সৈয়দ হাসমত জালাল
১৯২১ সাল। গান্ধীজি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছেন অসহযোগ আন্দোলনের। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা গোবিন্দ সুন্দরী বিদ্যাপীঠ স্কুলের বেশ কয়েকজন ছাত্রও ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে। সেসময় কলকাতা থেকে প্রাদেশিক কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, মৌলানা আহমদ আলী বেলডাঙায় এক বিশাল জনসমাবেশে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে বক্তৃতা করতে আসেন। তাঁদের সেই অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা শুনে প্রবল উত্তেজিত হয়ে ওঠে গোবিন্দ সুন্দরী বিদ্যাপীঠের ছাত্ররাও। পরদিন এক বিশাল জমায়েতে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ব্রিটিশের গোলাম তৈরির কারখানা স্কুলে তারা আর যাবে না। এরপর অধিকাংশ ছাত্রই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল।
ওই ছাত্ররা তখন তাদের নাম লিখিয়েছে জাতীয় কংগ্রেসে। শুরু করেছে বিদেশি কাপড় পোড়ানো, মদ-গাঁজার দোকান ভাঙচুর বা পিকেটিংয়ের মতো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে। একদিন তাদের মধ্যেই একজন ছাত্র তার সহপাঠীদের নিয়ে এক মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীর দোকান থেকে কিছু বিলিতি কাপড় তুলে নিয়ে এসে প্রকাশ্য বাজারের মধ্যে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ওই ব্যবসায়ী থানায় গিয়ে ডায়েরি করতেই পুলিশ এসে ছ’জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। কিন্তু পাঁচজন ছাত্রকে তাদের অভিভাবকেরা বন্ড লিখে দিয়ে মুক্ত করে নিয়ে যান। কিন্তু যে ছাত্রটি ওই কাণ্ডের মূল হোতা, সে কিছুতেই বন্ড লিখে দিতে সম্মত হলো না। ফলে তাকে তিন মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।
এই ছাত্রটির নাম সৈয়দ আব্দুর রহমান ফেরদৌসী। সাজাপ্রাপ্ত ফেরদৌসীকে প্রথম এক মাস বহরমপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে এবং তারপর দু-মাস কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হলো। এ বিষয়ে সৈয়দ আব্দুর রহমান ফেরদৌসী ১৯৯৫ সালের শারদীয় ‘কান্দী বান্ধব’ পত্রিকায় ‘আমার স্বাধীনতা সংগ্রামী জীবনের কিছু স্মৃতিচারণ’ শীর্ষক একটি রচনায় বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।
কলকাতায় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকার সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মতো জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ ঘটে তাঁর।
তিন মাস কারাবাসকালে ওইসব মহান নেতৃবৃন্দের দ্বারা তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপ্ত হয়ে পুরোপুরি ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। জেল থেকে ফিরে এসে তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার নিজের গ্রাম খোশবাসপুর এবং পার্শ্ববর্তী গ্রাম গোকর্ণ, চাটরা প্রভৃতি এলাকার প্রচুর সমবয়সী তরুণকে পাশে পেয়ে যান। তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে সমাজউন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছোট ছোট সভা ও সংগঠন করে যেতে থাকেন।
মূলত তাঁরই উদ্যোগে গোকর্ণ গ্রামে একটি প্রাথমিক কংগ্রেস কমিটি গঠন করা হয়, যার সম্পাদক করা হয় ফেরদৌসীর বন্ধু গোকর্ণ গ্রামেরই জগদ্বন্ধু দাশকে আর সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় চাটরা গ্রামের মিয়া মস্উদ্ উর রহমানকে।
এই কমিটির পরিচালনায় গোকর্ণে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। ফেরদৌসীর আহ্বানে বহরমপুর থেকে জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক শ্যামাপদ ভট্টাচার্য, জ্যোতির্ময় রায়চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ওই সভায় এসে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় বক্তৃতা দেন। বক্তৃতা দেন ফেরদৌসীও। ফেরদৌসী তাঁর বাগ্মিতার ও সাহসিকতার গুণে সকলের কাছেই গ্রহণীয় হয়ে উঠেছিলেন। এই সভার ফলে ওই বিস্তীর্ণ এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী চিন্তাধারা তৈরি হতে থাকে এবং প্রবল সাড়া পড়ে যায়। ফেরদৌসীর সঙ্গে জগদ্বন্ধু দাশ, রাধাশ্যাম চক্রবর্তী, ফণিভূষণ সিংহ ও আরও বহু কংগ্রেস কর্মী ও নেতৃবৃন্দ গ্রামে গ্রামে গিয়ে সভা করতে থাকেন। সেইসঙ্গে চলে মদ-গাঁজার দোকানে পিকেটিং।
সেসময় মুসলিম লীগেরও সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন গ্রামে। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে মুসলিম সমাজের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা চলে। ফেরদৌসী তার তীব্র বিরোধিতা করেন এবং কংগ্রেসের পক্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। তার ফলে মুসলিম লীগপন্থী কিছু দুষ্কৃতী এক রাতে ফেরদৌসীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় ও তৎপরতায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায় ফেরদৌসীর পরিবার। কিন্তু ফেরদৌসী তাতে দমবার পাত্র ছিলেন না। লীগপন্থীদের পক্ষ থেকে অপমান ও শারীরিক আক্রমণের পর্যন্ত লক্ষ্য হয়ে ওঠেন ফেরদৌসী। কিন্তু তাঁর পরম সাহসিকতা ও সতীর্থ-বন্ধুদের সহযোগিতার ফলে লীগপন্থীরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। বরং ফেরদৌসীর আকর্ষণে ও তাঁর বুদ্ধিমত্তার কারণে স্থানীয় মুসলিম লীগের বেশ কিছু কর্মী কংগ্রেসে যোগ দেয়।
ধীরে ধীরে মুর্শিদাবাদ জেলার একদিকে সালার, তালিবপুর, অন্যদিকে লালগোলা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকেন ফেরদৌসী ও তাঁর সতীর্থ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।
১৯৩০ সালের জুলাই মাসে আবার নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে ফেরদৌসীর। সেসময় মুর্শিদাবাদ জেলা নেতৃত্বের নির্দেশে এবং জঙ্গিপুর, রঘুনাথগঞ্জের কংগ্রেস নেতা বিজয় ঘোষালের আহ্বানে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে জঙ্গিপুর মহকুমার কিছু এলাকায় জনসভায় তাঁকে বক্তৃতা করতে হবে। ভাগীরথী নদীর তীরে রঘুনাথগঞ্জে একটি খোলা ময়দানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় দশ/বারো হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল নেতাজিকে স্বাগত ও সমর্থন জানাতে। ওই সভায় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের উপস্থিতিতে প্রথমেই ফেরদৌসীকে বক্তৃতা করার জন্য আহ্বান করেন সভাপতি। নেতাজি পাশে থাকায় তিনি যেন এক অতিরিক্ত উদ্দীপনা অনুভব করেছিলেন সেদিন। তাঁর অগ্নিবর্ষী ভাষণের মধ্যেই ঘন ঘন করতালিতে জনগণ অভিনন্দিত করেন ফেরদৌসীকে। তিনি প্রায় ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দেন। পরবর্তী দু-একজন বক্তার পর নেতাজি ওঠেন ভাষণ দিতে। প্রায় দু-ঘণ্টাব্যাপী তাঁর অপূর্ব তেজস্বী ভাষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন ওই কয়েক হাজার জনতা। তাঁর বক্তৃতাশেষে সভাস্থল ফেটে পড়ে স্বতঃস্ফূর্ত করতালি ও জয়ধ্বনিতে। সভার পর সেই রাতে নেতাজীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ-আলোচনার সুযোগ ঘটে ফেরদৌসীর। ১৯২১ সালে কলকাতার আলিপুর জেলে সাক্ষাতের পর এই দ্বিতীয়বার তাঁদের দেখা হলো। তাঁর প্রতি সুভাষচন্দ্রের মধুর ব্যবহারের স্মৃতি ফেরদৌসীর মনের মণিকোঠায় সযত্নে রক্ষিত ছিল। ওই সভার কিছুদিন পরেই ঔরঙ্গাবাদের রেকাবচাঁদ শেঠীর আমন্ত্রণে জেলা নেতৃত্ব শ্যামাপদ ভট্টাচার্য, জ্যোতির্ময় রায়চৌধুরী, শশাঙ্কশেখর সান্যাল প্রমুখের সঙ্গে ফেরদৌসী এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে আসেন। এর পরের দিনটা ছিল ১৯৩০ সালের ২৭ আগস্ট, জঙ্গিপুরের কংগ্রেস নেতা বিজয় ঘোষালের আমন্ত্রণে ফেরদৌসী দ্বিতীয় বার জঙ্গিপুরে যান এবং সুতি থানার কালীগঞ্জ কারবালা ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ গ্রেফতার করে ফেরদৌসীকে। তাঁকে সেদিন নিয়ে যাওয়া হয় জেল হাজতে। পরে ২৯ আগস্ট তাঁকে জঙ্গিপুর মহকুমার তৎকালীন মহকুমা শাসক জি বি সেনের এজলাসে তোলা হয়। সেখানেই তাঁর বিচার হয় এবং বিচারে তাঁকে ছ-মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। জঙ্গিপুর থেকে সশস্ত্র পুলিশ পাহারায় তাঁকে পাঠানো হয় বহরমপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে। বহরমপুরে জেলা কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও, গোকর্ণ ও কান্দি এলাকার তাঁর সতীর্থরা-সহ এক বিপুল জনতা আসেন ফেরদৌসীকে অভিনন্দন জানাতে।
সেসময় বহরমপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে বিনা বিচারে বন্দী ছিলেন বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজ, বীরেন চট্টোপাধ্যায়, মণি সিংহ, সুকুমার রায়চৌধুরী এবং করাচির কমিউনিস্ট নেতা জালালুদ্দিন বোখারী প্রমুখ।
সৈয়দ আব্দুর রহমান ফেরদৌসী কম বয়স থেকেই সাহিত্যচর্চার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। গত শতকের তিরিশের দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘সওগাত’, ‘মোহাম্মদী’, ‘গুলিস্তা’ প্রভৃতি পত্রিকা ছাড়াও ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় তাঁর লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল বইয়ের এক বিপুল ভাণ্ডার। গোকর্ণে একটি পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে তুলতেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
বহরমপুর ডিস্ট্রিক্ট জেলে ফেরদৌসীর সম্পাদনায় ও তাঁরই হাতের লেখায় প্রকাশিত হতো পত্রিকা। প্রথমে ‘রক্তকেতন’ ও পরে ‘বন্দিনী’ নামে এই হাতে লেখা পত্রিকায় লিখতেন জেলবন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।
আর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, জেলের মধ্যেই কমিউনিস্ট নেতা জালালুদ্দিন বোখারী সহবন্দীদের ক্লাস নিতেন কমিউনিজম ও মার্কসবাদ বিষয়ে। ফেরদৌসীও জালালুদ্দিন বোখারীর কাছে কমিউনিজমের পাঠ নিতেন অন্যান্যদের সঙ্গে। বহরমপুরের সনৎ রাহা, অনন্ত ভট্টাচার্য, লালবাগের সুধীর ব্যানার্জি, রাধাকান্ত গোস্বামী, গোকর্ণের জগদ্বন্ধু দাশ, রাধাশ্যাম চক্রবর্তী প্রমুখ তাঁর সহবন্দী ও বন্ধুরাও এই ক্লাস করতেন। মার্কসবাদী দর্শন ও রুশ বিপ্লবের প্রভাব পরাধীন ভারতেও প্রবলভাবেই পড়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মার্কসবাদে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। মুর্শিদাবাদেও পড়েছিল তার প্রভাব। কমিউনিজম ও মার্কসবাদ সম্পর্কে পাঠ নেওয়ার ফলে ফেরদৌসীর রাজনৈতিক জীবন বাঁক নেয় এবং শুরু হয় অন্য এক অধ্যায়।