার৷ তুমি আমার সেই আঁধারের ভিতর এঁকে দিচ্ছ আলোর রেখা৷ আমি ভাবিইনি আমার জীবনে কোনওদিন এরকমটা ঘটতে পারে।

রবীন্দ্রসদনের বসন্তপঞ্চমীর অনুষ্ঠান এতটাই হাততালি কুড়িয়েছে শ্রোতাদের, সমালোচকদের কলমে এতটাই মুগ্ধতা ফুটে উঠেছে যে, এখন সুরঞ্জনা-তমোনাশ জুটি ‘টক অফ দি টাউন’৷ এই জুটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে শহরের বাইরেও৷ ‘রবি–অনুরাগ’-এর রত্নদীপবাবু ফোন করে সুরঞ্জনাদিকে জানিয়েছেন কলকাতা থেকে অনেক দূরে, ইছামতী নদীর কিনারে আছে ‘রাগ ইছামতী’ নামে একটি সংস্থা৷ এই জুটিকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করতে চাইছেন তাঁদের ‘রবিভবন’ মঞ্চে৷ ফাংশন শেষ হতে রাত হয়ে যাবে, তাই রাতে থাকার ব্যবস্থা করবেন ওঁদের গেস্ট হাউসে৷ তাদের দু’জনকে ভালো টাকা দেবেন এই অনুষ্ঠানের জন্য৷

তমোনাশের কাছে অর্থের মূল্য অনেক, কিন্তু এক্ষেত্রে অর্থের চেয়ে আরও মূল্যবান, তার গান গ্রহণীয় হয়েছে মানুষের কাছে৷

এমন এলোমেলো ভাবছিল, তার মধ্যে সুরঞ্জনাদি ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে জানান দিল উপস্থিতি৷ তমোনাশ চেয়ার থেকে উঠে তার আন্দাজমতো এগিয়ে গিয়ে খুলে দিল দরজা৷
সুরঞ্জনাদি ঢুকে বললেন, বাহ, হারমোনিয়াম রেডি করে রেখেছ।
তমোনাশ বলল, আপনার সময় কম৷ তার মধ্যে যতটুকু পারা যায়, গান তুলে নিতে হবে৷
—ঠিকই বলেছ৷ তা হলে আর দেরি না করে শুরু করে দিই রিহার্সাল৷

তমোনাশের খাটের লাগোয়া টেবিল, তার উপর বসানো হারমোনিয়াম৷ খাটের ধারে দু’জনে পাশাপাশি বসতেই সুরঞ্জনাদি বললেন, তমোনাশ, ‘ইছামতী’ সংস্থার যা আবদার, তা পূরণ করা বেশ কঠিন৷ রবীন্দ্রসংগীতের দুই কিংবদন্তী শিল্পী সুচিত্রা মিত্র আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া গানগুলো আমাদের দু’জনের কণ্ঠ থেকে শুনতে চায়৷

তমোনাশ হতাশ কণ্ঠে বলল, কোথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আর কোথায় আমি!
—তমোনাশ, আমাদের সঙ্গে ওঁদের তুলনা করলে শ্রোতারা নিরাশ হবেন জানি৷ তবে স্মৃতি সর্বদাই সুখের৷ তাঁরা এখন আর কেউ জীবিত নেই৷ তাঁদের গান শোনা যায় ইউটিউবে৷ তাঁদের দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া গানগুলো যদি আমরা গাইতে থাকি, তবে শ্রোতারা হয়ে উঠবেন স্মৃতিকাতর৷ ভালো-খারাপ বিচার করতে বসবেন না৷
তমোনাশ তবুও দ্বিধায়, বলল, আমি ওঁদের গান শুনেছি, কিন্তু কিছুই জানি না দুজনের সম্পর্কে।

—তমোনাশ, তুমি নিশ্চয় শুনেছ, সুচিত্রা মিত্রের জন্মশতবার্ষিকী সদ্য অতিক্রান্ত৷ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্ম সুচিত্রা মিত্রের বছর চারেক আগে৷ কিন্তু ওঁরা দু’জনে খুব ভালো বন্ধু ছিলেন৷ সুচিত্রা বয়সে ছোটো হলেও তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম ধরে ডাকতেন৷ দু’জনেই বিখ্যাত গায়ক, কিন্তু হেমন্ত বেশি গাইতেন আধুনিক, সুচিত্রা মিত্র শুধুই রবীন্দ্রসংগীত৷
—সুরঞ্জনাদি, আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আধুনিক খুব পছন্দ করি৷
—সবাই করে, তমোনাশ৷ হেমন্ত বেশি বিখ্যাত তাঁর আধুনিকের জন্যই৷ তবে যখন রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, তখনও ছাপিয়ে যেতেন অন্যদের৷
—জানি, সুরঞ্জনাদি৷
—ওঁদের দু’জনকে নিয়ে অনেক গল্প আছে৷ দ্বৈতকণ্ঠে ওঁদের বেশ কয়েকটা গান আছে৷ তবে সুচিত্রা মিত্র অনেক গান একক রেকর্ড করার পর সেই গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কখনও মঞ্চে গাইলেও রেকর্ড করেননি৷ বড় রেকর্ড কোম্পানির অনুরোধ সত্ত্বেও৷ এমনই ছিল তাঁর নৈতিকতা৷
তমোনাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এই জন্যেই এঁরা বড় শিল্পী৷

—তবে সবচেয়ে কৌতূহলের বিষয় হল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বয়সে বড় হলেও অনেক গান তুলেছেন সুচিত্রা মিত্রর কাছ থেকে৷ হেমন্ত সে-কথা প্রায়ই বলতেন সবার কাছে৷ একবার আশুতোষ কলেজের একটি ফাংশনে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয়েছিল, অর্জুনের গানগুলি সুচিত্রা মিত্রের কাছেই শিখে ফাংশন মাতিয়ে দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র গানগুলিও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুচিত্রা মিত্রের কাছ থেকে শিখে রেকর্ড করেছিলেন।
—সুরঞ্জনাদি, শিল্পীর নাম হেমন্ত৷ তিনি একবার-দু’বার শুনেই গান তুলে নিতে পারেন৷ কী জানি, আমি পারব কি না?
—ঠিক আছে, তা হল শুরু করি৷ ‘এই পৃথিবী পান্থনিবাস’ নামে একটা সিনেমা হয়েছিল গত শতকের সত্তরের দশকে৷ সেই ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সুচিত্রা মিত্র দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছিলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’৷ এই গানটা দিয়েই শুরু করি আজকের রিহার্সাল৷ বাহার-সোহিনী রাগাশ্রিত, তাল— দাদরা৷
সুরঞ্জনা গাইতে শুরু করলেন :
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে—
তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে৷৷

তমোনাশ সুরঞ্জনার সঙ্গে গলা মিলিয়ে আস্থায়ী গাওয়ার পর সুরঞ্জনা থেমে বললেন, এই সিনেমার কোনও কপি আর সংরক্ষিত নেই কোথাও, ফলে গানটাও আর পাওয়া যায় না৷

তমোনাশ বলল, তা হলে কোনওদিন সুযোগ হলে আমরা গানটা দ্বৈতকণ্ঠে রেকর্ড করতে পারি৷
সুরঞ্জনা সে-কথার উত্তর না দিয়ে গাইতে শুরু করল:
সে সাধনায় মিশিয়া যায় বকুলগন্ধ,
সে সাধনায় মিলিয়া যায় কবির ছন্দ
তুমি জান না, ঢেকে রেখেছি তোমার নাম
রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে৷৷
—তমোনাশ, তুমি কি জানো গানের এই ‘তুমি’ কে?

তমোনাশের উত্তরের অপেক্ষা না করেই সুরঞ্জনা বলল, এই গানের তুমি হচ্ছেন, অমিতা সেন৷ তাঁর ডাকনাম খুকু, শান্তিনিকেতেনর আশ্রমিক কন্যা৷ রবীন্দ্রনাথ খুবই ভালোবাসতেন খুকুকে৷ সে স্কুল-কলেজে পড়েছে আশ্রমে থেকে৷ তার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল পথে যখনই বেরোত, পাখির মতো গলা খুলে নিজের আনন্দে গান গাইত৷ তবে ট্রাজেডি হচ্ছে খুকু ভুগছিল নেফ্রাইটিসে৷ আরজি কর হাসপাতাল যখন জানিয়ে দিল, ‘এই অসুখ আর সারবে না’, বিষণ্ণ খুকু এসে শেষ দিনগুলো কাটাল শান্তিনিকেতনে৷
বলতে বলতে সুরঞ্জনা গাইতে লাগল :
তোমার অরূপ মূর্তিখানি
ফাল্গুনের আলোতে বসাই আনি৷
বাঁশরি বাজাই ললিত-বসন্তে, সুদূর দিগন্তে
সোনার আভায় কাঁপে তব উত্তরী
গানের তানের সে উন্মাদনে৷৷

—তমোনাশ, কবি সেই মেয়েটির উদ্দেশে বলছেন, তোমার সঙ্গে সুরের বন্ধনে বেঁধেছি আমার প্রাণ৷ এক অজানা সাধনা করে পেয়েছি তোমাকে৷ সেই সাধনায় মিলে যায় বকুলগন্ধ, সেই সাধনায় মিলে যায় কবির ছন্দ৷ রঙিন ছায়ার আচ্ছাদনে ঢেকে রেখেছি তোমার নাম৷

তমোনাশ তখন ডুবে আছে গানের গভীরে৷ বলল, সুরঞ্জনাদি, অমিতা সেনের কী ভাগ্য, সে এই পৃথিবীতে এসেছিল আয়ু কম নিয়ে, কিন্তু কবি তাঁকে অমর করে রেখে গেছেন৷

—অমিতা সেন তা স্বীকার করেনি৷ বলেছিল, গুরুদেব, আপনি বললেন আমাকে নিয়ে বেঁধেছেন এই গান৷ কিন্তু আমি কি বুঝি না এই গানের প্রকৃত অর্থ কী? এই গানের গভীর অনুভূতি কি আমার মতো ছোটো পাত্রে ধরা সম্ভব? আমাকে উপলক্ষ করে লিখেছেন এই গান, কিন্তু এই গানের ভাব শ্রোতাকে নিয়ে যাচ্ছে কোন গভীরে, কোন পরমার দিকে। আপনি বলছেন, তোমার অরূপ মূর্তি আমি ফাল্গুনের আলোয় এনে বসাব৷ আমি বাঁশি বাজাই ললিত-বসন্তে, আর গানের তানের সেই উন্মাদনায় সুদূর দিগন্তে সোনার আভায় কাঁপে তোমার উত্তরীয়৷
সুরঞ্জনা আরও বলল, তমোনাশ, গানের এই গভীর অর্থ অনুধাবন করে আমাদের পৌঁছে দিতে হবে শ্রোতাদের কানে

—খুব কঠিন কাজ, সুরঞ্জনাদি৷
সুরঞ্জনা বলল, তমোনাশ, আরও দু-তিনটি গান তুলে নিতে হবে আজ৷ সময় খুব বেশি নেই৷ বরং আমরা ‘চণ্ডালিকা’র কিছু অংশ গাই দু’জনে৷ দ্বৈতকণ্ঠে না-হলেও এই ‘নৃত্যনাট্য’-তে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় করেছিলেন আনন্দের গান, সুচিত্রা মিত্র প্রকৃতির গান৷ ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যেও সুচিত্রা গেয়েছিলেন চিত্রাঙ্গদার গান, আর হেমন্ত অর্জুনের গান৷ আমাদের দ্বৈতকণ্ঠের পাশাপাশি এই দু’টো নৃত্যনাট্যের অংশবিশেষ গাইতে পারি দু’জনে৷ সেও একরকমের বৈচিত্র্য হবে৷

তমোনাশ দ্বিধা–দ্বিধা কণ্ঠে বলল, এত বড় দায়িত্ব কি আমি নিতে পারব, সুরঞ্জনাদি, আপনি সিনিয়র শিল্পী, আপনার পক্ষে যা সম্ভব, তা কি আমি পারি!

সুরঞ্জনা বলল, তমোনাশ, শিল্পীর জীবনে ঝুঁকি নিতে শিখতে হবে৷ ঝুঁকি না নিলে বড়ো হওয়া যায় না৷ নাও, ধরো, আনন্দের গান––
জল দাও, আমায় জল দাও৷
রৌদ্র প্রখরতর, পথ সুদীর্ঘ,
আমায় জল দাও৷
আমি তাপিত পিপাসিত,
আমায় জল দাও৷
আমি শ্রান্ত
আমায় জল দাও৷৷

—তমোনাশ, ‘চণ্ডালিকা’র প্রকৃতি এক চণ্ডালের কন্যা৷ তাকে বাস করতে হয় সমাজের বাইরে৷ গ্রামে দইওয়ালা এলে তাকে কিনতে দেয় না গ্রামের অন্য মেয়েরা৷ কেননা, সে অশুচি৷ গ্রামে চুড়িওয়ালা এলে তাকে কিনতে বাধা দেয় অন্য মেয়েরা৷ ঠিক এরকম সময়ে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু এলেন, শ্রান্ত-ক্লান্ত৷ তিনি প্রকৃতির কাছে চাইলেন জল৷ প্রকৃতি তখন নিজের চণ্ডালিকা পরিচয়ে লজ্জিত, বিধ্বস্ত৷ চণ্ডালিনী হয়ে সে কী করে জল দেবে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে, তখন প্রকৃতি গাইছে :
ক্ষমা করো, প্রভু, ক্ষমা করো মোরে––
আমি চণ্ডালের কন্যা,
মোর কূপের বারি অশুচি
আমি চণ্ডালের কন্যা৷
তোমায় দেব জল হেন পুণ্যের আমি
নই অধিকারিণী৷
আমি চণ্ডালের কন্যা৷
তখন আনন্দ গাইবে, নাও ধরো:
যে মানব আমি, সেই মানব তুমি কন্যা৷
সেই বারি তীর্থবারি যাহা তৃপ্ত করে তৃষিতেরে
যাহা তাপিত শ্রান্তেরে স্নিগ্ধ করে সেই তো পবিত্র বারি৷
জল দাও আমায় জল দাও৷

গানটা শেষ হলে হঠাৎ পাশে বসা সুরঞ্জনার হাত চেপে ধরে তমোনাশ বলল, আমি পারব?
সুরঞ্জনা হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল, নিশ্চয় পারবে৷
তমোনাশের হাত আরও জোরে চেপে ধরল সুরঞ্জনার হাত, বলল, সুরঞ্জনাদি, আর একটু ধরে রাখি তোমার হাতদুটো৷ আমার জীবনে এই প্রথম নারীশরীরের স্পর্শ৷
(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়