কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের অনুপস্থিতি ভীষণভাবেই চোখে পড়বে

নিজস্ব চিত্র

বরুণ দাস

নতুন বছরে অর্থাৎ ২০২৫-র জানুয়ারির শেষে শুরু হতে চলেছে কলকাতা বইমেলা। আন্তর্জাতিক তকমা পাওয়া এই বইমেলা কলকাতাই শুধু নয়, গোটা দেশের কাছেই এক সারস্বত গর্ব ও অহংকারের অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। বইকে নিয়ে ১২ দিনের এই উৎসব (মহোৎসব বলাটাই বোধহয় ঠিক হবে) দেশজুড়ে সাড়া ফেলেছে। গত শতকের ‘৭৬-এ যার সূত্রপাত।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার যখন পার্কসার্কাস ময়দানে গ্রন্থমেলার শুরু করেন, তখন কে জানতো ওই মেলা দিনে দিনে ফুলেফেঁপে এমন বৃহৎ আকার ধারণ করবে। বিশেষ করে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের সঙ্গে জোট বেঁধে। পার্কসার্কাস ময়দানে পর রবীন্দ্রসদন চত্বর কিংবা পার্কস্ট্রিট ময়দানে আলাদাভাবে রাজ্য সরকার ও গিল্ড বইমেলা করলেও তা তেমন জমে ওঠেনি। তারপর তো বইমেলার গোটাটাই ইতিহাস।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, শুরুর প্রায় বিশবছর বাদে অর্থাৎ ১৯৯৬-এ কলকাতা বইমেলায় প্রথম যোগ দেয় আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গৌরবময় উপস্থিতি কলকাতা বইমেলার মুকুটে বাড়তি পালক জুড়ে দেয় নিঃসন্দেহে। বইমেলার বাংলাদেশ প্যাভেলিয়নে ভিড় জমান বইমেলার মানুষ। কেনাকাটা ও দেখা- দুটোই কলকাতা বইমেলার উপরি পাওনা হয়ে ওঠে। প্রতিদিনই উপচে পড়া ভিড়।


এক ছাতার তলায় বাংলাদেশের যাবতীয় বাংলা বইয়ের সংগ্রহ। ছোটোবড়ো প্রকাশনার বিভিন্ন স্বাদের বই। কিনেও শান্তি। দেখেও তৃপ্তি। সেদেশের বইয়ে দাম অনেকটা বেশি হওয়ায় অনেকেই সাধ থাকলেও সেভাবে কিনতে পারেন না বটে; তবে হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখার সুযোগ তো হয়। কারণ গ্রন্থশিল্পও যে এতোটা নান্দনিক সৌকর্যে পৌঁছতে পারে-তার হাতেগরম উদাহরণ আমাদের প্রতিবেশি বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশ।

যদিও সেদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘একুশের বইমেলা’ চলে দীর্ঘ একমাস ধরে। তাঁর ব্যাপ্তি ও বিস্তার হয়তো কলকাতা বইমেলার চেয়ে অনেক বেশি। আয়োজনের শৈল্পিক নৈপুণতা ও বৈচিত্র বইমেলার ক্রেতা ও দর্শকদের আকৃষ্ট করে। প্রতিদিন বিপুল মানুষের সমাগম হয় এই বইমেলায়। না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন একথা বলাইবাহুল্য। বাংলাদেশের ‘একুশের বইমেলা’ ঘুরে এসে তেমনটাই মনে হয়েছে এই নিবন্ধকারের।
গ্রন্থপ্রেমী অনেকেই কমবেশি জানেন যে, কলকাতায় নয়া উদ্যোগ বাংলাদেশের বইয়ের একমাত্র প্রকাশক। ফলে এদেশে বিশেষ করে এপার বাংলার আগ্রহী পাঠকের কাছে বাংলাদেশের বইয়ের চাহিদা মেটানো একটি মাত্র প্রকাশকের গুটি কয়েক টাইটেলের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। ‘৯৬-এর পর অর্থাৎ কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের যোগদানের পর পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে একথা নির্দ্বিধায় বলাই যায়।
কারণ নিবন্ধের আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে সেদেশের বিপুল বইয়ের সম্ভারের কথা। মেলায় বই কেনা ছাড়াও সেদেশের খ্যাত-অখ্যাত কবি-লেখকদের সঙ্গে সরাসরি আড্ডা (মত বিনিময়) দেওয়ার সুযোগ তো ছিলই। বাঙলাদেশ নজরুল ইন্সটিটিউটের উপ-অধিকর্তা তথা নব্বইয়ের বিশিষ্ট কবি রেজাউদ্দিন স্ট্যালিন তো প্রতিবারই আমাদের দিগন্তবলয় টেবিলে এসে দেখা করে যেত।

ওঁর লেখা সাম্প্রতিক কবিতাগুচ্ছও দিয়ে যেত। পরিচয় হতো সেদেশের আরও অনেক কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে-যারা লেখা পাঠাতেন এবং সারা বছর চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন। কিংবা পরবর্তীকালে ফোনের মাধ্যমে কখনও-সখনও কথাবার্তা হতো। কলকাতা বইমেলায় বাংলাদেশের যোগদান উভয় দেশের কবি-লেখক-পাঠক-সম্পাদক-প্রকাশকদের অনেক কাছাকাছি এনে দিয়েছিল একথা স্বীকার করতেই হবে।

সম্ভবতঃ এবারই তাঁর আকস্মিক ছন্দপতন ঘটতে চলেছে। যা উভয় দেশের সারস্বত চাহিদাকে সঙ্কুচিত করবে নিশ্চিত। কারণ আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা-২০২৫-এ আমাদের প্রতিবেশি বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশ যোগ দিতে পারছে না। কেন পারছে না, কোথায় তাঁর অন্তরায়, কী করলে সেই অন্তরায় দূর করা যায় কিংবা দূর করার সদিচ্ছা কার কতোটা- এসব নিয়ে নানা মুনির নানা মত। আমরা সে বিষয়ে ঢুকছি না।
তবে আমাদের প্রতিবেশি বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের অনুপস্থিতি দারুণভাবেই টের পাব এবিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। জুলাই-এর কোটা-বিরোধি (কথান্তরে বৈষম্য বিরোধি) ছাত্রআন্দোলন, লাখো জনতার গণভবন আক্রমণ, ৫ আগস্ট সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগ এবং মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার গঠন- এই নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তীব্র ভারত-বিরোধিতা দু’দেশের সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলেছে।

অন্তবর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের অর্বাচিন উপদেষ্টাদের কড়া ভারত-বিরোধী বিবৃতির পাশাপাশি দু’দেশের দায়িত্বজ্ঞানহীন অতি-উৎসাহী কতিপয় কনটেন্ট ক্রিয়েটারের অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কিত ভিডিও এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। যা সামাল দিতে দিল্লির বিবৃতিই যথেষ্ট নয়, ছুটতে হয়েছে ভারতের বিদেশ সচিবকেও। যদিও তাতে অবশ্য ‘কাজের কাজ’ বিশেষ কিছু হয়নি। কারণ ভারত-বিরোধিতার আগুনের গনগনে দীপশিখা এখনও কিন্তু উজ্জ্বল। দ্বীপ্যমান। কিছু কিছু ভাসা ভাসা ‘ব্যবস্থা নেওয়া’র কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়নে বাঙলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখা যায়নি এ যাবৎ। এটাই রুঢ় বাস্তব।

এই বাস্তব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই কলকাতা বইমেলার অন্যতম আয়োজক সংস্থা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড কর্তৃপক্ষ দোটানায় আছেন। দোটানায় আছেন রাজ্য সরকারও-যারা এই মেগা বইমেলার সহ আয়োজকও বটে। বিষয়টা অনেকটাই নির্ভর করছে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। তাঁদের সঙ্গে কথা না বলে রাজ্য সরকার কিংবা গিল্ডের পক্ষে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া মুশকিল একথা সবাই জানেন।
কিন্তু কেন রাজ্য সরকার এবং গিল্ড এতোদিনেও কথা বলছেন না কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে। কেন বিষয়টা ঝুলিয়ে রেখেছেন? মেলা-কর্তৃপক্ষ আমন্ত্রণ না জানালে বাঙলাদেশ আসবেই বা কী করে? প্রতিবারই তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ বছর তারা কোনও আমন্ত্রণ পাননি। জানিয়েছেন কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস অধিকর্তা। কলকাতা বইমেলায় তাঁরা যে আসতে অনিচ্ছুক তা কিন্তু নয়।

তা হলে কেন এই দৃষ্টিকটু গড়মসি? আসলে কোনও পক্ষই বোধহয় আগ বাড়িয়ে কোনওরকম ঝুঁকি নিতে রাজি নন। এমন দোলাচল কোনওভাবেই কাম্য নয়। কলকাতা বইমেলার স্বার্থেই ত্রিপাক্ষিক আলোচনা করে একটা সুষ্ঠু সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। তা নাহলে উভয় দেশের মধ্যেই একটা ভুল বোঝাবুঝির পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং যা পারস্পরিক সু-সম্পর্কে আরও জটিল তো বটেই, নষ্ট করেও দিতে পারে।
একথা ঠিক, বইমেলায় কিছু অতি-উৎসাহী পাবলিকের কিংবা রাজনীতির ঝান্ডাধারী কর্মীদের সম্ভাব্য অবাঞ্ছিত কান্ডকারখানা নিয়ে মেলা-কর্তৃপক্ষ হয়তো উদ্বিগ্ন। সস্তা রাজনৈতিক ফায়দা তোলাই যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। মেলায় কোনও অঘটন ঘটলে তাঁর সম্পূর্ণ দায় এসে বর্তাবে মেলা-কর্তৃপক্ষের ওপর। তাই তাঁরা নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে থাকাটাই পছন্দ করছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাবই হয়তো তাই।
এই জটিল পরিস্থিতিতে কেউ আর আগ বাড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন না। বাংলাদেশকে বইমেলায় আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারে তাই সবপক্ষই ‘স্পিকটি নট!” কিন্তু এটা সম্ভবতঃ ঠিক হচ্ছে না। তাদেরকে বরং আমন্ত্রণ জানানো হোক। প্রয়োজনে মেলায় তাঁদের প্যাভেলিয়নে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হোক। প্রায় আঠাশ বছরে গড়ে ওঠা দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী এক পরম্পরাকে এভাবে নষ্ট করে দেওয়া বোধহয় ঠিক নয়।
‘তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ এই সাবেকি শুভ ও মানবিক বোধকে কোনও ভাবেই গুডবাই জানানো উচিত নয়। আমাদেরকে তাই বোধহয় আরও বেশি সহনশীল, আরও বেশি উদার এবং আরও বেশি ধৈর্যশীল হওয়ার প্রয়োজন আছে। কারণ ছোট্টোরা ভুল করলে তাঁকে শোধরানোর দায়িত্ব তো বড়োদেরই। একথা ভুলে গেলে চলবে না। সাম্প্রতিক উদ্ভুত পরিস্থিতিকে এভাবেই দেখা দরকার।
প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে কে কবে এগিয়ে যেতে পেরেছে? পুরনো ইতিহাস কী বলে? বাংলাদেশও পারবে না নিশ্চিত। সেদেশের বাস্তব পরিস্থিতি অন্ততঃ তারই প্রমাণ দেয়। সে দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের (চাল-ডাল-আলু-পিঁয়াজ-নুন-বস্ত্র থেকে পর্যটন সহ যাবতীয় প্রসাধনী দ্রব্য) জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করতে হয়, উভয় সম্প্রদায়ের আত্মীয়-পরিজনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন দু’দেশের অভ্যন্তরে।

তাছাড়া যেদেশের মানুষকে ন্যূনতম চিকিৎসা-পরিষেবার জন্য ভারতে ছুটে আসতে হয়, যেদেশের জলের (সুখা কিংবা বন্যায়) জন্য ভারতের ওপর ভরসা করতে হয়, যেদেশের প্রাকৃতিক কিংবা মনুষ্য-সৃষ্ট বিপর্যয়-কালে সর্বাগ্রে ভারতের সাহায্যের প্রয়োজন হয় এবং যেদেশের মাতৃভাষা (এবং রাষ্ট্রভাষাও) এপার বাংলার মতো একই-সেদেশের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক-শূন্যতা কখনও কল্পনাও করা যায়না।

প্রথমবার অর্থাৎ গত শতকের ১৯৯৬-এ আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ যখন কলকাতা বইমেলায় অংশ নেয়, সেবার সঙ্গে এসেছিলেন মুজিব-কন্যা তথা সেদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। যদিও বইমেলার উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রবীণ কবি শামসুর রহমান। রাজনীতিকে সরিয়ে সারস্বত দিকটিতে নজর দেওয়া হয়েছিল। এখন অবশ্য সেসব উধাও!
নষ্ট দলীয় রাজনীতিই এখন গ্রাস করছে এদেশের যাবতীয় নান্দনিক ও সারস্বত উদ্যোগকে। যেদিকে তাকাবেন, সেদিকেই দেখবেন রাজনীতির লোকেরা জাঁকিয়ে বসে আছেন। যাঁরা বইমেলার আয়োজন-উদ্যোগে নানাভাবে জড়িয়ে আছেন, তাঁরাও ঝুঁকে আছেন ওই ক্ষমতাসীন রাজনীতির দিকেই। এই ঝোঁক বা প্রবণতা কতোটা কাম্য-তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক উঠতেই পারে। কিন্তু সুষ্ঠু মীমাংসায় আসা সম্ভবতঃ সহজ নয়।

পরিশেষে আবারও বলা যায়, এবার আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা-২০২৫-এ বাংলাদেশের অনুপস্থিতি আমাদেরকে অনেকটাই পীড়া দেবে নিশ্চিত। সেদেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিকূল পরিস্থিতি কিংবা নোংরা রাজনীতির সঙ্গে বইমেলাকে জড়িয়ে ফেলা বোধহয় ঠিক কাজ নয়। এখনও সময় আছে, বইমেলার অভিজ্ঞ উদ্যোক্তারা যদি সচেষ্ট হন তো বাংলাদেশ অংশ নিতেও পারে। এবং মেলার সম্পূর্ণতা তাহলে বজায় থাকে।