বাড়ির দুই বধূর খুনের কথা স্বীকার করে নিল ছোট ছেলে প্রসূন

ফাইল চিত্র

অবশেষে ট্যাংরা কাণ্ডের রহস্য ভেদ করল কলকাতা পুলিশ। শুক্রবার ছোট ছেলে প্রসূন কার্যত স্বীকার করে নিলেন, স্ত্রী ও বউদিকে তিনি নিজের হাতেই খুন করেছেন। কীভাবে তিনি সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, তা পুলিশি জেরার মুখে খোলসা করেছেন। প্রসূন জানিয়েছেন, প্রথমে হাতের শিরা কেটে এবং পরে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে বাড়ির দুই বউ – রোমি ও সুদেষ্ণার মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন। শুধু তাই নয়, নাবালক ভাইপোকেও খুনের চেষ্টা করেছিলেন প্রসূন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। ফলে তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনার দিন রাতেই দুই ভাই বেরিয়ে পড়েন। শুক্রবার জেরার মুখে কার্যত এই তথ্য স্বীকার করে নিয়েছেন বাড়ির ছোট ছেলে প্রসূন।

তদন্তকারীদের জেরায় প্রসূন জানিয়েছেন, আগে স্ত্রী রোমির হাতের শিরা ও গলা কাটা হয়। রোমি প্রথমে নিজেই বাঁ হাতের শিরা কাটার চেষ্টা করে ব‍্যর্থ হন। তারপর প্রসূনই তাঁর শিরা কেটে দেন। রোমি সেটা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। এজন্য বেশ কিছুক্ষণ প্রসূনের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়। তাঁর ডানদিকের তলপেটে, দুই ঠোঁটে, ডানদিকের কাঁধে কালশিটে দাগ পাওয়া গিয়েছে, যাতে মনে হচ্ছে তিনি প্রতিরোধ করেছেন। তিনজনের ভিসেরা পাঠানো হয়েছে পরীক্ষার জন্য।

এদিকে নিজের স্ত্রীকে খুনের পর অন্য ঘরে গিয়ে একইভাবে বৌদি সুদেষ্ণার হাতের শিরা কেটে দেন প্রসূন। শিরা কাটার সময় যাতে মুখে আওয়াজ না বেরয়, সেজন্য দুই বৌয়ের ক্ষেত্রেই মুখে বালিশ চাপা দেওয়া হয়।


এদিকে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় প্রসূনের দাদা প্রণয় বাড়ির তিনতলায় ছিলেন। সেখানেই ছিলেন তাঁর নাবালক পুত্র। প্রসূন দুই বধূর মৃত্যু নিশ্চিত করার পর নাবালককে নিচের তলায় নামিয়ে এনে তাঁর হাতের শিরা কাটার চেষ্টা করেন। জীবিত নাবালক পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, তাঁর বাবা প্রণয়ও তাঁকে মারতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রসূন হাতের শিরা কাটার সময় তার কোনও যন্ত্রণা অনুভূত হয়নি। বরং সে প্রাণে বাঁচতে মৃত সাজার অভিনয় করে। এমনকি শ্বাস বন্ধ করে নিথর হয়ে বেশ কিছুক্ষণ পড়ে থাকে। পরে বাবা ও কাকা আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বেরনোর সময় সেও তাঁদের সঙ্গে যায়। এরপরই ওই রাতে বাইপাসের ধারে মেট্রোর পিলারে গাড়ির ধাক্কায় তিনজন আহত হয়। তবে নাবালক প্রতীপের বয়ান কতটা সত্যি, তা নিয়ে তদন্তকারীরা এখনও নিশ্চিত নন। বিষয়টি খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

বাড়িতে তিনজনের মৃতদেহ রেখে আত্মহননের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে দুর্ঘটনার পর প্রণয় ও প্রসূন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে এখন পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। আর অসুস্থ নাবালকটি এখন হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন। সে কাকিমা রোমির বাবা মায়ের কাছে থাকতে চায় বলে জানিয়েছে।

উলেখ্য, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার ভোরে বাইপাসে অভিষিক্ত মোড়ে প্রসূন ও প্রণয়দের গাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটে। এদিন অভিষিক্তার মোড়ে মেট্রো রেলের পিলারে ধাক্কা মারে গাড়িটি। ঘটনায় নাবালক প্রতীপ সহ তিনজনে গুরুতর জখম হন। পুলিশ তাঁদের বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। তখন তাঁদের কাছে জানতে পারে, ট্যাংরায় তাঁদের বাড়িতে আরও তিনজনের দেহ পড়ে রয়েছে। এরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে দুই বধূ রোমি দে, সুদেষ্ণা দে ও প্রসূনের কন্যা প্রিয়ম্বদার মৃতদেহ উদ্ধার করে। পুলিশের জেরার মুখে প্রণয় ও প্রসূন দাবি করেন, তাঁরাও আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে ওই পিলারে গাড়ি সমেত ধাক্কা মারেন।

পরে তদন্তে জানা যায়, ট্যাংরায় ‘দে’ পরিবারের মৃত তিনজনকেই খুন করা হয়েছে। কিন্তু কে খুন করল, কেন করল এবং কীভাবে এই খুনের ঘটনা সংঘটিত হয় তা নিয়ে একাধিক সংশয় তৈরি হয়। গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ মেলেনি। বিষয়টির রহস্য ভেদ করতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই ভাই প্রণয় ও প্রসূন সুস্থ হলে তাঁদের হেফাজতে নিয়ে তদন্ত শুরু করে লালবাজার। এরপরই খুনের প্রকৃত রহস্যের জট খুলতে শুরু করে।

বাইপাসের দুর্ঘটনার পরে প্রথমে প্রসূন দাবি করেছিলেন, আর্থিক সমস্যার কারণে একসঙ্গে পরিবারের ছয়জন সদস্য আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। তাঁদের পায়েসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খেয়েছিলেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুই বধূর হাত ও গলার শিরা কাটা হয়েছিল। এই বিষয়টি নিয়ে রহস্য ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে। তাঁদের দাবি কতটা সত্যি, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হয়। কারণ, পরিবারের দুই বধূ সুদেষ্ণা দে ও রোমি দে এবং প্রসূনের নাবালিকা মেয়ে প্রিয়ম্বদাকে খুন করা হয়েছে বলেই তদন্তকারীরা প্রাথমিকভাবে অনুমান করেন। নিহত তিনজনের ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টও তেমনই ইঙ্গিত দেয়। এই খুনের পিছনে কার কী ভূমিকা রয়েছে তা নিয়ে তদন্তকারীদের মাথায় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। বড় ভাই প্রণয় দাবি করেন, তিনি সাধারণ দুর্বল প্রকৃতির। সেজন্য ছোট ভাই প্রসূনকেই ভার দিয়েছিলেন দুই বধূ ও নাবালক পুত্রের শিরা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য। তাঁর এই দাবি কতটা সত্য, তা জানার জন্য দুই ভাইকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরার পরিকল্পনা করেন তদন্তকারীরা। অবশেষে ছোট ভাই প্রসূন খুনের কথা স্বীকার করে নিতেই তদন্তকারীদের সংশয় কাটল।