দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির, যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ মা ভবতারিণীর উপাসনা করতেন, যেখানে মা সারদা দীর্ঘদিন থেকেছেন, যেখানে স্বামী বিবেকানন্দ থেকে শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সহ অনেকে পা রেখেছেন, সেই ঐতিহাসিক মন্দির আসলে সাধারণের সম্পত্তি, নাকি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন? বহু বছর ধরে এই প্রশ্ন আদালতে বিচারাধীন। দু’বছর শুনানি বন্ধ থাকলেও পরে বুধবার আবার নতুন করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করল কলকাতা হাইকোর্ট।
হাইকোর্ট এদিন দক্ষিণেশ্বর মন্দির সংক্রান্ত যাবতীয় মামলা বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য ও বিচারপতি সুপ্রতীম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। আগামী ১৭ ডিসেম্বর থেকে মূল মামলার শুনানি শুরু হবে। তার আগে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে নোটিস পাঠানোরও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। বিশেষত, মন্দির ট্রাস্টকে কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও আর্থিক অনুদান দিয়েছে কি না, পরবর্তী শুনানিতে সেই হিসেব-নিকেশ সম্বলিত রিপোর্ট আদালতে জমা দিতে হবে।
এর আগে ২০২২ সালে ট্রাস্টি কমিটির নির্বাচন, আর্থিক অনিয়ম ও ট্রাস্টের কার্যকলাপ নিয়ে জনস্বার্থ মামলা হয়। অভিযোগ ওঠে, দীর্ঘদিন ধরে মন্দির কর্তৃপক্ষ হিসেব-নিকেশে গুরুতর ত্রুটি করেছে। কিন্তু মামলার শুনানি এগোয়নি। ফলে অনিয়মের অভিযোগ অমীমাংসিত থাকে।
মন্দিরের কয়েকজন সেবায়েত ও শিষ্যদের একাংশ তিন বছর আগে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। তাঁদের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার গত কয়েক বছরে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা দিয়েছে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরকে। কেন্দ্রও বিভিন্ন খাতে প্রায় ২০ কোটি টাকা দিয়েছে। কিন্তু এই বিপুল অর্থের সঠিক ব্যয় ও হিসেব ট্রাস্ট নথিভুক্ত করেনি। আরও গুরুতর অভিযোগ, মন্দির চত্বরে দোকান বরাদ্দ নিয়েও দুর্নীতি হয়েছে। পাশাপাশি হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ট্রাস্টি বোর্ডের নির্বাচন গত কয়েক দশক ধরে ঠিক নিয়মে হয়নি বলেও অভিযোগ।
এই পরিস্থিতিতে আবেদনকারীরা আদালতের কাছে অনুরোধ জানান, ইডির মতো কেন্দ্রীয় সংস্থা বা কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন করে যেন স্বাধীন তদন্ত করানো হয়। তাঁদের বক্তব্য, ধর্মীয়-ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন এই মন্দিরের সম্পত্তি, অর্থব্যবস্থা ও প্রশাসন স্বচ্ছ থাকা অত্যন্ত জরুরি।
উল্লেখ্য, ১৮৫৫ সালে রানি রাসমনি দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরে শ্রীরামকৃষ্ণ এখানেই মা ভবতারিণীর আরাধনা এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। তাঁর স্ত্রী মা সারদা মন্দিরের নহবতের একটি ঘরে বহু বছর ছিলেন। দীর্ঘকাল ধরে সাধক-ভক্তদের এই তীর্থক্ষেত্র বাংলার ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অমূল্য অধ্যায়। পরে শ্রীরামকৃষ্ণ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই তিনি পরলোকগমন করেন।
তবে মন্দিরটি এখন সাধারণ মানুষের সম্পত্তি, নাকি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন, সেই সিদ্ধান্ত আগামী দিনের আদালতের রায়ে আরও স্পষ্ট হবে। এই মামলার চলতি শুনানি সেই পথই খুলে দিতে পারে বলে আবেদনকারীরা মনে করছেন।