কলেজের গার্ড রুম ছিল মনোজিতের অলিখিত ‘বিচারালয়’

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

কসবা ল’ কলেজের ডন মনোজিৎ মিশ্র ধর্ষণ কাণ্ডে ধরা পড়তেই একের পর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করেছে। তাঁর দৌরাত্ম্য নতুন নয়। এই কলেজে অনেকদিন ধরেই মনোজিৎ দাদাগিরি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে রীতিমতো একজন মাস্তান বলেই জানে কলেজের সকলে। তাঁর ট্র্যাক রেকর্ড চেক করলে অতীতের অনেক অপরাধ সামনে চলে আসবে। তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ওই আইন কলেজের একাধিক ছাত্রী, যাঁরা হয় তাঁর নির্যাতনের সাক্ষী, নাহলে নির্যাতিতা। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে এখন একের পর এক বিস্ফোরক অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করেছে।

এদিকে কসবা ল’ কলেজে আইনের ছাত্রীকে গণধর্ষণের তদন্তে ধৃত নিরাপত্তারক্ষী পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায় জেরার মুখে মূল অভিযুক্ত মনোজিতের বিরুদ্ধে নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বলে পুলিশ সূত্র জানা গিয়েছে। সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজের ওই নিরাপত্তারক্ষীর ঘর বা গার্ড রুমকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করত ওই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র তথা কর্মী মনোজিৎ মিশ্র। কার্যত এটি ছিল তাঁর অলিখিত বিচারালয়। কেউ তাঁর হুকুম না মানলেই এই ঘরে এনে অত্যাচার চালানো হতো। সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে ‘হকি স্টিক’ ও ‘রড’। ওই ঘরের ভিতর বহু ছাত্রকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার নাম করে মারধর করা হত।

এমনকী, কিছু ক্ষেত্রে নির্যাতন বা অত্যাচারের হাত থেকে ছাত্রীরাও রেহাই পেতেন না। তদন্ত চলাকালীন পুলিশের কাছে এমনই সব চাঞ্চল্যকর অভিযোগ সামনে এসেছে। গত বুধবার রাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ধর্ষণের ঘটনার সময় যখন গার্ড রুমের ভিতরে ওই নির্যাতিতা বিবস্ত্র হতে রাজি হননি, তখন তাঁকে হকি স্টিক দিয়ে মারধরের চেষ্টা করা হয়। তাঁর মাথাতেও আঘাত করা হয় বলে অভিযোগ। এই ব্যাপারে আরও বেশ কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।


শুধু ছাত্রীরা নন, কলেজের ছাত্ররাও তাঁর লবিতে যোগ না দিলে শুরু হতো অত্যাচার। এমনকি সেই ছাত্রের বাবা-মাকেও হুমকির শিকার হতে হতো। বিশেষ করে বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর ছেলে হলেই তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দিতো মনোজিতের গোষ্ঠীর লোকেরা। এটাই ছিল কসবা গণধর্ষণকাণ্ডে ধৃত, তৃণমূল কর্মী মনোজিত মিশ্রর সাম্রাজ্যের নিয়ম। এরকম একটা দুটো নয়, একের পর এক অন্যায়ের ভয়ঙ্কর অভিযোগ উঠে এসেছে মনোজিতের বিরুদ্ধে। মনোজিৎ গ্রেপ্তার হতেই কলেজের এরকমই একজন প্রাক্তন ছাত্র মনোজ পাণ্ডে তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন।

জানা গিয়েছে, কলেজে মনোজিৎ ‘ম্যাঙ্গো’ নামে পরিচিত ছিলেন। সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজের ওই প্রাক্তন ছাত্র জানিয়েছেন, তিনি মনোজিতের কথা মানতে চাননি, ভিড়তে চাননি তাঁর দলে। তার পরিণাম ভুগতে হয়েছিল বাবা-মাকে। ফোন করে কার্যত প্রাণে মারারই হুমকি দেওয়া হয়েছিল। মনোজ কুমার পাণ্ডের কথায়, মা-বাবাকে হুমকি দেয়। যে আপনার ছেলেকে কলেজে ঢুকতে দেব না। বলেছিল গুলি করে মেরে দেব। তুলে নিয়ে যাব। তারপর বলেছিল, পেট কেটে দেব। একপ্রকার হত্য়া করারই হুমকি দিয়েছিল। বলেছিল যে, আপনার ছেলেকে গায়েব করে দেব।

মনোজিতের লবিতে যোগ না দিলে পড়ুয়ার মা-বাবাকে পর্যন্ত হুমকি দিতে ছাড়েনি ‘গুণধর’ মনোজিৎ। সারদাপল্লির বাসিন্দা মুকুন্দ পাণ্ডে ২০১৯-এর ১৭ ডিসেম্বর কসবাকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্রের বিরুদ্ধে আনন্দপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। তাঁর ছেলে মনোজকুমার পাণ্ডে সেসময় কসবা ল’ কলেজেরই পড়ুয়া ছিলেন। মুকুন্দ পাণ্ডে অভিযোগ, মনোজিৎ ও তাঁর দলবল ১৬ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৮ টা নাগাদ তাঁর উত্তর পঞ্চান্নগ্রামের দোকানে চড়াও হয়। সে সময় স্বামীর সঙ্গেই দোকানে ছিলেন মনোজের মা নমিতা পাণ্ডে। অভিযোগকারীর দাবি, আনন্দপুর থানার পাশাপাশি কসবা থানাতেও অভিযোগ জানিয়েছিলেন। যদিও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।